পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও রাষ্ট্রপতির বক্তব্য- শক্তিপদ ত্রিপুরা
মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ মহোদয়কে অশেষ ধন্যবাদ এ কারণে যে, গত ৭ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে জাতীয় সংসদে প্রদত্ত তাঁর বক্তব্যে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেছেন। তবে তাঁর বক্তব্যে চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি প্রাধান্য না পেয়ে উন্নয়নের ফিরিস্তিই প্রাধান্য পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে তিনি যা কিছু বলেছেন তাও বস্তুনিষ্ঠ নয়। সরকারের মন্ত্রী-তন্ত্রীর কাছে আমরা বস্তুনিষ্ঠ বক্তব্য প্রত্যাশা করি না। কিন্তু একটি দেশের রাষ্ট্রপতির কাছে বস্তুনিষ্ঠ বক্তব্য প্রত্যাশা করতেই পারি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্য এবং দেশবাসীর কাছে সঠিক, বস্তুনিষ্ঠ ও যথাযথ চিত্র তুলে ধরবেন এবং চুক্তি বাস্তবায়ন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলকে এক বাস্তবসম্মত দিক নির্দেশনা প্রদান করবেন- তা সকলেরই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, মহামান্য রাষ্ট্রতির বক্তব্যে আমরা সেটি সর্বাংশে দেখতে পাইনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রত্যাশা সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ দ্রুত বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে যা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। অপরদিকে উন্নয়ন নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অভিজ্ঞতা ভাল নয়। জুম্ম জনগণ পাকিস্তান আমলের উন্নয়ন দেখেছে। পাকিস্তান সরকারের আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে ১৯৬০ সালে কর্ণফুলি নদীর উপর কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে ৫৪ হাজার একর ১ম শ্রেণির জমিসহ লক্ষাধিক একর জমি জলমগ্ন হয়। এই বাঁধের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে উর্বর জমি জলমগ্ন হওয়ার কারণে জুম্ম জনগণের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়ে। এই বাঁধের কারণে কর্ণফুলি নদীর পার্শ্ববর্তী জনপদের লক্ষাধিক মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল। এসব উদ্বাস্তু মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা এবং মায়ানমার ও ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা ও অরুণাচলে চলে যেতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ আমলের বিভিন্ন সরকারের সময়েও বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম দেখার সুযোগ হচ্ছে। জিয়াউর রহমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে ‘অর্থনৈতিক সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সেখানে রাবার বাগান গড়ে তোলে। জিয়াউর রহমানের আমলে শুরু হলেও পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের আমলেও প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে রাবার বাগান গড়ে তোলার কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।
বৃটিশ আমল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের কার্যক্রম শুরু হয়। বৃটিশ সরকার সেগুন বাগান গড়ে তোলার জন্য হাজার হাজার একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করেছিল। এ কার্যক্রম পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের আমলেও অব্যাহত রয়েছে। সরকার নূতন করে আরো ২ লক্ষ ১৮ হাজার একর রিজার্ভ ফরেস্ট করার জন্য জমি অধিগ্রহণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি মৌজায় ২০ ধারা জারি হয়ে গেছে। এসব মৌজায় রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণার কার্যক্রম সম্পন্ন হলে সেসব জায়গায় সরকারের পক্ষে বন বিভাগ প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সেগুনের বাগান গড়ে তুলবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতোমধ্যে লক্ষ লক্ষ একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সেগুন ও রাবার বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। এসব সেগুন ও রাবার বাগান করা হচ্ছে সরকারের বন বিভাগ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা বা কোম্পানীর মালিকেরাও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও চুক্তির আলোকে প্রণীত আইন লংঘন করে অবৈধভাবে ভূমি লীজ নিয়ে হাজার হাজার একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে এবং জুম্মদের জুমভূমি ও মৌজাভূমি দখল করে রাবার বাগান গড়ে তুলছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হবার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করার কারণে ২০১৭ সালের ১৩ জুন রাঙ্গামাটি শহরসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক আকারে ভূমিধস হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ব্যাপক ভূমি ধসের কারণে রাঙ্গামাটি শহরসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে শতাধিক লোক মারা যায় এবং কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়।
বর্তমান সরকারের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রমকে প্রাধান্য না দিয়ে চুক্তির বাইরে যেয়ে তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে যা জুম্ম জনগণ চায় না এবং যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ, সংস্কৃতি ও জনগণের জন্য ক্ষতিকর। সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে লঙ্ঘন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বড় বড় রাস্তা, উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- বিশ^বিদ্যালয় ইত্যাদি করতে চাচ্ছে, যা জুম্ম জনগণ এ মূহুর্তে চায় না।
জুম্ম জনগণ চায়- চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট রাস্তাঘাটসহ সকল প্রকার উন্নয়ন এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার সকল ক্ষমতা হস্তান্তর হোক। শিক্ষা ও সকল ক্ষেত্রে যথাযথ উন্নয়নের জন্য তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে গণপ্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করা হোক। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হোক। বাংলাদেশের সংবিধান, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মূল স্পিরিট ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম একটি স্তম্ভ ‘গণতন্ত্র’ ও গণতান্ত্রিক নীতি। সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি লংঘন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে নির্বাচন না দিয়ে মনোনীত ব্যক্তিদের দিয়ে সরকার তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ পরিচালনা করছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে বর্তমান (২০১৮) অবধি এই তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সরকার এই ৪টি প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তৎকারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই ৪টি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে পরিচালিত হতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এই ৪টি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অতীব জরুরী। মহামান্য রাষ্ট্রপতি এসব বিষয়ে কিছুই বলেননি এবং সরকার ও প্রশাসনকে এবিষয়ে কোন দিক নির্দেশনা প্রদান করেননি।
জুম্ম জনগণ চায়- জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী পরিষদই পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করুক। জুম্ম জনগণ চায়- আগে প্রাইমারী, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার শক্ত বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠা পাক, তারপর প্রতিষ্ঠা করা হোক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। নইলে এই উন্নয়নের সুফল জুম্ম জনগণ পাবে না; বরং তা জুম্ম জনগণের জন্য ‘কাপ্তাই বাঁধ’- এর মত আরেক মরণ ফাঁদ হয়ে দেখা দেবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেখানে সমস্ত আদিবাসী গ্রামে সরকারি প্রাইমারী স্কুল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি, যেখানে বেশির ভাগ সরকারি প্রাইমারী স্কুল অচল কিংবা মানসম্মত শিক্ষা দানে সম্ভব হয়ে উঠেনি, যেখানে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ নানাবিধ সংকট, এমনকি সরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, সেখানে রাঙ্গামাটিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা ‘গাছের গোড়ায় পানি না দিয়ে আগায় পানি দেওয়ার’ সামিল।
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে এই অ লে বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেছে। সরকারকে তার আইন এবং আইনের আলোকে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিক সহকারে এগিয়ে আসতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা উন্নয়ন, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিল্প, সংস্কৃতি উন্নয়ন ইত্যাদি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের বিষয়। এসব উন্নয়ন বিষয়ে কি করা হবে, না হবে তা এসব প্রতিষ্ঠানই ঠিক করবে। এক্ষেত্রে জাতীয় সরকার কর্তৃক হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ নেই যদি সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং চুক্তির আলোকে প্রণীত আইন ও নীতিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, সরকার এসব আইন, নীতি ও মানবিক মূল্যবোধকে ভূলুন্ঠিত করে আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের মতামতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে। জুম্ম জনগণ যেটি চায় না, যেটি পার্বত্য চট্টগ্রামের অগ্রাধিকার বিষয় নয় এবং যেটি চুক্তির অন্তুর্ভুক্ত বিষয়ও নয়, সেটিকে সরকার অগ্রাধিকার প্রদানের ভিত্তিতে জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠা করতে যাবে কেন? তাহলে এখানে কি সরকারের খারাপ উদ্দেশ্য কাজ করছে? এটিও কি সরকার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার ষড়যন্ত্রের অংশ, যা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী শুরু করেছিল? সরকারের এসব কার্যক্রমের কারণে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ধ্বংসের আশংকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জুম্ম জনগণ চায় সর্বাগ্রে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন, তারপর অন্যান্য বিষয়- সেটি শিক্ষা বা আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কিংবা অবকাঠামোগত বা অন্য যে কোন ক্ষেত্রে হোক না কেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জরুরী বিষয় হল- তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করার বিষয়। জুম্ম জনগণ নিশ্চিত হতে চায়- তারা তাদের স্বশাসন, নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মর্যাদা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। এলক্ষে তাদের জন্য দরকার কতিপয় সুরক্ষামূলক আইন ও অধিকার। জুম্ম জাতিসমূহের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জুম্ম জনগণ সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল। এই সংগ্রামের একটি পর্যায়ে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল- যার লক্ষ্য ছিল জুম্ম জনগণসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের জন্য সুরক্ষামূলক কতিপয় আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতিসমূহ স্বকীয় সংস্কৃতি ও মর্যাদা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিতে বসবাস করতে পারে। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে জুম্ম জনগণ আশংকার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। তারা অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে। কারণ চুক্তি সম্পাদনের পরও জুম্ম জনগণের ভূমি বেদখল হচ্ছে, নিপীড়ন-নির্যাতন ও নারী ধর্ষণ ঘটছে এবং অব্যাহতভাবে বহিরাগত অনুপ্রবেশ ঘটছে, জুম্মদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হচ্ছে। জুম্ম জনগণের ওপর এসব কার্যক্রমের কারণে এবং এসব ক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব ধ্বংসের আশংকা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা। আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ হাসিনা কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের দ্বার খুলে যায়। উল্লেখ্য যে, এরশাদ সরকারের আমল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের লক্ষে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যেকার সংলাপ শুরু হয়। খালেদা জিয়া সরকারের আমলেও সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যেকার সংলাপ অব্যাহত ছিল। কিন্তু এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হতে পারেনি। কারণ এই দু’টি সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান করার জন্য আন্তরিক সহকারে এগিয়ে আসতে পারেনি।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ সরকার গঠিত হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবার পর শেখ হাসিনা সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির মধ্যেকার সংলাপ শুরু হয়। ৭ বার বৈঠকের পর শেখ হাসিনা সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির মধ্যেকার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের ২০টি বছর অতিবাহিত হল তথাপি চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত হতে পারেনি। গত ৭ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে জাতীয় সংসদে প্রদত্ত মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্য বস্তুনিষ্ঠ হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে যে বিবরণ প্রদান করা হয়ে আসছে, সেটিই মাননীয় রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদে তুলে ধরেছেন। চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রকৃত চিত্র হল- পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়াদি আজ অবধি বাস্তবায়ন করা হয়নি, যা জুম্ম জাতিসমূহের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি ও জুম্ম জনগণের ভূমি ফেরত পাওয়া, সেনা কর্তৃত্ব ও অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, পুলিশ (স্থানীয়) ও আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ সকল বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব, কর্তব্য ও ক্ষমতা পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আ লিক পরিষদে হস্তান্তর, সেটেলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে সরকারের তৈরিকৃত বক্তব্যটিই হুবহু তুলে ধরেছেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেছেন- “চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ, ১৫টি ধারা আংশিক অবশিষ্ট ৯টি ধারার বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫ ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। এখনো চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা বাস্তবায়িত হয়নি এবং যেসব ধারাসমূহ মৌলিক ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেসব ধারাসমূহ অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর বক্তব্যের শেষ অংশে ভূমি কমিশনের ওপর দু’ লাইন কথা বলেছেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন- “ভূমি কমিশন আইন-২০০১ সংশোধন করা হয়েছে। কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।” আমরা জানি ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অপরদিকে ভূমি কমিশন আইন প্রণীত হয় ২০০১ সালে, যে আইনে চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক বহু ধারা ছিল। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে এই আইন সংশোধন করে চুক্তির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ করা হয়। একটি আইন প্রণয়ন করতে যদি ১৬ বছর সময় লাগে তাহলে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য চুক্তির আলোকে অপরাপর প্রয়োজনীয় সমস্ত আইন প্রণয়ন করতে কিংবা চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য সকল আইন সংশোধন করতে আর কত বছর সময় লাগতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য চুক্তির আলোকে বহু নতুন আইন প্রণয়ন অথবা বিদ্যমান আইনসমূহের সংশোধনের বিষয় রয়ে গেছে। এসব আইন প্রণয়ন কিংবা সংশোধন ব্যতীত চুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন হতে পারে না। সাধারণত যে কোন চুক্তির পর পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল- আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন। সরকার এখনো চুক্তির আলোকে সমস্ত আইন প্রণয়ন বা কার্যরত আইনসমূহের সংশোধন করতে পারেনি। আ লিক পরিষদের বিধিমালা অদ্যাবধি প্রণীত হতে পারেনি।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আ ঞ্চলিক পরিষদ আইন প্রণীত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। সাধারণ নিয়ম হল- আইন প্রণীত হবার পর ৬ মাসের মধ্যে বিধিমালা প্রণয়ন করা। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন- ২০০১ এর বিধিমালাও ৬ মাসের মধ্যে প্রণয়নের কথা ছিল। আইনে তা সুস্পষ্ট করে উল্লেখ করা ছিল। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, ১৯ বছর পার হবার পরও ভূমি কমিশনের বিধিমালা আজ অবধি প্রণীত হতে পারেনি। সংশোধিত ভূমি কমিশন আইনে বলা হয়েছিল- যথাশীঘ্র সম্ভব দ্রুততার ভিত্তিতে বিধিমালা প্রণয়ন করা হবে। কিন্তু সরকার অদ্যাবধি ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারেনি বা করেনি। সরকার তার প্রয়োজনে কোন কোন আইন এক সপ্তাহের মধ্যে প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করেছে। তাহলে চুক্তির আলোকে আইন প্রণয়নে এত দীর্ঘসূত্রিতা কেন? পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার কতটুকু আন্তরিক এসব কার্যকলাপে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি চুক্তি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বক্তব্যের শেষ অংশে বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করা হবে। তিনি বলেছেন, “তিন পার্বত্য জেলার ভূ-প্রাকৃতিক অক্ষুন্ন রাখা, বনাঞ্চল, নদী, জলাশয়, প্রাণী সম্পদ এবং গিরিশৃঙ্গগুলোর সৌন্দর্য সংরক্ষণ করা হবে।” কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেটি চুক্তির ক খন্ডের ১ নং ধারায় বলা হয়েছে- “উভয়পক্ষ (সরকার ও জনসংহতি সমিতি) পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসাবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন।” এই ‘উপজাতীয় বা জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের কথা’ মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে উঠে আসেনি।
আমরা যখন হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল বলব তখন এর অর্থ দাঁড়ায়- সেই অঞ্চলটি হিন্দু সংখ্যা বেশি এবং যখন মুসলামান অধ্যুষিত অঞ্চল বলব তখন এর অর্থ দাঁড়ায় সেই অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যা বেশি। সুতরাং আমরা যখন উপজাতি কিংবা জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চল বলব তখন এর অর্থ দাঁড়ায়- সেই অঞ্চলটি জুম্মদের জনসংখ্যা বেশি আর যখন এর বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়, তখন এর অর্থ দাঁড়ায়- পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি বা জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে অক্ষুন্ন রাখা। সুতরাং জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিষয়টি শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-প্রকৃতি ও এর সৌন্দর্য সংরক্ষণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এখানে মূলত: জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে অক্ষুন্ন রাখার বিষয়টিই বলা হয়েছে। আজকে কথা ও কাজ-এর পার্থক্য দেখার কারণে সরকারের প্রতি জুম্ম জনগণের আস্থা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতীয় বা জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য রক্ষার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন অপরদিকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নীতি অনুসরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার হীনউদ্দেশ্যে বহিরাগত অভিবাসনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে। উন্নয়ন পরিকল্পনাসহ সরকারি সকল কার্যক্রমে তা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে।
সবশেষে মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্য বিষয়ে আরেকটি কথা বলে আলোচনা শেষ করতে চাই। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মহান জাতীয় সংসদে যে বক্তব্যটি উপস্থাপন করেছেন তা রাষ্ট্রপতির একার বিষয় নয়। সাধারণত যারা মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্য তৈরি করেন এর দায় তাঁদের ওপর বেশি বর্তায়। যাঁরা বক্তব্যটি তৈরি করেছেন তাঁরা বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করেননি অথবা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন। রাষ্টপতি যিনি তিনি রাষ্ট্রের প্রধান। রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেশ, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলের অধিকার রাষ্ট্রে যথাযথভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে কি না তা দেখা এবং যদি কোন নাগরিকের প্রতি, এমনকি কোন জাতি বা ধর্মাবলম্বীর প্রতি অন্যায় অবিচার করা হয় প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং রাষ্ট্রের সংহতির জন্য দেশের সকল নাগরিক যাতে যথাযথভাবে অধিকার ভোগ করে তা সংশ্লিষ্ট সকলকে দিক নির্দেশনা প্রদান করা। আমাদের প্রত্যাশা থাকলো- আগামী দিনের বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতিসমূহের অস্তিত্ব রক্ষা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সরকার, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ এবং সংসদ সদস্যদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মহান জাতীয় সংসদে চুক্তি বাস্তবায়নের ওপর বস্তুনিষ্ঠ বক্তব্য তুলে ধরবেন এবং চুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী বাস্তবায়নে দিক নির্দেশনা প্রদান করবেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ দ্রুত বাস্তবায়নে মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে তুলে ধরবেন।
শক্তিপদ ত্রিপুরা; সাংগঠনিক সম্পাদক; পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি