মতামত ও বিশ্লেষণ

পপি ত্রিপুরার মৃত্যু ও নাগরিকদের মৌনতা – ইমতিয়াজ মাহমুদ

(১)
গুলশান এলাকায় প্রকাশ্যে দিনের আলোতে তেইশ চব্বিশ বছর বয়সের ফুটফুটে একটি মেয়ে গাড়ীর ধাক্কায় নিহত হলো, এই খবরটা আমাদের খবরের কাগজ বা টেলিভিশনের জায়গা করে নিতে পারেনি। বিশাল এই পৃথিবীতে কত বড় বড় ঘটনা ঘটে চলেছে, মানুষের কতো রকম প্রায়োরিটি, এইসবের ফাঁকে পাহাড় থেকে আসা আদিবাসী একটি হতভাগী মেয়ের দুর্ঘটনায় মৃত্যু, বাইরে থেকে দেখলে খবর হিসাবে আসলেই হয়তো গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু আপনি যখন কাছে থেকে দেখবেন, আপনজন হিসাবে দেখবেন, তখন বুঝবেন এটি একটি মেধাবী সন্তানের মৃত্যু, একজন মমতাময়ী বোনের মৃত্যু, একজন প্রাণবন্ত আন্তরিক বন্ধুর মৃত্যু কিংবা কে জানে, হয়তো কারো সোহাগী প্রেমিকারও মৃত্যু এটা।

আপনজনের কান্না তো গ্লোবাল নিউজ ভ্যাল্যু বুঝে না। ওদের পৃথিবীতে চোখের জলে আপনাদের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ধোঁয়াশা হয়ে যায়।

লিয়ানা ত্রিপুরা পপি। বান্দরবানের মেয়ে, বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। তেইশ বছর বয়স। ঢাকায় থেকে পড়াশুনাটা চালিয়ে যাচ্ছিল আর সেই সাথে কাজও করতো। এমাসের আঠারো তারিখ সকাল সকাল গুলশানে ওর কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছিল রিক্সায় করে। পেছন থেকে একটি প্রাইভেট কার ওর রিক্সায় আঘাত করে। মৃত্যু হয় পপির। পপির ছোট ভাই গুলশান থানায় মামলা করে। গাড়ীটির নম্বর ধরে গাড়ীটি সনাক্ত করা হয়েছে। গাড়ীটি চালাচ্ছিল একটি কিশোর- অত্যন্ত বিত্তবান ঘরের ছেলে।

(২)
গুলশানের মত এলাকায় সকাল সাড়ে দশটার একটু পর ঘটনা ঘটেছে। গাড়ীর নম্বর সনাক্ত করা আছে, গাড়ীর মালিক কে সেটাও জানা, গাড়ী চালাচ্ছিল যে ছেলেটি তাকেও সনাক্ত করা আছে। তারপরও আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে ঘটনা ঘটার আড়াই দিন পর। এর মধ্যে গাড়ী চালাচ্ছিল যে কিশোর, তার পরিবারকে সুযোগ দেওয়া হয় নিহত পপির পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে ওদেরকে চাপ দেওয়া- বিত্তবান ঘরের ছেলেরা এইরকম গাড়ী চাপা দিয়ে মানুষ মেরে ফেললে কিরকমভাবে ওরা সামলায় সে তো আপনারা জানেন।

পপির ছোট ভাই জয়ন্ত ওর ফেসবুকে লিখেছে, “দিদি ওরা আমাকে (৫০০০০) পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করতে এসেছে, কতটা নিষ্ঠুর দেখ তুই, টাকা দিয়ে জীবনের মুল্য দিতে এসেছে, পৃথিবীর সব সম্পদ আমার হাতে এনে দিলেও তোর মুল্য কি তুলনাযোগ্য? আমার কাছে আমার বোনটা পৃথিবীর সবচাইতে বড় দামি, পারবে? আমাকে টাকা দিয়ে, দিদির মুখ থেকে ভাই ডাকটি আবার শুনাতে? ভাই বলে বুকে জরিয়ে ধরতে? কপালে চুমু দিতে? আমার হাতটি শক্ত করে ধরতে?”

ওরা চেয়েছে সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে ছোট ভাইটিকে প্রভাবিত করে আপোষ টাপস করে বিত্তবান ঘরের নষ্ট কিশোরটিকে রক্ষা করতে। এই ছোট ছেলেটির দৃঢ় অবস্থানের কারণে ওরা হয়তো এই পর্যায়ে ঘটনা ধামাচাপা দিতে পারেনি- কিন্তু এইরকম বিত্তবান ও ক্ষমতাবান ঘরের নষ্ট ছেলেরা গাড়ী চাপা দিয়ে মানুষ হত্যা করার পরও আইন কানুন সবকিছুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকম ঘটনা কি আপনারা দেখেননি? বেশীদিন আগের কথা তো নয়, একটি এমপির পুত্র দামী গাড়ী দিয়ে একজনকে হত্যা করে পার পেয়ে গেছে, ভুলে গেছেন?

এইখানেও এই চেষ্টা হয়েছে। ঘটনা ঘটেছে আঠারো তারিখ সকাল এগারোটার একটু আগে অথচ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে বিশ তারিখ রাতে। এই তিনটি দিন ঘাতকের পরিবারকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে ধামাচাপার চেষ্টা করতে। বলা হচ্ছ ঘাতক কিশোরটির বয়স নাকি সতের। আমার ধারনা ছেলেটিকে অপ্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে শিশু হিসাবে চালিয়ে দিয়ে অপরাধের গুরুত্ব ও সম্ভাব্য শাস্তি কমানোর মতলবে ইচ্ছা করেই ছেলেটির বয়স কমিয়ে দেখানো হয়েছে। হয়তো দেখা যাবে ওর প্রকৃত বয়স আঠারো পার হয়ে গেছে।

(৩)
ছোটখাটো আকৃতির ফুটফুটে চেহারার আদিবাসী এই মেয়েটি খুবই হাসিখুশি থাকতো। আমরা জেনেছি ও ছবি তুলতে খুব পছন্দ করতো। ছোট ভাইটিকে খুবই বিরক্ত করতো, ফটো তুলে দে ফটো তুলে দে। ভাইটিকে বলতো, তুই তো খুবই ভালো ফটো তুলিস, এইজন্যেই তোকে বলি ফটো তুলে দিতে। খুব স্বচ্ছল ঘরের বাচ্চা ওরা হয়তো নয়- কিন্তু নিতান্ত হতদরিদ্র ঘরেরও নয়। আত্মনির্ভরশীল ছিল, এই বয়সেই নিজের জীবনযাপনের ব্যায় নিজেই আয় করার চেষ্টা করতো।

আমি অনুমান করি পপি স্বাধীনচেতা শক্ত মেরুদণ্ডওয়ালা মানুষ ছিল- পাহাড়ি আদিবাসী শিক্ষিত মেয়েরা সাধারণত এরকমই হয়। কিন্তু সে তো তেইশ বছরের একটা প্রাণবন্ত তরুণীই ছিল। আমার পরিবারের মেয়েরা বা বন্ধুবান্ধবের মেয়েরা বা আমার ফেসবুক বন্ধুরা মিলিয়ে একঝাক এই বয়সের তরুণীকে আমি চিনি। ওরা এই ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়ায়, ক্লাসে যায়, কেনাকাটা করতে বা আড্ডা দিতে বা টিউশনি করতে বা লুকিয়ে প্রেম ট্রেম করতে ওরা একা একা চলাফেরা করে। পপি ত্রিপুরা তো ওদেরই একজন। ওদের জন্যে আমাদের এই নগরটা কি নিরাপদ নয়?

না, আমরা এখন যত মন খারাপই করি না কেন পপিকে তো আমরা ফেরত আনতে পারবো না। পপির বাবা মায়ের শূন্য বুক তো শূন্যই থেকে যাবে। জয়ন্তের জন্যে ওর বোনের ভালোবাসা তো আর ফিরিয়ে দিতে পারবো না আমরা। কিন্তু বিচার তো আমরা চাইতে পারি- ঘাতকের শাস্তি তো চাইতে পারি। কেননা এই বিচারটি আমাদের সকলের জন্যে জরুরী- আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে আমাদের এই নগরটিকে একটি নিরাপদ নগরী হিসাবে দেখতে চাই। আমাদের এই নগরটি তো কেবল বিত্তবান মানুষের ছেলেদের জন্যে বা ওদের মেয়েদের জন্যেই মাত্র নয়- এই নগরটি তো আমাদের সকলের ছেলেমেয়েদের জন্যে।

(৪)
এইটাই শুধু আমি চাই- আপনারাও একটু কণ্ঠ খুলে দাবী করেন বিচারটা যেন ঠিকঠাক মত হয়। এই পোড়ার দেশে এমনিতেই তো চট করে বিচার টিচার হয় না। বিচার হয় শুধুমাত্র সেইসব ক্ষেত্রে যেসব ক্ষেত্রে আপনি আর আমি সোচ্চার হই। সুদূর বান্দরবন থেকে এই মেয়েটা দুই চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল আমাদের এই নগরে। আমরা ওকে বেচে থাকতে দিলাম না। এই অপরাধের একটুও দায় কি আপনার আমার নাই?

এই ছবিটা দেখেন, এই তো সেদিন, জুনের ষোল তারিখে জয়ন্ত ওর দিদির জন্মদিনে জয়ন্ত পোস্ট করেছিল এই ছবিটা। লিখেছিল, people come and go, friends change like the weather but I know my sister is here forever. I love you. happy birthday di… সাথে অনেকগুলি লাল হৃদয়ের ইমোটিকন। ওর দিদিটি আর নেই।

ইমতিয়াজ মাহমুদ; লেখক ও আইনজীবী
ইমতিয়াজ মাহমুদের ফেসবুক পোস্ট থেকে

Back to top button