মতামত ও বিশ্লেষণ

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন হোক জাতীয় অঙ্গীকার : জাতীয় নাগরিক উদ্যোগ

সম্মানিত সুধী

জাতীয় নাগরিক উদ্যোগের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা নিবেন। আজ ২রা ডিসেম্বর ২০১৯। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র আজ ২২তম বর্ষপূর্তি। আপনারা সবাই জানেন- পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা। এ সমস্যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ দুই যুগেরও অধিক একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পরিবেশ বজায় ছিল। স্বকীয় সংস্কৃতি ও জাতীয়তা, ঐতিহাসিক শাসন পদ্ধতি, জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের মর্যাদা ও স্বকীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা, স্মরণাতীতকাল থেকে প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও জাতিগত ঐকতানকে শাসকগোষ্ঠীর ক্রমাগত অস্বীকৃতির ও ষড়যন্ত্রের ফলে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। ঐতিহাসিক এ সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাহাড়ে সবাই আশাবাদী হয়েছিল যে- বহু কাঙ্খিত এই রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসবে। কিন্তু যে সরকার ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করে পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থার আশ্বাস ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে সে একই দলের সরকার কর্তৃক চুক্তিকে কথায় ও কাজে পদদলিত করা হচ্ছে। বর্তমান সরকার তাদের শাসনামলে পূর্বসূরীদের মত চুক্তিকে অবাস্তবায়িত অবস্থায় ফেলে রেখে বরং চুক্তিবিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী নানা কৌশল ও কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর সেই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অবসানের একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। সবার মনে একটা আশাবাদ সঞ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু ২২ বছরেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় এবং সাম্প্রতিক সময়ে জুম্মদের উপর ব্যাপকহারে দমন-পীড়ণ, জুলুম, নির্যাতন, ধরপাকড়, অত্যাচার ও মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আবারও নতুন করে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এ পরিস্থিতির জন্য সর্বাগ্রে সরকারই দায়ী কারণ চুক্তি বাস্তবায়নে তাদের গড়িমসি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাববোধ এবং কখনো কখনো চুক্তিকে নিয়ে তালবাহানা, ষড়যন্ত্র ও সময়ক্ষেপন নীতি বর্তমান পরিস্থিতিকে অবধারিতভাবে উসকে দিয়েছে। জুম্ম জনগন যারপরনাই হতাশ ও বিক্ষুব্দ। নাগরিক সমাজও হতবাক ও উদ্বিগ্ন।

শুরু থেকেই একটি উগ্র মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এ চুক্তির বিরোধীতা করে আসছে। সরকারের একটি অংশসহ সামরিক-বেসামরিক আমলাও এ চুক্তি বাস্তবায়নে ক্রমাগত বাধাদান করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের অবস্থান সবসময় চুক্তিবিরোধী। চুক্তি যাতে বাস্তবায়িত না হতে পারে সেজন্য তারা নানাভাবে তৎপর। এমতাবস্থায়, নিরাপত্তার অজুহাতে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে নিরিহ জুম্মদের গ্রেফতার, বাড়ী-ঘর তল্লাশী, ধরপাকড়, ক্রসফায়ার দিয়ে জুম্মদেরকে আতঙ্কগ্রস্ত করে দমিয়ে রাখার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এখানে অধিকারকর্মীদের বেশি লক্ষ্য করা হচ্ছে এবং চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে যারা কাজ করছেন তাদেরকে বেশি টার্গেটে পরিণত করা হচ্ছে। অর্থাৎ চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে দুর্বল করা বা চুক্তি বাস্তবায়ন না করা। স্বার্থান্বেষী মহল চুক্তি বাস্তবায়ন হোক তা কখনোই চায় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শাসকগোষ্ঠীর প্রধানতম লক্ষ্য হচ্ছে জুম্মদেরকে ভাগ কর, শাসন কর এবং ধ্বংস কর। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতৃত্বসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ মদদ ও যোগসাজশে কখনো কখনো স্থানীয়ভাবে ‘মগ লিবারেশন পার্টি’ নামে পরিচয়দানকারী এএলপি নামক বিদেশী সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং সংস্কারপন্থী খ্যাত তাঁবেদার সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদ দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, সংঘাত, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। আর সেনাসমর্থিত এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো দ্বারা সংঘটিত ঘটনাকে দোহাই দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে যুক্ত অধিকারকর্মীদের ও নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর নির্বিচারে তল্লাসী, মিথ্যা মামলা দায়ের, অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন, গ্রেফতার, হত্যাসহ ফ্যাসীবাদী কায়দায় দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রেস মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়া ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যমও শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনের সরবরাহকৃত বিকৃত ও সাজানো তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ পরিবেশন করে গোয়েবলসীয় কায়দায় সত্যকে দামাচাপা দিয়ে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে যার চুড়ান্ত লক্ষ্য পরিস্থিতিকে ঘোলাতে বানিয়ে নিজেদের শাসন দৃঢ় করা বা চুক্তি বাস্তবায়নে গড়িমসি করা। এহেন পরিস্থিতিতে চুক্তি বাস্তবায়ন সুদূর পরাহত।

সংগ্রামী সুধী
বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার যথাযথ সমাধানের কোন বিকল্প হতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে। চুক্তি মোতাবেক বিশেষ শাসন ব্যবস্থা এবং আদিবাসী জুম্ম জনগনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকার প্রদানের অঙ্গীকার যথাযথ ও পূর্ণ বাস্তবায়নের উপর পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি নির্ভর করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। এটি একটি রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাত ছিল যেখানে একদিকে অনেক জুম্ম তাদের সম্ভাবনাময়ী জীবন দান করেছিলেন অন্যদিকে বহু দেশপ্রেমিক সেনাও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। এ সংঘাতে লক্ষ-কোটি টাকা ও সম্পদের ক্ষতিসাধন হয়েছে। পাহাড়ী ও বাঙালি উভয়েই অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছে। অবিসংবাদিত নেতা ও সাবেক সাংসদ এমএন লারমার দাবি ও প্রস্তাব মোতাবেক পাহাড়ের সমস্যাকে সমাধান করা হলে আজকের মত অপূরনীয় ক্ষতি ও অসহ্য যন্ত্রনা ভোগ করতে হতো না। প্রায় আড়াই দশকের অধিক সশস্ত্র সংঘাতের পর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে শান্তির বাতাবরন তৈরি হয় এবং এটির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুলে দেয়। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের ২২ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় সকলের সামনে একটি প্রধান জিজ্ঞাসা এসে দাঁড়িয়েছে যে, আমরা দেশবাসী, সরকার, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনী, জাতীয় ও আ লিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নীতি নির্ধারক, সুশীল সমাজ, জুম্ম জনগন সবাই কি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য চুক্তির পথে হাঁটবো নাকি ১৯৭২ সালের মত সেই একই ভুল পথে ধাবিত হবো?

পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীসহ দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল অংশ ও নাগরিক সমাজ ২২ বছর ধরে চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য চরমভাবে ক্ষুব্দ, অসন্তুষ্ট ও হতাশায় নিমজ্জিত। এমতাবস্থায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াচ্ছে যা চুক্তির পূর্বেই বিদ্যমান ছিল। পাহাড়ের বর্তমান অবস্থাকে নানা জন নানাভাবে নানা আঙ্গিকে নিজেদের মতো করে মূল্যায়ন করছেন। এরকম সংকটকালে, একটি প্রভাবশালী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সাথে জড়িত বা সরকারের নৃশংসতার বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করছেন তাদেরকে অপরাধী তকমা দিতে তাদেরকে অবৈধ চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত করে দেশে-বিদেশে প্রচারনা চালাচ্ছে। কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী তাদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য এবং চুক্তি বাস্তবায়নে নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকার জন্য জুম্ম জনগন ও সুশীল সমাজের চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম হিসেবে জোর প্রচারনা চালাচ্ছে। এমতাবস্থায়, পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে এবং জুম্মদেরকে পূর্বাবস্থায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে জিইয়ে না রেখে ; বল প্রয়োগ ব্যতিরিকে যারা সত্যিকারভাবে সমস্যার সর্বোত সমাধান চান, যারা সমস্যার গনতান্ত্রিক সমাধান দেখেন তাদের একমাত্র পরামর্শ হলো- চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণ বাস্তবায়নই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক সমাধান। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণ বাস্তবায়ন একান্তই জরুরী। তাই অতিস্বত্তর দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানকল্পে একটি সময়সূচিভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে চুক্তি বাস্তবায়ন করার জন্য সরকারকে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নই হোক আমাদের সবার জাতীয় অঙ্গীকার।

২ ডিসেম্বর সোমবার জাতীয় নাগরিক উদ্যোগ কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২২ বছর উপলক্ষে ঢাকা থেকে প্রকাশিত।

Back to top button