মতামত ও বিশ্লেষণ

পার্বত্য চুক্তির দুই দশক পূর্তি:রাজনৈতিক সমস্যা বনাম অর্থনৈতিক সমাধান – মঙ্গল কুমার চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয় তুলে ধরলেই সরকারের পক্ষ থেকে ফলাও করে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। উন্নয়নের ফিরিস্তি এমনভাবে তুলে ধরা হয় যেন কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন কার্যক্রমই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ। তারই অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই দশক পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্রোড়পত্রে (ডেইলী স্টার, ২ ডিসেম্বর ২০১৭) একনজরে ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তির অর্জন’ সংক্রান্ত যে ১৮টি বিষয় দেখানো হয়েছে তার মধ্যে ১২টি বিষয় হচ্ছে উন্নয়ন সংক্রান্ত। আর ৬টি বিষয় ছিল চুক্তি সংশ্লিষ্ট। যেমন- পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি; তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ শক্তিশালীকরণ; পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন গঠন; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পর্যটন, সমবায়, মৎস্য, সমাজ কল্যাণসহ ৩০টি বিভাগ/ বিষয় ৩ পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন, এবং ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ সংক্রান্ত টাস্কফোর্স গঠন- এই ৬টি বিষয় দেখানো হয়েছে যেগুলো চুক্তির বিভিন্ন ধারার সাথে সম্পৃক্ত।
উক্ত ক্রোড়পত্রে কথিত অপর ১২টি বিষয়ের মধ্যে দেখানো হয়েছে নতুন রাস্তা ও ব্রীজ নির্মাণের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন; সার্কেল চীফ/ হেডম্যান/ কার্বারীদের ভাতা বৃদ্ধি; ঢাকার বেইলী রোডে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নির্মাণ; তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে প্রতি বছর শিক্ষা-বৃত্তি প্রদান; কৃষকদের উন্নয়নে মিশ্র ফলের বাগান সৃজন; রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ এবং রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা; প্রত্যন্ত অঞ্চলে সৌর বিদ্যুৎ সুবিধা সম্প্রসারণ; বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন সম্প্রসারণ ও সাবস্টেশন স্থাপন; ৪০০০ পাড়া কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান; ৪টি আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ; মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু; নিরাপদ পানি সরবরাহ সুবিধা বৃদ্ধি ইত্যাদি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পার্বত্য চুক্তির দুই দশক পূর্তি উপলক্ষ্যে গত ১ ডিসেম্বর পার্বত্যবাসীর সাথে ভিডিও কনফারেন্সের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেছেন যে, “এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নতি হয়েছে। আজকে শান্তি চুক্তি হওয়ার ফলে সেখানে রাস্তাঘাট হয়েছে। আজকে সাজেক পর্যন্ত যাওয়া যায়।” উক্ত কনফারেন্সে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিংও তাঁর স্বাগত বক্তব্যের পুরোটা জুড়ে তুলে ধরেছিলেন উন্নয়নের নানা কথা। তিনি বলেছিলেন, “এই উন্নয়নের ফলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে ছোট্ট একটি উদাহরণ দিয়ে বলতে চাই, ৭০-৭১ সালে সেই সময় যোগাযোগ ক্ষেত্রে যদি বলি সেখানে পাকা রাস্তা ছিলো মাত্র ৪৮ কিলোমিটার। আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পরে পার্বত্য এলাকায় উন্নয়নের শুরু হওয়ার কারণে প্রায় ১৪০০-১৫০০ কিলোমিটার রাস্তা পাকা হয়েছে।”
’৭১ সাল থেকে বর্তমান সরকারের দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত পার্বত্যাঞ্চলের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়েছে কি হয় নাই সেটা এই লেখার বিচার্য নয়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার ধরন কী? এটা কি নিছক একটি অর্থনৈতিক বা উন্নয়ন সমস্যা নাকি একটি রাজনৈতিক সমস্যা? সরকারের নীতিনির্র্ধারকদের বক্তব্য শুনলে মনে হবে যেন পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি অর্থনৈতিক সমস্যা। তাই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সরকার এসব উন্নয়ন মহাযজ্ঞ বাস্তবায়ন করে চলেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে দিয়ে চলেছে। বস্তুত বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক এবং জাতীয় সমস্যা। পূর্বের মতো ১ ডিসেম্বরের ভিডিও কনফারেন্সেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা বলে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছিলেন যে, “রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে…।”
কিন্তু সরকারের বক্তব্যে বা চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিকভাবে সমাধানের বিষয়গুলো অত্যন্ত সন্তর্পনে ও সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রাক্কাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বিশেষ শাসিত অঞ্চল হিসেবে শাসিত হয়ে আসছে। অষ্টাদশ খ্রীস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীন হলেও ব্রিটিশ শাসকরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগোষ্ঠীর আভ্যন্তরীণ প্রশাসনের উপর কোন হস্তক্ষেপ করেনি। পরবর্তীতে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির মাধ্যমে উপনিবেশিক কর্তৃত্ব পাকাপোক্ত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসনবহির্ভূত এলাকা হিসেবে ঘোষণা, জুম্ম জনগণের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা, বহিরাগতদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন ও ভূমি মালিকানায় বিধিনিষেধ, ফ্রন্টিয়ার পুলিশ রেগুলেশনের মাধ্যমে স্বতন্ত্র পুলিশ বাহিনী গঠন ইত্যাদি বিশেষ ব্যবস্থা বলবৎ ছিল। পরবর্তীতে ১৯১৯ সাল ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসনেও পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনবহির্ভূত এলাকার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনবহির্ভূত এলাকার মর্যাদা এবং ১৯৬২ সালের সংবিধানে ট্রাইবাল এরিয়ার মর্যাদার স্বীকৃত ছিল।
তারই আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বকীয় শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস, জুম্ম জাতিসমূহের স্বকীয় সংস্কৃতি ও জাতিগত পরিচিতি, পার্বত্য চট্টগ্রামের পশ্চাদপদতা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে ১৯৭২ সালে গণপরিষদে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের চারদফা দাবিনামা তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী জুম্ম জনগণের সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিল। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণকে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করা হয়।
একের পর এক সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের সেই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই রাজনৈতিক সমস্যাকে সামরিক উপায়ে সমাধানের জন্য ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার দীঘিনালা, রুমা ও আলিকদমে তিনটি ক্যান্টনমেন্ট স্থাপন করে। পরবর্তীতে জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের শাসনামলেও সামরিক কায়দায় জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে দমন করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। এক সময় জেনারেল জিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন। সেই লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে উন্নয়ন বোর্ডের যাবতীয় উন্নয়ন কার্যক্রম জুম্ম জনগণের আন্দোলনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে ব্যবহার করা হয়। সেসময় মুখ্যত সামরিক বাহিনী ও সরকারি উদ্যোগে বসতিপ্রদানকারী চার লক্ষাধিক সেটেলার বাঙালিদের অবাধে চলাচলের জন্য ব্যাপক রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ, বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম, অবৈধভাবে ভূমি বেদখল ও বন্দোবস্তী প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও জুম্ম জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে দমন করা যায়নি। বরঞ্চ পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা আরো জটিল থেকে জটিলতর রূপ ধারণ করে।
ফলশ্রুতিতে একপর্যায়ে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের জন্য আন্দোলনরত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে যোগাযোগ করতে থাকে। বলাবাহুল্য, সশস্ত্র আন্দোলনে অবতীর্ণ হলেও জনসংহতি সমিতিও বরাবরই আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের পথ খোলা রাখে। ফলে প্রথমে এরশাদ সরকারের সাথে ১৯৮৫ সালের ২১ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা হিসেবে সরকার পক্ষ স্বীকার করে নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় এরশাদ সরকারের সাথে ৬ বার, খালেদা জিয়া সরকারের সাথে ১৩ বার ও সর্বশেষ শেখ হাসিনা সরকারের সাথে ৭ বার আনুষ্ঠানিক সংলাপের ফসল হিসেবে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি” স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার ফলে সেই কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক সমাধান আজো অর্জিত হতে পারেনি। সরকার পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নের প্রতি প্রাধান্য না দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে কেবল উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে চলেছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হতে থাকে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্যতম মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে সরকার সচতুরভাবে ধামাচাপা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে সামরিক উপায়ে সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অধ্যুষিত অ লের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষিত করা না হলে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন কার্যকর করা না হলে, পক্ষান্তরে জুম্মদেরকে সংখ্যালঘু করার হীনউদ্দেশ্যে বহিরাগত অভিবাসন যদি অব্যাহতভাবে চলতে থাকে; সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, সকল প্রকার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় যদি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা না হলে; স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকা প্রণয়ন পূর্বক নির্বাচনের মাধ্যমে যদি এসব পরিষদ গঠিত না হয়; চার শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্পসহ অপারেশন উত্তরণ নামক সেনাশাসন যদি প্রত্যাহার করা না হয়; প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের যদি যথাযথভাবে পুনর্বাসন করা না হয়; পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ যদি নিষ্পত্তি না হয়, পক্ষান্তরে যদি ভূমি বেদখল ও জুম্মদেরকে তাদের স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে; বহিরাগতদেরকে যদি স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র দিয়ে চাকরিসহ নানা সুযোগ-সুবিধাদি প্রদান করা অব্যাহত থাকে; তাহলে কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সুষ্ঠ সমাধানে কতটুকু ভূমিকা রাখবে তা সহজেই অনুমেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে অথর্ব করে রাখা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির পর ২০ বছর ধরে এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন উদ্যোগ নেই সরকারের। পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়নের কাজ বিগত ২০ বছর ধরে উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলের সদস্যদেরকে চেয়ারম্যান-সদস্য পদে মনোনয়ন দিয়ে অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদসমূহ পরিচালিত হচ্ছে। নিজেদের দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থে এভাবে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসব পরিষদকে স্থায়ীভাবে পরিচালনার হীনউদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তীকালীন পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্যসংখ্যা ৫ সদস্য থেকে ১৫ সদস্যে বৃদ্ধি করে ২০১৪ সালে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধন করা হয়। অনির্বাচিত বা মনোনীত এসব অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের জনমানুষের কাছে নেই কোন দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা। ফলত এসব অন্তর্বর্তী পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যদেরকে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে দেখা যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যানকে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন তথা পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন করে পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা ডেপুটি কমিশনারকেও অর্পণের ক্ষেত্রে এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত না করে প্রচলিত ভোটার তালিকা (যেখানে বহিরাগতদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে) নিয়ে পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতেও আপত্তি নেই বলে মতামত ব্যক্ত করতে দেখা যায়। বলাবাহুল্য, ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে উপযুক্ত প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে পার্বত্যবাসীকে বঞ্চিত রেখে কিংবা জনগণের কাছে দায়বদ্ধহীন অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী পরিষদ গঠনের অগণতান্ত্রিক ধারা বজায় রেখে হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করলেও পার্বত্যবাসীর উন্নয়ন হতে পারে না। সেই উন্নয়ন কার্যক্রম কখনোই এলাকার জনমানুষের উন্নয়ন প্রত্যাশা পূরণ কিংবা পার্বত্য চুক্তির উদ্দেশ্য- পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে না।
১ ডিসেম্বরের ভিডিও কনফারেন্সে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর বলেছিলেন, “৭০-৭১ সালে যেখানে মাত্র ৪৮ কিলোমিটার রাস্তা ছিল, সেখানে প্রায় ১৪০০-১৫০০ কিলোমিটার রাস্তা পাকা হয়েছে”, সেই পাকা রাস্তার উপকারিতা পার্বত্যা লের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীরা কিছুটা যে পাচ্ছে না তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু উপকারের চেয়ে ঢের বেশি অপকার বা ক্ষতির মুখোমুখী হচ্ছে এতদা লের স্থায়ী অধিবাসীরা। পার্বত্যা লে যেখানেই পাকা রাস্তাঘাট নির্মিত হয়েছে সেখানে জুম্ম অধিবাসীরা ধীরে ধীরে উচ্ছেদ হয়ে পড়ছে। তারা আরো প্রত্যন্ত অ লে বিতাড়িত হতে বাধ্য হচ্ছে। আর পক্ষান্তরে সেখানে অবাধে সেটেলার বাঙালিদের অভিবাসন ঘটছে। সেটেলার বাঙালিরা যেখানেই যাচ্ছে সেখানে ভূমি জবরদখল করছে, স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে কার্যত এ ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন পার্বত্য চুক্তিতে স্বীকৃত পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অধ্যুষিত অ লের বৈশিষ্ট্যের উপর চরম ক্ষতি সাধন করে চলেছে। উন্নয়নের নামে ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্প, সরকারি উদ্যোগে সমতল থেকে চার লক্ষাধিক বাঙালি বসতিপ্রদান, দুই লক্ষ আটার হাজার একর জুমভূমি ও মৌজাভূমিকে রিজার্ভ ফরেস্ট হিসেবে ঘোষণা ইত্যাদি প্রকল্পসমূহ এতদা লের জুম্ম জনগণের চরম বিপর্যয় ঘটিয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অধ্যুষিত অ লের বৈশিষ্ট্য এবং জুম্ম জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও স্বকীয়তা ইত্যাদি বিবেচনা না করে নির্বিচারে রাস্তাঘাট নির্মাণসহ বহুমুখী উন্নয়ন কর্মকান্ড জুম্ম জনগণের চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলছে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক অংশীদারিত্ব হিসেবে পার্বত্য চুক্তিতে ‘ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা’, ‘আইন-শৃঙ্খলা’ ও ‘পুলিশ (স্থানীয়)’ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের হস্তান্তরিত বিষয় হিসেবে বিধান করা হয়েছে। কিন্তু সরকার এসব বিষয় এখনো হস্তান্তর করেনি। পার্বত্য চুক্তির ‘গ’ খন্ডের ৯(গ)নং ধারা মোতাবেক আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের ব্যাপারে সমন্বয় সাধন ও তত্ত্বাবধানের যে বিধান রয়েছে তা এখনো কার্যকর করা হয়নি। মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ থেকে ১০ এপ্রিল ২০০১ সালে তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের ব্যাপারে আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক সমন্বয় সাধন ও তত্ত্বাবধান করার পরিপত্র জারি করা হলেও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপার, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার পরিষদসমূহ এবং তিন পার্বত্য জেলা ও থানা পর্যায়ের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আঞ্চলিক পরিষদকে অগ্রাহ্য করে চলেছে।
বস্তুত আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের অগোচরে ও আলোচনা ব্যতিরেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর গুইমারা উপজেলা, সাজেক থানা ও বড়থলি ইউনিয়ন গঠনের যে বিবরণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও ভাষণে তুলে ধরা হয়েছে সেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে আ লিক পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের সাথে আলোচনা ও পরামর্শ করা হয়েছে বলে জানা যায়নি। সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, ঠেগামুখ স্থল বন্দর স্থাপন, স্থানীয় সেনা কর্তৃপক্ষ ও পর্যটন কর্পোরেশনের উদ্যোগে বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, রক্ষিত ও সংরক্ষিত বন ঘোষণা, অস্থানীয় ব্যক্তিদের নিকট ভূমি ইজারা প্রদান, বিজিবির অর্ধ-শতাধিক বিওপি স্থাপন ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কার্যক্রম আ লিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সাথে আলোচনা ও পরামর্শ ছাড়াই গৃহীত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে।
নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই নির্র্ধারণ করার লক্ষ্যে আ লিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হলেও এসব পরিষদসমূহকে অথর্ব অবস্থায় রাখার ফলে এখনো পূর্বের মতো উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া উন্নয়ন ধারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবৎ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তা আজ পূর্বের সরকারগুলোর অনুসৃত নীতির মতো জুম্ম স্বার্থ-পরিপন্থী ও চুক্তি বিরোধী হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহের বাস্তবায়ন নিশ্চিত না হওয়ার ফলে চুক্তি-পূর্ব সময়ের উন্নয়ন কার্যক্রমের মতো বর্তমান সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিচালিত অধিকাংশ উন্নয়ন কার্যক্রমও জুম্ম জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও জীবনধারার উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। তথাকথিত এসব উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে জুম্ম জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা, পার্বত্যা লের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়ছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জুম্ম জনগণ তথা পার্বত্যবাসী উন্নয়ন বিরোধী নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন কার্যক্রম দরকার নেই এমনটা বলার কোন অবকাশ নেই। বর পার্বত্য চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ৯ ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চুক্তিতে বিধৃত মৌলিক বিষয়সমূহ, যেগুলির সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান, পার্বত্যবাসীর বিশেষ শাসনব্যবস্থার অংশীদারিত্ব, পার্বত্যা লের অন্যতম সমস্যা ভূমি সমস্যার সমাধান, সংঘাতময় পরিস্থিতিতে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষের পুনর্বাসন, পার্বত্যা লে বলবৎ সেনা কর্তৃত্বের অবসান, সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন ইত্যাদি গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত সেসব মৌলিক বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে কোন উন্নয়ন কার্যক্রম টেকসই হতে পারে না কিংবা পার্বত্য জনমানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। উন্নয়ন কার্যক্রমকে অবশ্যই পার্বত্য চুক্তির উল্লেখিত মৌলিক বিষয়সমূহের বাস্তবায়নের সাথে সমান তালে এগিয়ে নিতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়নের সহায়ক হিসেবে উন্নয়ন কার্যক্রমকে পরিচালনা করতে হবে। চুক্তির মূল স্পিরিট তথা মৌলিক বিষয়সমূহকে খর্ব করে পরিচালিত কোন উন্নয়ন কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
১ ডিসেম্বরের ভিডিও কনফারেন্সে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে পূর্বে “সামরিকী কায়দায় দমন করার প্রচেষ্টা চালানো হয়” বলে জানিয়েছেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর সেই সামরিকী ধারার কোন মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে এমনটা বলার কোন অবকাশ নেই। পার্বত্য চুক্তিতে ছয়টি ক্যান্টনমেন্ট ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী ব্যতীত সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের বিধান করা হলেও এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে চার শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে। অধিকন্তু পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারই ২০০১ সালে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে এক প্রকার সেনা শাসন জারি করে কার্যত সেই সামরিকী ধারা বজায় রেখেছে। এই ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। পার্বত্য চুক্তি-পূর্ব অবস্থার মতো সেনাবাহিনী বর্তমান সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রামে অবাধে যত্রতত্র তল্লাসী অভিযান, দমন-পীড়ন এবং বাক-স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশের উপর হস্তক্ষেপ ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছে। চুক্তি-পূর্ব সময়ে যেভাবে সেনাবাহিনী এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বার, হেডম্যান-কার্বারী, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ক্যাম্পে তলব করা বা তাদেরকে নিয়ে সভা-সমাবেশ-সম্মেলন আয়োজন করতো, ঠিক তেমনি বর্তমান সময়েও একই কায়দায় বিভিন্ন সেনা রিজিয়ন, জোন ও ক্যাম্প কর্তৃক নিয়মিত তলব কিংবা সভা-সমাবেশ-সম্মেলন আয়োজন করে থাকে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চুক্তি-পূর্ব সময়ে একের পর এক সরকার জনসংহতি সমিতি বা জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, চাঁদাবাজি কার্যক্রম হিসেবে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। কিন্তু শত অপপ্রচার সত্ত্বেও জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের আন্দোলন একটি ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন হিসেবে দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছিল। ফলশ্রুতিতে জনসংহতি সমিতির সাথে আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক সংলাপ চালিয়ে যেতে একের পর এক সরকারও বাধ্য হয়েছিল এবং একপর্যায়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছিল। চুক্তি-পূর্ববর্তী সময়ের মতো বর্তমান সময়েও শাসকশ্রেণি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বসহ আন্দোলনরত জুম্মদেরকে চাঁদাবাজি, অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অপপ্রচার চালাতে কার্পণ্য করছে না। এসব সাজানো অভিযোগে অভিযুক্ত করে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রযন্ত্রসমূহ তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের, ধরপাকড়, জেলে প্রেরণ, ক্যাম্পে আটক ও নির্যাতন, ঘরবাড়ি তল্লাসী ইত্যাদি নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি জনসংহতি সমিতির কার্যক্রমকে সমর্থন না করতে ও কার্যক্রমে জড়িত না হতে জুম্ম জনগণকে হুমকি দিয়ে চলেছে। তাই যেখানে মানুষের মৌলিক মানবাধিকারের সামান্যতম নিশ্চয়তা নেই, যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয়, যেখানে মানুষ কখন কোন মুহূর্তে তাদের জায়গা-জমি হারাবে বা নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক অস্ত্র গুঁজে দিয়ে তুলে নিয়ে অমানুষিক নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়ে পঙ্গুত্ব জীবন বরণ করবে এমনিতর এক অনিশ্চিত ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে জুম্ম জনগণকে বসবাস করতে হয় সেখানে লক্ষ কোটি টাকার উন্নয়ন কিংবা নয়নাভিরাম রাস্তাঘাট দিয়ে কী হবে?
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে এ ধরনের দমন-পীড়নের পেছনে অন্য যাই কারণ থাকুক না কেন, মূল উদ্দেশ্য হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে নস্যাৎ করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা। এমনিতর পরিস্থিতির আলোকে এটা নি:সন্দেহে বলা যেতে পারে যে, আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে সামরিক দমন-পীড়নের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ তথা জুম্ম জনগণের চুক্তি বাস্তবায়নের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে দমনের পথ বেছে নিয়েছে। পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের সামরিক নীতি পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামী লীগ সরকারও কার্যত গ্রহণ করে চলেছে বলে বললেও অত্যুক্তি হবে না। এমনিতর অবস্থায় আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের ক্ষেত্র দিনের পর দিন সীমিত হয়ে পড়ছে, যা দেশের সার্বিক স্বার্থে কখনোই কাম্য হতে পারে না।
১ ডিসেম্বরের ভিডিও কনফারেন্সে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছিলেন, “সমতল ভূমি থেকে বহু মানুষ সেখানে (পার্বত্য চট্টগ্রামে) নিয়ে তাদেরকে রাখা হয়েছিলো। এভাবে দ্বন্দ্বটা আরো বেশি বৃদ্ধি করা হয়।” উল্লেখ্য যে, আনুষ্ঠানিক সংলাপ চলাকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দাবির প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক তৎকালীন চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদল্লাহ নিশ্চিত করেছিলেন যে, উনিশ্শো আশি দশকে পুনর্বাসিত সেটেলারদেরকে সমতল অঞ্চলে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন দেয়া হবে বলে প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছেন। সেই সূত্রে ২ ডিসেম্বর চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর জনসংহতি সমিতির সভাপতির নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের নিকটও প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেন। বস্তুত এলক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্যাঞ্চলকে উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি ও এই বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিধান, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে বেহাত হওয়া জমি জুম্মদের নিকট ফেরত দেয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিশেষ শাসনকাঠামো প্রবর্তন, পাহাড়ি অধিবাসীদের ভূমি অধিকার সংরক্ষণ, প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দার সংজ্ঞা নির্ধারণ, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সার্কেল চীফ কর্তৃক স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদান, জন্ম-মৃত্যুর পরিসংখ্যান সংরক্ষণ প্রভৃতি বিধানাবলী অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিগত দুই দশকের মধ্যে আওয়ামীলীগ প্রায় ১৩ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও পার্বত্য চুক্তির উল্লেখিত ধারাসমূহ বাস্তবায়নে যেমনি সরকারের কোন উদ্যোগ বা সদিচ্ছা পরিলক্ষিত হয়নি, তেমনি সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে যথাযথ পুনর্বাসনের উদ্যোগও দৃষ্টিগোচর হয়নি। বরঞ্চ চুক্তি-উত্তর সময় আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেও সেটেলার বাঙালিদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ, জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখল ও বিতাড়নের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রযন্ত্রের ছত্রছায়ায় সেটেলার বাঙালি কর্তৃক জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, আশ্রায়ণ প্রকল্পের নামে সেটেলার বাঙালিদের আবাসন সুবিধা প্রদান, বহিরাগতদেরকে ভোটার তালিকায় তালিকাভুক্তকরণ ও স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলতে দেখা যায়। এ থেকে এটা নিদ্বির্ধায় বলা যায় যে, সেটেলার বাঙালিদের সমতল অঞ্চলে পুনর্বাসন তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের মূল স্পিরিট থেকে বর্তমাস সরকার সরে গিয়েছে। বিপরীতক্রমে ‘সমতল থেকে মানুষ এনে পার্বত্যাঞ্চলের দ্বন্দ্ব-সংঘাত জটিল করার’ পূর্ববর্তী সরকারের অনুসৃত নীতি বর্তমান সরকারও কার্যত গ্রহণ করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো ডেমোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে উপনিবেশিক কায়দায় সমাধানের পথ গ্রহণ করে চলেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে অথর্ব রেখে, সেনা শাসন ও দমন-পীড়ন জারি রেখে, জুম্ম জনগোষ্ঠীকে তাদের স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ ও বিতাড়ন অব্যাহত রেখে, সর্বোপরি চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী নীলনকশা জারি রেখে কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হোক না কেন তা কখনোই পার্বত্য অঞ্চলে স্থায়ীত্বশীল শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারবে না তা বর্তমান সরকারকে গভীরভাবে বুঝতে হবে। ‘রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার’ কোন বিকল্প নেই। একটি রাজনৈতিক সমস্যাকে রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে ফ্যাসীবাদী কায়দায় যতই সামরিক উপায়ে বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে কিংবা ডেমোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান হতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্যেই এই সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান নিহিত রয়েছে তা সরকারকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে।

মঙ্গল কুমার চাকমা; তথ্য ও প্রচার সম্পাদক; জনসংহতি সমিতি

Back to top button