জাতীয়

নিখিল মানখিন সাংবাদিকতায় ১ যুগ পেরিয়ে

শ্যাম সাগর মানকিন: স্কুলে পড়ার সময় খ্রিস্টান যাজক হবেন বলে মিশনারীতে যোগ দিয়েছিলেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত মিশনারীদের অধীনেই পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর পারিবারিক পরিস্থিতির অবনতি হলে মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়। সে সময় যাজক হবার ইচ্ছে ছেড়ে দিয়ে, মিশনারী থেকে ফিরে এসে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। অবশ্য ইচ্ছে ছিলো ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করবার। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ভালো অবস্থানে ছিলেন বলে চাইলেই কোটা নিয়ে ইংরেজী সাহিত্য পেতে পারতেন তিনি। তাতে করে অন্য আরেকজনের কোটায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সুযোগ নষ্ট হবে বলে পছন্দের বিষয়ে ছেড়ে দিয়ে মেধা তালিকায় পাওয়া গণযোগাযোগেই থেকে যান। নিজের জীবনের লক্ষ্য যেনো তাকে টেনে নিয়ে যায় নিয়তির অমোঘ বিধানের মতই সাংবাদিকতার পথে। সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে তারপর পেরুতে হয়েছে অনেক পথ। এখন কাজ করেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রকাশিত দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায়। সেখানে এক যুগ ধরে সাংবাদিকতা করে যাচ্ছেন তিনি। বর্তমানে সেখানে সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করছেন। বলছিলাম সাংবাদিক নিখিল মানখিনের কথা।

ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় মেধাবী নিখিল মানখিন। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট নিখিল মানখিন বড় হয়েছেন সবার আদরে। কিন্তু তার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হবার পথে পরিবার ধীরে ধীরে আর্থিক অনটনের দিকে ধাবিত হয়। সে কারনে সারাজীবন তাকে লড়াই করে যেতে হয়েছে নানান প্রতিকূলতার সাথে। সে জন্যেই মিশনারীতে যোগ দিয়েছিলেন অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে। তাতে করে পড়াশুনার খরচটা অন্তত বহন করতে হতোনা পরিবারকে। যখন মিশনারী থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তখন নিজের পড়াশুনার খরচ যোগাতে টিউশনি করেছেন। তবে বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও চার্চ থেকে স্টাইপেন্ড পেয়ে পড়াশুনার খরচের ভার লাঘব হয়েছে অনেকটাই। এছাড়া গারোদের মধ্যে প্রথম ও একমাত্র বিশপ পল পনেন কুবির একান্ত সহযোগিতার ফলে নিখিল মানখিন এগিয়ে নিয়েছেন তার জীবন চলার পথ। আজকে এ পর্যায়ে এসে এ কথা অকপটে স্বীকার করে নেন বিনয়ী মানুষটি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে সাংবাদিকতা শুরু করেন তিনি। ছাত্র অবস্থায় দৈনিক প্রথম আলোতে কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন অনেকদিন। এরপর দৈনিক আজকের কাগজ এ স্টাফ রিপোর্টার হিসেবেও কাজ করেন। পড়াশুনা শেষ হবার কয়েক বছর পর ২০০৬ সালে যোগ দেন বর্তমান কর্মস্থল দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায়। গত এক যুগ ধরে পত্রিকার নানান উত্থান পতনের স্বাক্ষী হয়েছেন। স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন রিপোর্টের জন্য পাঁচবার পেয়েছেন জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা মিডিয়া এওয়ার্ড। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের যৌথ উদ্যোগে প্রতিবছর এই এওয়ার্ড দেয়া হয়। নিখিল মানখিন গারো সমাজ থেকে উঠে আসা জাতীয় পর্যায়ের প্রথম সরকারি ওয়েজবোর্ডধারী পেশাজীবী গারো সাংবাদিক। আদিবাসীদের মধ্যে তিনিই প্রথম জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদ লাভ করেছেন। বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টারস ফোরামের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এছাড়া ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করেছেন নিখিল মানখিন।
সাংবাদিকদের জন্য নিজস্ব নীতি নৈতিকতা রয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ করে গেলেই ভালো ফল আসবে বলে তিনি মনে করেন। তাছাড়া নিজের কাজ যথাযথভাবে নিষ্ঠার সাথে করে যাওয়া সফলতা নিয়ে আসে বলেও জানান তিনি। তার মতে সাংবাদিকতা পেশা বর্তমানে খুব চ্যলেঞ্জিং। কারন বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশা বর্তমানে বুদ্ধিজীবীদের আওতায় নেই, সেগুলো চলে গেছে রাজনৈতিক ব্যক্তি নাহয় ব্যবসায়ীদের হাতে। ফলে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্থান পতন তৈরি হয়। এইটা বড় একটা অর্থনৈতিক ধাক্কা তৈরি করে ব্যক্তি জীবনে।
আদিবাসীদের জন্য ভিন্ন গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। জাতীয় যে সমস্ত গণমাধ্যম রয়েছে সেগুলোতে আদিবাসীদের গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ ছাপার ক্ষেত্রে নানান প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। সেগুলোর মধ্যে রয়ছে সংবাদ সংস্থা গুলোর নিজস্ব নীতি, রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রভৃতি। তাছাড়া আদিবাসীদের দাবী দাওয়ার ক্ষেত্রেও একই থাকে বলে গণমাধ্যমের কাছে গুরুত্ব কম থাকে বলেও তিনি মনে করেন। সেক্ষেত্রে আদিবাসী নেতৃবৃন্দের আরো বেশি কৌশলী হতে হবে বলেও তিনি মনে করেন। গণমাধ্যমের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার পরামর্শ তিনি দেন।

স্কুলে পড়ার সময় থেকেই রাজনীতির প্রতিও ঝোঁক তৈরি হয়। এ ঝোঁক থেকেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত করেছেন নিজেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠনে কেন্দ্রীয় সভাপতি হয়েছেন। তাছাড়া বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জগন্নাথ হল শাখার সহ-সভাপতি ও সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ছিলেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে। বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খ্রিষ্টান এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-প্রচার প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
নিখিল মানখিন জন্মগ্রহন করেন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থানাধীন জয়রামকুড়া গ্রামে ১৯৭৮ সালের ২৮ অক্টোবর। পিতা পেলেন তজু ও মাতা সুনীলা মানখিন দুজনই গত হয়েছেন। তির্ময়ী কৃপা বনোয়ারীর সাথে বিবাহসুত্রে বর্তমানে ধোবাউড়ার বানিক্যপাড়া গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন। স্ত্রী দুই কন্যা সন্তান মাটি ও কৃষ্টি বনোয়ারী কে নিয়ে ঢাকায় থাকেন।
ভবিষ্যতে নিজের এলাকায় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হবার স্বপ্ন দেখেন নিখিল মানখিন। স্বপ্ন দেখেন আগামীতে নিজে একটা পত্রিকা প্রকাশ করবেন। যেখানে আদিবাসীদের সংবাদ সহ সারা বিশ্বের সংবাদ বার্তা পৌছে দিতে পারবেন মানুষের কাছে।

Back to top button