জাতীয়

নারী দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় সংহতি সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

সতেজ চাকমা: আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মাহাত্মকে ধারণ করে সমাজে নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক সকল ক্ষেত্রে নারী তথা আদিবাসী নারীর প্রতি চলমান বৈষম্য, শোষণ,বঞ্চনা, নিপীড়ন, সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সংগ্রামসহ সমাজ প্রগতির লড়াইয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক কর্তৃক সংহতি সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সংগঠনের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমার পরিচালনায় আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্যে ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন, বাংলাদেশের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে আমরা যারা আদিবাসী নারীদেরকে সংগঠিত করে আদিবাসী নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি সেই অংশ হিসাবে আজকের সমাবেশ।

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক এই নারী নেত্রী আরো বলেন, পাহাড় তথা সমতলের আদিবাসী নারী ও শিশুরা যে ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা সহ নানা ধরণের সহিংসতার শিকার হয়। এই সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের চলমান সংগ্রাম আরো উজ্জীবিত হবে এই নারী দিবসের মাহাত্মে।আদিবাসী নারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত সহিংসতা প্রতিরোধে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বিশেষ সেল গঠনেরও জোড় দাবী জানান তিনি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগের সদস্য এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা এককালের চাকমা রাণী কালিন্দির দৃঢ়চেতা শাসনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূচনা হয়েছিল নারীদের শ্রমকে কেন্দ্র করে।নিজেদের ন্যায্যতা আদায়ের জন্য নারীদের যে সংগ্রাম সেখান থেকেই নারী দিবসের উত্থান। এই ন্যায্যতা আদায়ের লড়াইয়ে পাহাড় এবং সমতলে আদিবাসী নারীরাও এগিয়ে যাবে।

খাগড়াছড়ি থেকে মনোনীত সংরক্ষিত সাংসদ বাসন্তীর চাকমার সম্প্রতি সংসদে দেওয়া বক্তব্যের নির্মম বাস্তবতাকে স্মরণ করে তিনি আরো বলেন, বাসন্তী চাকমার মত পাহাড়ের যে জীবনগুলো এখনো অসহায়ত্বের নির্মম বাস্তবতার বেড়াজালে বন্দি হয়ে আছে এ বেড়াজাল ভেঙে মুক্তির লড়াইয়ে তরুণ আদিবাসী নারী ও পুরুষদের সমানতালে এগিয়ে যেতে হবে।

আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, নারীর প্রতি যে বৈষম্য, নারীর প্রতি যে অন্যায় করা হয় তা আসে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দাপট থেকে।আদিবাসী নারীরা পাচঁভাবে বৈষম্যের স্বীকার হয়। প্রথমত, আদিবাসী হিসাবে, নারী হিসাবে, আদিবাসী নারী হিসাবে, দরিদ্র-প্রান্তিক হিসাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে বলে এবং আদিবাসী নারী যখন পাহাড়-বন ছেড়ে শহরে জীবিকার জন্য অভিবাসিত হয় তখন তারা বৈষ্যম্যের শিকার হয়।আদিবাসী নারীদের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আদিবাসী-বাঙালি পুরুষদের এগিয়ে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেন বিশিষ্ট এ আদিবাসী নেতা।

বিশিষ্ট আদিবাসী নারী শিক্ষাবিদ অঞ্জুলিকা খীসা বলেন, প্রান্তিক অঞ্চল থেকে উঠে এসে ষাটের দশকের শেষের দিকে পাহাড়ের পুরুষতান্ত্রিকতার নির্মম বেড়াজাল ছিন্ন করে ঢাকা শহরে লেখাপড়া করেছি এবং পাহাড়ে ফিরে গিয়ে শিক্ষা নিয়ে, নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেছি। আদিবাসী নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পুরুষদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে আবারো পুনর্ব্যক্ত করেন এ নারী শিক্ষাবিদ।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য বাঞ্চিতা চাকমা পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুর্গমতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার বাস্তবতা পেরিয়ে জুমিয়া জীবনের চাল বাছা, ধান বাছা, কাপড় বোনা থেকে শুরু করে অনেক সংগ্রাম করে আজকে নিজের অবস্থানকে তৈরী করতে হয়েছে। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী নারীদের শোষণীয় বাস্তবতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের আদিবাসী নারীরা ঠিকমত স্বাস্থ্য সেবা পায় না, শিক্ষার সুযোগ পায় না। এ আদিবাসী নারীদের প্রান্তিক অবস্থান থেকে তুলে নিয়ে আসার জন্য সচেতন জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
এছাড়া উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন সাদেকা হালিম। আলোচনা সভায় তিনি বলেন, আদিবাসী নারীরা যখন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়।এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টির সাংসদ লুৎফুন্নেসা খান বিউটি এমপি বলেন, নারীদেরকে জীবনের প্রথম থেকেই সংগ্রাম করতে হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস এই সংগ্রামকে আরো উজ্জীবিত করে প্রতিটি নারী এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের আদিবাসী নারীদের। পাহাড় তথা সমতলের আদিবাসী নারীরা যেভাবে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হন সেইসব পেরিয়ে তাঁরা যেভাবে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন তা অত্যন্ত প্রশংসার দাবী রাখে বলে মন্তব্য করেন এই নারী সাংসদ।

সভাপতির বক্তব্যে আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য তুলি ¤্রং বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাঠামোতে নারীকে যতদিন মানুষ হিসাবে দেখতে শিখবো না ততদিন নারীর প্রতি সহিংসতা কমবে না।তিনি নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সবাইকে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান।

উক্ত অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রতিকূলতা পেরিয়ে বিভিন্ন অবস্থানে যারা সফলভাবে পদচারণা করছেন তাঁদের মধ্যে পাঁচ আদিবাসী নারীকে সম্মাননা দেওয়া হয়।তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ভাষ্কর্য নিয়ে পড়াশুনা করা এবং বর্তমানে উত্তরার আগা খান বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত লাভলী চাকমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি এন্ড বুদ্ধিষ্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক জ্যোতিস্বী চাকমা, বাংলাদেশ হাজং ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি মহুয়া হাজং, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের সংবাদ পাঠিকা বান্দরবানের মারমা মেয়ে ডমেপ্রু মারমা হ্যাপী এবং সফল পার্লার পরিচালক ও প্রশিক্ষক কুহেলিকা আজিম। জাতিসংঘ এবারের নারী দিবসের স্লোগান নির্ধারণ করেছে- Think equal, build smart, innovate for change. আলোচনা সভার পরে আদিবাসী শিল্পীদের পরিবেশনায় আদিবাসী গান ও নৃত্য পরিবেশন করা হয়।

Back to top button