মতামত ও বিশ্লেষণ

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৯ বছর: বাস্তবায়নে আর কতো দেরী?

আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, আর সে আশায় বুক বেধে ১৯টি বছর কাটিয়ে দিলো পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষগুলো, কিন্ত তাদের আশা পূরণ হয়নি । ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে যে চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল, তখন থেকেই এই মানুষগুলো স্বপ্ন দেখেছিলো একদিন পাহাড়ে শান্তি আসবে, তাদের জীবনে নতুন ভোর হবে। সে স্বপ্ন, সে প্রত্যাশা এখন কেবলই হতাশায় পরিনত হয়েছে। এখনো পাহাড়ে রক্ত ঝড়ে, সাম্প্রদায়িক হানা-হানি হয়, নারী ও শিশুর উপর সহিংসতা হয়, জোর করে জমি দখল, উন্নয়নের নামে ভুমি অধিগ্রহন সহ অবাধে চলছে মানবাধিকার লংঘন। পার্বত্য চুক্তির সময় চুক্তির কোথাও শান্তি কথাটি লেখা না থাকলেও চুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকে এটিকে শান্তি চুক্তি হিসেবে বলতে স্বস্তি বোধ করেন। কিন্তু বাস্তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমরা সত্যিই কি স্বস্তি বোধ করতে পারি? আসলেই কি চুক্তি বাস্তবায়নে আমাদের এতো বছরের সরকার-প্রশাসনে যারা ছিলেন কিংবা আছেন তারা আন্তরিক? যদি সত্যিই তারা আন্তরিক হতেন তাহলে এই চুক্তি বাস্তবায়নে কেন আমাদের এত বছর অপেক্ষা করতে হবে? আর সবচেয়ে বড় হতাশার জায়গাটা হচ্ছে চুক্তির সাক্ষরকারী দল যখন সরকার পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, তখনই তাদের কাছে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য দাবী তুলতে হচ্ছে ! আমরা লক্ষ করছি সরকারেরর পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অনেকগুলো প্রধান ধারা সহ বেশীরভাগই বাস্তবায়ন করেছে , কিংবা আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে কিংবা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিন্তু চুক্তির অন্য পক্ষ অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দেয়া পরিসংখ্যানের সাথে তার মিল খুজে পাওয়া যায়না। উভয় পক্ষের হিসেব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অনেকগুলো ধারা ,বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণচুক্তির মৌলিক অনেক বিষয় এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। চুক্তির কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তার সংখ্যাতিক দিক পরিমাপ না করে এটিকে রাজনৈতিক এবং বিষয়গত তাৎপর্যের আলোকে দেখতে হবে। এইখান থেকে একটি বিষয় প্রতিয়মান যে, চুক্তি বাস্তবায়নের দিক থেকে একটি অসামজ্ঞস্যতা, বিশেষ করে এক পক্ষ আরেক পক্ষের উপর আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। পার্বত্য চুক্তি বিশ্লেষন করলে দেখা যাবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন বিষয় ও কার্যাবলী কার্যকরকরণ এবং এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিতকরণ; আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু ও প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ ও তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমিতে পুনর্বাসন; সেনা শাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার; অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিলকরণ; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকুরীতে জুম্ম জনগনের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়োগ; চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইনসমূহ সংশোধন; সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয়গুলো বাস্তবায়নে সরকারের উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। আর অন্য দিকে এমন কিছু কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে যা মূলত চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক ।
আশার তবে বিষয় হচ্ছে গত ১০ আগস্ট ২০১৬,পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা কমিয়ে আইন সংশোধন করে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করেছে সরকার, যা গত ০৬ অক্টোবর দশম জাতীয় সংসদের দ্বাদশতম অধিবেশনের সমাপনী দিবসে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিল (সংশোধন)-২০১৬’ নামে পাস হয়। আগে কমিশন চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হত। আইন সংশোধন হওয়াই চেয়ারম্যানসহ উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সিদ্ধান্ত কমিশনের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে। চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্তে আর কোনো বিষয় চূড়ান্ত হবে না। তাই এখনই কমিশনকে কার্যকর করতে হবে এবং বিদ্যমান ভূমি সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে। তবে চুক্তির পর পরই দেশী-বিদেশী অনেক দাতা সংস্থা এখানে কিছু উন্নয়নমুলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, যা নি:সন্দেহে অত্র অঞ্চলের আদিবাসী মানুষের শিক্ষা-সাংস্কৃতি, জীবন-জীবিকার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
চুক্তি অনুযায়ী এখন পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি, স্থায়ী বাসিন্দা ভিত্তিতে ভোটার তালিকাও প্রনয়ন করা হয়নি । আর অন্যদিকে গত ২৩ নভেম্বর ২০১৪ জাতীয় সংসদে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন ২০১৪ নামে তিনটি বিল পাশ করা হয়েছে সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও স্থানীয় জনগণের মতামত গ্রহনই করা হয়নি। আমরা দেখেছি,এখন পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় ৩৩টি বিষয়ের মধ্যে ১৭ বিষয় হস্তান্তরিত হয়েছে। এছাড়া কিছু কিছু বিভাগের কর্ম/অফিস হস্তান্তরিত হলেও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ যেমন- জেলার আইন-শৃঙ্খলা তত্ত্বাবধান, সংরক্ষণ ও উহার উন্নতি সাধন; ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা; পুলিশ (স্থানীয়); সরকার কর্তৃক রক্ষিত নয় এই প্রকার বন সম্পদ উন্নয়ন ও সংরক্ষণ; পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন;ইত্যাদি বিষয়সমূহ এখনো হস্তান্তর করা হয়নি। আর যেসব বিষয় বা কর্ম/প্রতিষ্ঠান হস্তান্তরিত হয়েছে সেগুলোও সঠিকভাবে হস্তান্তর করা হয়নি। যেমন- গত ২৮ আগস্ট ২০১৪ পর্যটন (স্থানীয়) বিষয়টি পর্যটন মন্ত্রণালয় ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের মধ্যকার চুক্তির মাধ্যমে হস্তান্তরিত হয়েছে, কিন্তু উক্ত চুক্তিতে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে পার্বত্য জেলা পরিষদের এখতিয়ার সীমিত করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন মন্ত্রণালয়সহ পর্যটন কর্পোরেশন, স্থানীয় সরকারি কর্তৃপক্ষ ও প্রাইভেট সেক্টরের পর্যটন বিষয়গুলো তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতার বাইরে রেখে দেয়া হয়েছে। এছাড়া, সরকার চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সাথে কোনরকম আলোচনা না করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারন প্রশাসন, আইন শৃংখলা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে।
আমরা জানি চুক্তি বাস্তবায়নে অনেক কালক্ষেপন হয়েছে, এমনকি পূর্বেকার সরকারগুলো চুক্তি বাস্তবায়নের কোন সঠিক পরিকল্পনাও উপস্থাপন করতে পারেনি। আবার অনেকেই সরাসরি চুক্তির বিরোধীতা করেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জাতিগত বৈচিত্রপূর্ণ সম্ভাবনাময়ী এই পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষগুলো দীর্ঘদিন তাদের অধিকার, ন্যায্য দাবীর জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছে,তাদের জীবন থেকে চলে গেছে অনেক গুলো সুন্দর মূহুত্ত । আর এই মানুষগুলোর আস্থার জায়গা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। বিষয়টি শুধু একটি বিশেষ অঞ্চলের সমস্যা হিসেবে দেখলে চলবেনা। একটি বিশেষ অংশের মানুষকে দূরে সরিয়ে রেখে সমাগ্রীক উন্নয়ন কোনমতেই সম্ভব নয়। তাই চুক্তি বাস্তবায়নে তাদের প্রতি আমাদের সকলের ভালোবাসা, সমর্থন প্রয়োজন । এরইমধ্যে তাদের পক্ষ থেকে নতুন করে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে। ২৫ বছরের সংঘাত অবসান ঘটিয়ে চুক্তিতে পৌঁছতে দীর্ঘদিন লেগেছিল, তাই আবার নতুন করে সংঘাত কোনমতেই কাম্য নয়। যদিও সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা ও মন্ত্রী বিভিন্ন সময় চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের স্বদিচ্ছার কথা দৃঢ়ভাবে বললেও পাহাড়ী জনগন তা আর আস্থায় নিতে পারছেনা। আর এই আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিযে আনতে হলে সরকারকে এখনই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি রোড ম্যাপের মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরনে এবং পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। ১৯ বছর অনেক সময়, আমরা কেউ চাই না আর অপেক্ষার পালা দীর্ঘ হউক, আমরা সবাই চাই পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসুক।

লেখক: মোহাম্মদ জাহেদ হাসান
উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী

Back to top button