পার্বত্য চট্টগ্রাম ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতিঃ ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো
পার্বত্য চট্টগ্রামঃ
ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি
অধ্যাপক ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো
প্রকাশক
রেগা প্রকাশনী
কলেজ রোড, কল্যাণপুর, রাঙ্গামাটি
মূল্যঃ ৪০০ টাকা
পার্বত্য চট্টগ্রাম কখনো রাজনৈতিকভাবে বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়নি। ১৮৬০ খ্রীস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টি হবার পূর্ব পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর বাংলা প্রদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা কার্যকর ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রামকে সে। সময়ে শাসন বহির্ভুত এলাকা হিসাবে গণ্য করা হতো। Scheduled Districts Act, 1874 পার্বত্য চট্টগ্রামকে scheduled district পরিচিতি দিয়ে আলাদা করে দিয়েছে। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন। পার্বত্য চট্টগ্রামকে পশ্চাদপদ অঞ্চল (backward tract) আখ্যায়িত করে বাংলা প্রদেশ থেকে বহির্ভূত করে। রেখেছে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন। আইন এবং তার অনুসরণে ১৯৪৯ সালে বিধিবদ্ধ The East Bengal Excluded and partially Excluded Areas Laws পার্বত্য চট্টগ্রামকে excluded area’ বলে। উল্লেখ করেছে। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধান পার্বত্য চট্টগ্রামকে ©excluded area বলে ঘোষণা করেছে। ১৯৬২ সালের পাকিস্তান। সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘tribal area’ নামে আখ্যায়িত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসন বহির্ভূত এলাকা বলে ঘোষণা দেওয়ার অর্থই হলো আঞ্চলিক বৈষম্যের সৃষ্টি করা। এই বইটিতে অতীত থেকে বর্তমান। পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস উল্লেখ করা হয়েছে।
ভূমিকা
বেশকয়েক বছর আগেকার কথা। আমার পরম শ্রদ্ধেয় জেঠা মশাই, উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ কালিকা রঞ্জন কানুনগো এর সাথে সমতল চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বল্লেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে স্কটল্যান্ডের ইতিহাস জানা একান্তভাবে আবশক। তার অভিমত শুনে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। কোথায় স্কটল্যান্ড আর কোথায় পার্বত্য চট্টগ্রাম। তার বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে। বিষয়গুলো সংক্ষেপে এরূপ। ১। পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং স্কটল্যান্ড এই উভয় ভূখন্ড পর্বতাকীর্ণ। ভূপৃষ্ঠের শতকরা আশিভাগই পর্বতময়। ২। উভয় অঞ্চল অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনীর দ্বারা বিধৌত। ৩। উভয় অঞ্চলের জনপদসমূহ উচ্চ পর্বত দ্বারা পরিবেষ্টিত। ৪। উভয় অঞ্চল ক্ষুদ্র বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দ্বারা অধ্যুষিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের বলা হয় আদিবাসী, স্কটল্যান্ডের অধিবাসীদের বলা হয় clan। উভয় অঞ্চলের আদিবাসীরা বহিরাগত। স্কটল্যান্ডের অধিবাসীদের পূর্বপুরুষ এসেছিল স্ক্যান্ডিনেভীয় উপদ্বীপ থেকে, আর পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি অধিবাসীরা এসেছিল প্রধানত আরাকান রাজ্য থেকে ।। বাংলাদেশের আদিবাসীদের সম্পর্কে এদেশীয় এবং পাশ্চাত্য পন্ডিতবর্গ প্রচুর। লিখেছেন, এখনও লিখছেন। তাঁদের আলোচনা প্রধানত নৃতত্ব, আদিবাসীদের রীতিনীতি, প্রথা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি। আদিবাসীদের বাঁচিয়ে রাখতে এবং তাদের সংস্কৃতি উজ্জীবিত করতে জাতিসংঘ আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হয়ে উঠেছে। সুখের বিষয়, বিশ্বের অনেক সরকারই জাতিসংঘের প্রচেষ্টার প্রতি সক্রিয় সমর্থন জানিয়েছে। বাংলাদেশে মােটামুটি আশিটি আদিবাসী গােষ্ঠী রয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে | বিশটি আদিবাসী গােষ্ঠী রয়েছে কেবলমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে। প্রকৃতপক্ষে, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামই আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল। পার্বভূমিকা ত্য চট্টগ্রামে যে
এতগুলি আদিবাসী গোষ্ঠী রয়েছে তা বহুদিন অনেকেরই জানা ছিল অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রথম জানতে পারেন ডঃ ফ্রান্সিস বুকানন। তিনি আদিবাসীদের সম্বন্ধে জানবার আগ্রহ নিয়ে সমগ্র পার্ক চট্রগ্রামের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করেন। ১৭৯৮ খ্রীস্টাবে নিহত তাঁর বিবরণীতে ডঃ বুকানন পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্তত দশটি আদিবাসী গোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করেছেন। ইংরেজ শাসনামলের অবসান পর্যন্ত সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী অধ্যষিত অঞ্চল ছিল। ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯৮ ভাগ আদিবাসী ছিল, বাঙালীদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি অভিবাসন শুরু হয় এবং তা ক্রমশ জোরদার হয়। শেষ পর্যন্ত বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে উপজাতি ও অউপজাতীয়দের জনসংখ্যা সমান সমান হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক কালে আদিবাসী ও উপজাতি এ দুটি শব্দের সঠিক প্রয়োগ সম্বন্ধে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে মিঃ জোসে মাটিনেজ কোবো এর ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘের সভায় প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুসরণযোগ্য। তিনি বলেছেন, “আদিবাসী সম্প্রদায়, জনগোষ্ঠী ও জাতি বলতে তাদেরকে বোঝায় যাদের ভূখন্ডে প্রাক-আগ্রাসন এবং প্রাক-উপনিবেশিক কাল থেকে বিকশিত সামাজিক ধরা সহ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে।… মােট কথা আদিবাসী জাতি বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা বহিরাগত কর্তৃক দখল বা বসতি স্থাপনের পূর্ব থেকে নির্দিষ্ট ভূখন্ডের মূল অধিবাসীর বংশধর।” (উ. বাংলাদেশের আদিবাসী, ১ম খন্ড, পৃ. ২৬-২৭)। বাংলাদেশে বসবাসকারী আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভাষা, রীতিনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র । এই স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও সমন্বয়ের একটি ধারাও অজ্ঞাতভাবে চলে আসছে যা উভয় গোষ্ঠীকে পরস্পরের। নিকটে টানে। পার্বত্য চট্টগ্রাম কখনো রাজনৈতিকভাবে বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। ছিল না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়নি। ১৮৬০ খ্রীস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টি হবার পূর্ব পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর বাংলা প্রদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা কার্যকর ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রামকে সে সময়ে শাসন বহির্ভূত এলাকা হিসাবে গণ্য করা হতো।
Gheduled Districts Act, 1874 H Back scheduled
unic পরিচিতি দিয়ে আলাদা করে দিয়েছে । ১৯১৯ সালের ভারত তমন আইন পার্বত্য চলমকে পশ্চাদপদ অঞ্চল (backward tract) আখ্যায়িত করে বাংলা প্রদেশ থেকে বহিভত করে রেখেছে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন এবং তার অনুসরণে ১৯৪৯ সালে বিধিবদ্ধ The East Bengal Excluded and partially Excluded Areas Laws পার্বত্য চট্টগ্রামকে “excluded are” বলে উল্লেখ করেছে। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধান পার্বত্য চট্টগ্রামকে “excluded area” বলে ঘোষণা করেছে। ১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘tribal area’ নামে আখ্যায়িত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসন বহির্ভূত এলাকা বলে ঘোষণা দেওয়ার অর্থই হলো আঞ্চলিক বৈষম্যের সৃষ্টি করা। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জীবন ধারা পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে পরিচালিত হয়। এ সম্বন্ধে একজন পন্ডিত লিখছেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে। আদিবাসী জনগোষ্ঠী ভূসম্পত্তি, প্রাকৃতিক সম্পত্তি, নদনদী, পানি সম্পদ, বনজ সম্পদ ইত্যাদি জীবন ধারণের এসব বস্তু সম্পদ সমষ্টিগত মালিকানায়। বিশ্বাসী। এসব ব্যক্তিগত সম্পত্তিরূপে তারা ধারণা করতে অনিচ্ছুক । একসঙ্গে বসবাস করছে বলে সকলেই এই সব সম্পত্তি সকলের সামগ্রিক ব্যবহার্য বস্তু বলে মনে করে থাকে। আদিবাসী বসতির (পাড়া, গ্রাম) পার্শ্ববর্তী ছরায় মৎস্যাদি আহরণ, জঙ্গলে পশু শিকার ইত্যাদি প্রত্যেকটি কাজে প্রত্যেক জনগোষ্ঠীই সমানভাবে অধিকার ভোগ করে। জঙ্গল হতে বনজ সম্পদ আহরণ ও পশু চারণের অধিকার সব জনগোষ্ঠীরই” । (বাংলাদেশের আদিবাসী, ১ম খন্ড, পৃ. ২৮৪)। প্রকৃতপক্ষে, আদিবাসী জীবনের অর্থই হলো গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন।
বাংলাদেশের আদিবাসীদের সাথে অন্যান্য দেশের আদিবাসীদের পার্থক্য রয়েছে। নিউগিনির আদিবাসী পাপুয়ানরা নরহত্যাকারী এবং নরমাংসভোজী। নরহত্যাই তাদের প্রধান সংস্কৃতি। বোর্নিও দ্বীপের অভ্যন্তরে যারা বাস করে তাদের সাথে বনমানুষের খুব বেশী পার্থক্য নাই। আফ্রিকার নাইজিরিয়াতে একে অপরকে কিভাবে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে। তা’ সংবাদপত্র সূত্রে জানা যায়। এই নরহত্যা তাদের সংস্কৃতির অংশ। বাংলাদেশের আদিবাসীদের জীবনধারা অন্যান্য দেশের আদিবাসীদের জীবনধারা থেকে একেবারেই ভিন্ন। অন্যান্য দেশের আদিবাসীরা যেখানে হত্যা ও লুণ্ঠনকে জীবনযাত্রার অঙ্গ বলে মনে করে, সেখানে বাংলাদেশে আদিবাসীদের জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য হলো অপরের প্রতি সহনশীলতা, সহানুভূতি এবং সহমর্মিতা। জুম চাষে, গৃহ নির্মাণে, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান পালনে তাদের একতাবোধ পরিস্ফুট হয়ে উঠে। হিংসা দ্বেষ তারা। সযত্নে পরিহার করে চলে। আহারে বিহারে, বিপদে আপদে গোষ্ঠীর সবাই পাশে এসে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের আদিবাসীরা যেভাবে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে তার সাথে তাদের সংস্কৃতি অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই জীবনযাত্রা ও। সংস্কৃতি মিলেই গড়ে উঠেছে আদিবাসীদের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এই ঐতিহ্য সমগ্র দেশের পক্ষে একটা সম্পদ। প্রকৃতির সাথে মানুষের যে কিরূপ নিবিড় সম্পর্ক তা আদিবাসীদের জীবনযাত্রা অনুধাবন করলেই বোঝা যায়। আদিবাসীদের জীবনযাত্রা একান্তভাবেই প্রকৃতি নির্ভর। আদিবাসীরা ভূমিকে মাতৃজ্ঞান করে, তারা ধরিত্রীর পূজা করে। প্রকৃতির সমস্ত দ্রব্যকে প্রকৃতির দান বলে তারা মনে করে। এই দানের দ্বারাই প্রকৃতি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূখন্ড আদিবাসী গোষ্ঠী এলাকায় বিভক্ত। প্রকৃতপক্ষে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের অর্থই হলো পার্বত্য গোষ্ঠী সমূহের ইতিহাস। কিন্তু গোষ্ঠী সমূহের ইতিহাস আলোচনা করা সহজ কাজ নয়। গোষ্ঠী সমূহের ইতিহাস কুয়াসাচ্ছন্ন, সঠিক ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করা খুবই কঠিন। এরূপ অবস্থায় গোষ্ঠীবাসীদের জনশ্রুতি এবং আমাদের অনুমানই একমাত্র উপাদান। কিন্তু উভয় উপাদান বিজ্ঞানসম্মত নয়।।
এই গ্রন্থে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছরী এই তিন জেলা যথাক্রমে চাকমা রাজ্য, বোমাং মারমা রাজ্য এবং মঙ মারমা রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য এই যে রাজ্য প্রধান হিসাবে রাজা যখন বর্তমান আছেন তখন তার কর্তৃত্বাধীন ভূখন্ডকে রাজ্য বলতে হবে। হতে পারে রাজাদের অতীত কালের সেরূপ ক্ষমতা আর নেই, কিন্তু এই তিন রাজ্যে এখনও রাজতন্ত্র বর্তমান আছে এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যে তারা রাজকীয়। কার্যাবলী পরিচালনা করেন। এ কারণে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ী জেলা ত্রয়কে রাজ্য হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে রাজ্য ত্রয়ের মর্যাদা বেড়েছে বই কমেনি ।।
একটা কৌতুহলের বিষয় হলো রাজা এবং রাজ্য সম্বন্ধে আদিবাসীদের কোন সস্পষ্ট ধারণা নাই। তাদের গোষ্ঠীপতিই তাদের রাজা। সার্কেল চীফকে রাজা মানতে বলা হলেও রাজার ক্ষমতা ও কার্যাবলী, রাজা কর্তৃক জারীকৃত বিধিবিধান এ সমস্ত বিষয়ে তাদের প্রকৃত ধারণা নাই। সামষ্টিক বলিকানাধীন ভূমিই তাদের কাছে স্বদেশ। এই স্বদেশের প্রতিই তারা। আনুগত্য প্রকাশ করে। গোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয়দের নির্দেশ তারা মান্য করে চলে। আলাদা কোন রাজার প্রযয়োজনীয়তা আছে বলে তারা মনে করে না। চীফ কিংবা রাজাও জোর করে কারোর উপর তার ক্ষমতা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন না। প্রত্যেক আদিবাসী গোষ্ঠী নিজেদের জীবনযাত্রা, ধ্যান ধারণার প্রতি দৃঢ়ভাবে। সংপৃক্ত। এক গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীর কোন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না এবং তাদের নিজস্ব ব্যাপারে অন্যের হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না। নিজ নিজ গোষ্ঠীর। প্রতি আসক্তি গোষ্ঠী জীবনের মূল কথা। অন্য গোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, ব্যবসাবাণিজ্য ইত্যাদি জানবার কোন আগ্রহ তাদের নাই। এর ফলে গোষ্ঠীবাসীদের মধ্যে এক প্রকার কূপমন্ডুকতা দেখা দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজ্যসমূহের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হলো অতীত কাল থেকে রাজ্য মধ্যে বহু আদিবাসী গোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। তিনটি রাজ্যেরই প্রশাসন তাদের রাজ্যে বসবাসকারী আদিবাসীদের প্রতি। সহানুভূতিশীল এবং প্রজাদের পারস্পরিক বিরূপ আচরণ থেকে বিরত থাকবার পরামর্শ দিতেন। এর ফলে তাঁদের রাজ্য মধ্যে কোন সময়ে গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব দেখা দেয় নি। এর একটি ব্যতিক্রম দক্ষিণ চট্টগ্রামের খুমি ও মোদের। মধ্যে সংঘর্ষ। এটা অবশ্য ঘটেছিল উভয় জাতিগোষ্ঠীর আরাকানে বসবাস। কালে। চট্টগ্রামে আগমনের পর তাদের মধ্যে গুরুতর সংঘর্ষের তথ্য পাওয়া। যায় না। একজন আদিবাসী গোষ্ঠীপতির কর্তৃত্বাধীন ভূখন্ডে বহু সংখ্যক। আদিবাসী গোষ্ঠীর সহাবস্থান বিশ্বের ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায় ।
এ প্রসঙ্গে একটি খুব মজার বিষয় হলো উল্লিখিত তিনটি রাজ্যের কোন একটি রাজ্যের শাসকের জাতি গোষ্ঠীর লোকেরা অন্য দুটি রাজ্যের প্রজা হিসাবে। বসবাস করে। এতে কোন জাতি গোষ্ঠীর লোকেরা অবমাননা বোধ করে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো পাশ্চাত্য শাসন পদ্ধতির পাশাপাশি দেশীয় শাসন পদ্ধতির অব্যাহত প্রচলন। ১৯০০ সালের শাসন বিধিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঐতিহ্যগত রাজা হেডম্যান কারবারি।
এই তিন স্তর বিশিষ্ট প্রশাসনকে শুধু স্বীকৃতি নয়, তার কার্যকারিতাকে রূপদান করা হয়। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ দেশীয় রাজ্য তিনটিকে প্রথমে সাবডিভিশন ও পরে জেলায় রূপান্তরিত করে। আবার রাজ্য প্রথা অব্যাহত রাখতে রাজ্যগুলিকে রাজ্যের স্থানে সাকেল নামে পরিবর্তিত করা হয়। এই দু’ প্রকারের শাসন ব্যবস্থার প্রচলন প্রশাসনে কোন জটিলতা দেখা দেয়নি। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ এবং দেশীয় কর্তৃপক্ষ উভয়েই নিজ নিজ আওতাধীন কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতেন। এটাকে এক প্রকারের দ্বৈত শাসন। (dual government) বলা যেতে পারে। জেলাতেই হোক কিংবা সার্কেলেই হোক পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যেকটি ভূখন্ডেই প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর লোক বসবাস করে। এর ফলে প্রতিটি ভূখন্ড বহু গোষ্ঠী অধ্যুষিত ভূখন্ডে (multi tribal system) পরিণত হয়। জাতি গোষ্ঠী সমূহ তাদের ইচ্ছানুযায়ী যে কোন ভূখন্ডে বসবাস করতে পারে, কেউই তাদের বাধা দিতে পারে না। সৎ প্রতিবেশী সুলভ আচরণের দ্বারা তারা একে অপরের সহানুভূতি ও সহমর্মিতা অর্জন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি জাতি গোষ্ঠীর নিজেদের ভাষা সামাজিক প্রথা ও সংস্কৃতি রয়েছে। একত্রে বসবাস করার ফলে জাতি সমূহের মধ্যে সাংস্কৃতিক ভাবধারার আদান প্রদান চলতে থাকে। এর ফলে আধিবাসীদের মধ্যে বহু। জাতিভিত্তিক সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের (multi cultural system) উদ্ভব। ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের এটি একটি অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য। প্রথাগত প্রশাসন পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য। চিরাচরিত প্রথা ও ইংরেজ প্রশাসকদের প্রণীত ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সার্কেল চীফ, হেডম্যান ও কারবারি এই তিন স্তরের বিচারালয়ে আদিবাসী সমাজের বিরােধ সমূহ। নিষ্পন্ন হয়। এরূপ ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক এবং সর্বজনগ্রাহ্য ব্যবস্থা। এরূপ ব্যবস্থা শাসক ও শাসিতদের পরস্পরের ব্যবধান হ্রাস করে এবং । সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটায়।
একথা অস্বীকার করবার উপায় নাই যে পাহাড়ী অঞ্চলের অধিবাসী আদিবাসীরাই দেশের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠী। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা খুবই পাশ্চাদপদ। এর প্রধান কারণ তাদের প্রতি সরকারের চরম উদাসীনতা। দীর্ঘকাল ধরে শোষণের ফলে আদিবাসীরা একরূপ নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। সমতল বাসীদের আগ্রাসন এবং সম্পদ
লণ্ঠনকে প্রতিরোধ করার মত ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলেছে। আদিবাসীরা তাদের নিজস্ব জমি জমা ক্রমাগত হারাতে থাকায় তাদের দারিদ্র্য ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে তাদের একটি বিরাট অংশ দারিদ্র্যের নিচে বাস করে। প্রায় দুর্ভিক্ষের মত অবস্থায় তারা দিনাতিপাত করে। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী হয়েও তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দুঃখজনক। পার্বত্যবাসীদের কিছু চারিত্রিক গুণাবলী আমাদের আকৃষ্ট করে। তাদের। সহজ সরল জীবনযাত্রা কেবলমাত্র তাদের মধ্যেই স্বাভাবিক। পার্বত্যবাসীদের মধ্যে স্বার্থপরতা নাই, অপরকে প্রতারণা করবার কুমলবও তাদের নাই। জুম চাষ তাদের মধ্যে একতা ও সহমর্মিতা বোধ জাগ্রত করে। একজন চাষ করলে অন্য কেউ সে জমি দখল করতে যায় না। সুতরাং জমির অধিকার নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে কোন বিরোধ নাই।। প্রত্যেক গোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের প্রতিবেশীদের প্রয়োজনে কায়িক শ্রম দিয়ে। সাহায্য করে। প্রায় বিশটি আদিবাসী জাতি এবং তারও অনেক বেশি। তাদের শাখা গোষ্ঠী অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করে না। প্রত্যেক গোষ্ঠীর প্রত্যেক সদস্য নিজের গোষ্ঠীর প্রতি প্রবলভাবে আসক্ত। এ থেকে গোষ্ঠী বাসীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায়। এই ভ্রাতৃত্ববোধের মধ্যেই তাদের জীবনধারা চলতে থাকে। সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’, এটাই হলো আদিবাসী সমাজের মূল নীতি। ভারতের বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক মিনু মাসানি তার বিখ্যাত গ্রন্থ Our Growing Human Family তে খুব চমৎকার করে আদিবাসীদের সম্পর্কে লিখছেন, “Each for all is the golden rule of a tribal society” পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সম্পর্কে জ্ঞান আহরণের পথিকৃৎ হলেন। ইউরোপীয় পন্ডিতবর্গ। তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য হলেন ডঃ ফ্রান্সিস বুকানন (Dr. Francis Buchanan)। ১৭৬২ সালে স্কটল্যান্ডের অন্তর্গত। স্টারলিং শায়ারে তার জন্ম। অসাধারণ মেধার অধিকারী বুকানন মাত্র। সতেরো বৎসর বয়সে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। অতঃপর তিনি চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য এডিনবার্গ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৭৮৩ সালে মাত্র একুশ বৎসর বয়সে এম.ডি. ডিগ্রী লাভ করেন। ১৭৯৪ সালে তিনি ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসে।
যোগদান করেন। এই সূত্রে তিনি চট্টগ্রাম আগমন করেন এবং চট্টগ্রামে উদ্ভিদ ও প্রাণী জগৎ সম্বন্ধে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৭৯৮ সালে তিনি পুনরায় চট্টগ্রাম আগমন করেন। অকল্পনীয় পরিশ্রম করে তিনি সমতল চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় সমস্ত এলাকা ভ্রমণ করে একটি বিবরণী লিখে গেছেন। নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক এবং অর্থনীতির আলােচনার ক্ষেত্রে। এটিই পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম এবং সর্বাধিক মূল্যবান বিবরণী হিসাবে স্বীকৃত। বুকাননের বিবরণী সমূহ বাংলার ইতিহাস বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার সামাজিক ইতিহাস আলােচনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত মূল্যবান বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মানবতাবাদী ও উদার হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন।
ক্যাপ্টেন টি.এইচ.লে উইন (Captain Thomas Herbert Lewin) পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম জেলা প্রশাসক ছিলেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং এর অধিবাসীদের অত্যন্ত ভালবাসতেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বত্র ভ্রমণ করেছিলেন এবং এর অভিজ্ঞতার আলােকে The Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers therein, A fly on the wheel, Wild Races of South Eastern India গ্রন্থ তিনটি রচনা করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তিনি তাঁর গ্রন্থ সমূহে আলােচনা করেছেন। গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তিনি লিখছেন, “এই সরল এবং আদিম জাতিগুলোর ব্যক্তিগত জীবনের সাথে আমার পাঠকদের পরিচয়। করিয়ে দেওয়ার জন্যই আমার এই প্রয়াস”। (ভূমিকা, বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের আদিম জনগোষ্ঠী) নিঃসন্দেহে ক্যাপ্টেন লে উইনের প্রয়াস। সর্বাংশে সফল হয়েছে । স্যার ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার (Sir Willium Wilson Hunter) ১৮৪০ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গ্লাসগো, প্যারিস এবং বন বিশ্ববিদ্যালয়ে। অধ্যয়ন করেন। অধ্যয়ন শেষে রাজকার্যের উচ্চপদ নিয়ে ভারতে আসেন। তিনি বাংলা সরকারের নির্দেশে বহু খন্ডে বিভক্ত এ স্টটিস্টিকেল একাউন্ট অব বেঙ্গল’ প্রণয়ন করেন। এই গ্রন্থের ষষ্ঠ খন্ডে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল্যবান বিবরণী সংকলিত হয়ে ১৮৭৬ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
এ ছাড়া তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেন। অসাধারণ পান্ডিত্যের জন্য মিঃ হান্টার। | রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য মনোনীত হন। তিনি বাংলা ভাষা ও
সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাকে বিশিষ্ট সদস্যপদ দানে সম্মানিত করেন । মিঃ আর. এইচ স্নেড হাচিনসন (Mr. R. H. Sneyd Hutchinson) অধ্যয়ন শেষে ভারতীয় পুলিশ বিভাগে যোগদান করেন। ১৮৯৪ সালের ১৫ই জুন থেকে ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের এ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার এবং ১৯০১ সালের ১০ই অক্টোবর থেকে ১৯০৫ সালের ১৮ই মে পর্যন্ত এই জেলার সুপারিন্টেডেন্ট ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্মরত থাকা। কালে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক ‘গেজেটিয়ার অব দি চিটাগং হিল। কাকটস (১৯০৯ সালে প্রকাশিত) রচনা করেন। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বিভিন্ন প্রকারের তথ্য সমৃদ্ধ এই গ্রন্থটি অত্যন্ত মূল্যবান ও প্রামাণ্য রচনা হিসাবে । বিবেচিত। দেশীয় পান্ডিতদের মধ্যে যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্বন্ধে পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য ছিলেন শ্রী সতীশ চন্দ্রঘোষ। তিনি রাঙামাটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতার অবসরে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর মূল্যবান ও প্রামাণিক গ্রন্থ রচনায় প্রবৃত্ত হন। তাঁর রচিত ‘চাকমা জাতি একটি তথ্য সমৃদ্ধ বৃহদাকারের গ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর দেশী বিদেশী সংবাদপত্রে উচ্চ প্রশংসিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি মালিকানা, কৃষিকাজ, বন সংরক্ষণ ইত্যাদি সম্পর্কে গবেষণামূলক আলোচনা করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় তার লিখিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধাদিতে। তাঁর আলোচনা সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করছে। উপরোক্ত পন্ডিতগণ ছাড়া আরও অনেক বিদ্বজ্জন পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃতত্ব, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ইত্যাদির উপর আলোকপাত করে রচনা প্রকাশ করেছেন। বর্তমান গ্রন্থের শেষের দিকে সন্নিবিষ্ট গ্রন্থপঞ্জীতে তাদের কয়েকজনের নামোল্লেখ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ের সাথে জুম শব্দটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। জুম শব্দের বাংলা অর্থ হলাে পাহাড়। পাহাড় না থাকলে বৃষ্টি হতো না, বৃষ্টি না হলে জুম চাষ হতো না, নদী কিংবা ছরার সৃষ্টি হতো না। নদী কিংবা ছরা না থাকলে জল পাওয়া যেত না, আর জল।
ছাড়া প্রাণী বাঁচতে পারে না। এমন অতি প্রয়োজনীয় শব্দটি শুদ্ধভাবে কেউ বানানও করতে পারে না, উচ্চারণও করতে পারে না। জুম শব্দটি মোঙ্গোলীয় শব্দ। পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে শব্দটির প্রচলন আছে। শব্দটির শুদ্ধ বানান হবে যোম বা য়োম জাপানের সর্বোচ্চ পর্বত ফুজিয়ামার অর্থ হলো ফুজি পর্বত (ফুজিয়ামা)। আরাকানে রোমার অর্থ হলো পর্বত । আরাকান পর্বত শ্ৰেণীকে তাদের ভাষায় আরাকান রোমা বলে। আমাদের দেশে ‘য়োমা’ বিকৃত হয়ে যোম বা জুম হয়ে গেছে। অনেকে আবার শব্দটিকে ঝুম উচ্চারণ করেন। যা হোক এই বিকৃত বানান এবং উচ্চারণ এমন ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে গেছে যে এই বিকৃত শব্দটির কোন পরিবর্তন না করে জুম রেখে দেওয়া হয়েছে। এই গ্রন্থ রচনা কালে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিষদের সভাপতি বিপ্লবী শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (ওরফে সন্তু লারমা) গ্রন্থ রচনাকালে আমার খোঁজখবর নিয়ে আমাকে নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন। সাহিত্যিক ও সমাজসেবী শ্রী ইন্টুমনি তালুকদার আমার গ্রন্থের জন্য প্রয়োজনীয় সূত্র গ্রন্থ সংগ্রহ করে আমাকে প্রভূত সহায়তা করেছেন। গ্রন্থটির মুদ্রণ কাজেও তিনি সক্রিয় সাহায্য করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তার সাহায্য সহায়তা না পেলে গ্রন্থটি বর্তমান রূপে প্রকাশিত হতে পারতো কিনা সন্দেহ। আরও অনেক বিদ্বজ্জন যারা গ্রন্থটি সম্বন্ধ ঔৎসুক্য প্রকাশ করেছেন তাদেরকে বিশেষভাবে রাষ্ট্রদূত শরদিন্দু শেখর চাকমা, সুসময় চাকমা, ডাঃ মং উষা থোয়াই, ধনঞ্জয় চাকমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। গ্রন্থটি সাধারণ শ্রেণীর পাঠকদের জন্য সাধারণ ভাষায় লিখিত হয়েছে। পাঠকবর্গ গ্রন্থ পাঠে উপকত হলে। পরিশ্রম সার্থক হয়েছে মনে করবো।
অধ্যাপক ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো
অধ্যাপক ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো-এর জন্ম ২৫ অক্টোবর ১৯৩৪ সালে চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার । অন্তর্গত কানুনগো পাড়া গ্রামে। পিতার নাম স্বর্গীয় পুলিন। বিহারী কানুনগো মাতা সুচারু প্রভা কানুনগো। ড. কানুনগো। উপমহাদেশের প্রথিতযশা ঐতিহাসিক অধ্যাপক ড. কালিকা রঞ্জন কানুনগো-তার জ্যেষ্ঠ্য পিতৃব্য ।। ১৯৬০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ইতিহাসে এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬১ সালে স্যার আশুতোষ কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের। শুরু । প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক ড. আবদুল করিম-এর তত্বাবধানে গবেষণা করে ১৯৭২ সালে পিএইচ.ডি লাভ। করেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে অবসর গ্রহন করেন। বহু গ্রন্থ প্রণেতা ড. কানুনগো প্রণীত কয়েকটি গ্রন্থের শিরোনাম হলো – A History of Chittagong (Vol.। and ||), A History of the Chittagong Hill Tracts, বাংলার ইতিহাস (তিন খণ্ড), বাংলার শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস। (দুই খণ্ড), The Chittagong Revolt 1930-34, Chakma Resistance to British Domination, ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রাম, বাংলায় ভক্তিবাদ, প্রাচ্যের রাষ্ট্র দর্শন, চট্টগ্রাম চরিতাভিধান (সম্পাদনা), মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী; জীবন ও কম, ইংলন্ডের ইতিহাস, চটগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস। ড. কানুনগো সতীর্থ ও ছাত্র উভয় মহলে জনপ্রিয়।