প্রস্তাবিত বাজেটে আদিবাসীদের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনিঃ সংবাদ সম্মেলনে বাজেটে প্রতিক্রিয়া
![](https://ipnewsbd.net/wp-content/uploads/2019/06/ba-1.jpg)
সোহেল হাজং, ঢাকা: “প্রস্তাবিত বাজেটে আদিবাসীদের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি” শীর্ষক বাজেট প্রতিক্রিয়ার এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং মূল বক্তব্যে বলেন,প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়লেও আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে গতবছরের তুলনায় বরাদ্দ ১১৫ কোটিটাকা কমানো হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে এ মন্ত্রণালয়ে বাজেট বরাদ্দ ছিল মোট(উন্নয়ন ও পরিচালন মিলিয়ে) ১,৩০৯ কোটি টাকা। এবারের প্রস্তাবে তাধরা হয়েছে ১,১৯৪ কোটি টাকা। এ মন্ত্রণালয়ের বাজেটের আকার ধারাবাহিকভাবে বিগত বছরগুলোতে বাড়লেও এবারইতার ব্যতিক্রম ঘটেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্যপ্রস্তাবিত বাজেটের পরিচালন খাতে ধরা হয়েছে ৩৫৩ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন খাতে ধরা হয়েছে ৮৪১ কোটি টাকা। গতবছর অর্থাৎ২০১৮-১৯ অর্থ বছরেবাজেটে পরিচালন খাতে বরাদ্দ ছিল ৩২০ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল ৯৮৯ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য সরাসরি কোন বাজেট বরাদ্দ নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে “সমতল ভূমিতে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ‘বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত)” কর্মসূচীর আওতায় তাঁদের জন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। সেটি এবার ১০ কোটি টাকা বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। সমতলের ২০ লক্ষ আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৫০ কোটি টাকা। এটি পাটিগণিত করলে বের হয় মাথাপিছু আদিবাসীর জন্য বরাদ্দ মাত্র ২৫০ টাকা। গত বছর এটি ছিল ২০০ টাকা। এ ২০০ বা ২৫০ টাকা দিয়ে সমতলের আদিবাসীদের জন্য কি উন্নয়ন হবে তিনি প্রশ্ন রাখেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রস্তাবিত বাজেটে আদিবাসী বিষয়ে কিছু সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে সংশোধনী নিয়ে আসার দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হলো-পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সিএইচটি’-এর আদিবাসীদের জন্য প্রস্তাবিত উন্নয়ন বরাদ্দ বাড়িয়ে কমপক্ষে ২,৫০০ কোটি টাকা করতে হবে; আগামী অর্থবছরে (২০১৯-২০) সমতলের আদিবাসীদের জন্য উন্নয়ন বরাদ্দ কমপক্ষে ১,৫০০ কোটি টাকা বৃদ্ধি করা এবং সমতলের আদিবাসীদের বিষয়টি দেখার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি আলাদা অধিদপ্তর গঠন করতে হবে ।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, এএলআরডি এবং কাপেং ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে ২০ জুন ২০১৯ বিকাল ৩ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের দ্বিতীয় তলাস্থ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ আদিবাসীদের উন্নয়নে অগ্রাধিকার এবং জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দের দাবিতেএক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা; বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি ও কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন রবীন্দ্রনাথ সরেন এবং কাপেং ফাউন্ডেশনের ম্যানেজার হিরন মিত্র চাকমা। আয়োজকদের পক্ষ থেকে মূল বক্তব্য পড়ে শোনান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।
আয়োজকদের পক্ষে সংবাদ সম্মেলনটি পরিচালনা করেন এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। তিনি বলেন,পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় বাজেটে এর প্রতিফলন থাকতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের কার্যকারিতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য লোকবল নিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট থাকতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে সমতল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে তা বাস্তবায়নে বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ এর পূর্ণ বাস্তবায়নে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর যথাযথ বাস্তবায়ন ও ভূমি কমিশনের কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ রাখতে হবে;পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদসমূহের বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে।
শামসুল হুদা আরো বলেন, এসডিজি পূরণে সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে দায়িত্ব বন্টন কওে দিয়েছে। এর মূলকথা হলো, কাউকে পেছনে ফেলে নয়। এসডিজি বাস্তবায়নে সরকারের বাজেটে আমরা আদিবাসীদের জন্য তেমন কিছু পেলাম না। তাই সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নেই এবং এসডিজি-এর লক্ষ্য পূরণে বাজেটে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। সরকার তার দায়িত্ব থেকেই এটা করবেন। আমরা সরকারের অঙ্গীকারগুলো বাস্তব রূপ দেখতে চাই।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি ও কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, রাষ্ট্র বাজেটে আদিবাসীদের সবসময় ঠকিয়ে যাচ্ছে। কারণ সমতলের আদিবাসীদের জন্য কম বরাদ্দ দেয়া হয়। এবং এলাকায় গেলে বোঝা যায় তাদের জন্য বরাদ্দকৃত এ সামান্য পরিমাণ টাকাও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা হয় না। এখানে আদিবাসীদের কথা বলার কোন সুযোগ থাকে না। তিনি বলেন, ভূমিহীন ও বাস্তুহীন আদিবাসীদের বাসস্থানের জন্য বাজেট বরাদ্দ হওয়া প্রয়োজন। অনেক বছর ধরে দরিদ্র আদিবাসীরা রাষ্ট্রকে কর দিয়ে যাচ্ছে । তারা যদি কখনো সে কর একসাথে ফেরৎ তাহলেও তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
বক্তারা আরো বলেন, এবারের ১০০ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতায় বিগত বছরের মতো দেশের অবহেলিত ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসীদের বিষয়ে কোন একটি প্যারা বা অনুচ্ছেদ বাজেট বক্তৃতায় রাখা হয়না যা বিগত বছওে ছিল।‘নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮’-এর আদিবাসী বিষয়ে অঙ্গীকারের সাথে অসামঞ্জস্য রয়েছে এ প্রস্তাবিত বাজেটে। নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত আদিবাসী বিষয়ে অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়ার মতো অর্থ বরাদ্দ উক্ত প্রস্তাবিত বাজেটে নেই বলে তারা অভিযোগ করেন।
আদিবাসী বিষয়ে ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১৬-২০) বাস্তবায়নের রূপ এ বাজেটে অনিশ্চিত বলেন বক্তারা। ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০১৬-২০) বিভিন্ন অঙ্গীকার যেমন, ‘আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র ২০০৭’ বাস্তবায়ন এবং ‘আদিবাসী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠী বিষয়ক আইএলও কনভেনশন নং ১৬৯’ রেটিফাই করা এবং ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ছিল। পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়নে সহায়তাদানের জন্য সিএইচটি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সিএইচটি আঞ্চলিক কাউন্সিল ও তিনটি পার্বত্য জেলা কাউন্সিলকে শক্তিশালী করার কথা ছিল এ পরিকল্পনায়। ভূমি অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছিল,“ভূমিতে অধিকার নিশ্চিত করতে ২০০১ সালের সংশোধিত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন অনুসরণ করে ভূমি কমিশনের উদ্যোগে পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা হবে ইত্যাদি। ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শেষ অর্থবছরের বাজেট এটি। কিন্তু সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এবারও প্রস্তাবিত বাজেটে সুনির্দিষ্ট কোন বরাদ্দধরা হয়নি।
মূল বক্তব্যে বলা হয়, সমতলের বিশলক্ষাধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা বরাবরই উন্নয়ন বাজেটে অবহেলিত ও বঞ্চিত থাকে। তাদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন এবং মন্ত্রণালয় বা খাতভিত্তিক বাজেট প্রণয়ণের রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশনের কাজ অব্যাহত থাকার কথা বললেও আসলে এখনো এ ভূমি কমিশন গঠিতই হয়নি।এবং এ উদ্যোগ গ্রহণে বাজেটে কোন বরাদ্দও রাখা হয় না।
আগামী বছরের জন্য সামাজিক সুরক্ষায় বাজেটেও আদিবাসীদেও নির্দিষ্ট করে তেমন কোন বাজেট নেই।যেটুকু আছে সেটাওআদিবাসীদের সরাসরি অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্দেশনানেই বলে আদিবাসীরা এর সুবিধা ঠিকভাবে পায় না।
আগামী অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রস্তাবিত বাজেট ধরা হয়েছে ৫ লক্ষ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। যেখানে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২,১১,৬৮৩ কোটি টাকা। এদেশে আদিবাসীর সংখ্যা ৩০ লক্ষ ধরা হলে আদিবাসীদের জনসংখ্যা অনুযায়ী বরাদ্দ হওয়ার কথা ৪ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বাজেট ৮৪১ কোটি টাকা এবং সমতলে থোক বরাদ্দ ৫০ কোটি টাকা মোট ৮৯১ কোটি টাকা। যেহেতু আদিবাসীরা ঐতিহাসিকভাবেই শোষণ, বৈষম্য ও মানবসৃষ্ট দারিদ্র্য ও বঞ্চনার শিকার, তাই আদিবাসীদের মাথাপিছু বরাদ্দ, জাতীয় উন্নয়ন বরাদ্দের মাথাপিছুর তুলনায় অন্তত ৩ গুন বেশি হওয়া উচিত। যেহেতু টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) দর্শনানুযায়ী কাউকে পিছনে রাখা যাবে না, তাই আদিবাসী মানুষকে মূলধারারসাথে একই কাতারে আনতে হলে তাদের জন্য সমপরিমাণ বরাদ্দ দিলে হবে না। ‘ইতিবাচক বৈষম্য’(Positive Discrimination) নীতির আওতায় তাদেরকে অন্তত ৩ গুন বেশি বরাদ্দ দিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে সমতলের আদিবাসীদের জন্য ‘বিশেষ’ সুপারিশমালায় বলা হয়, সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে; পাহাড়ের আদিবাসীদের মতো সমতলের আদিবাসীদের জন্যও ভিন্ন ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য আলাদা বাজেট করতে হবে।
পার্বত্য আদিবাসীদের জন্য ‘বিশেষ’ সুপারিশমালায় বলা হয়, পার্বত্য আদিবাসীদের অধিকার ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন স¤পর্কিত বেশকিছু রাষ্ট্রীয় নীতি বা আইন যেমন- পূর্ববঙ্গীয় রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন- ১৯৫০, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নি®পত্তি কমিশন আইন ২০০১, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০ ইত্যাদি রয়েছে। এ নীতিসমূহের বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ রাখা উচিত; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা শক্তিশালীকরণে পর্যাপ্ত বাজেট রাখতে হবে; জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের জন্য টাস্কফোর্স ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ রাখতে হবে।