নারী দিবসে মহিলা সমিতি ও এইচডব্লিউএফের আহ্বান

৮ মার্চ ২০১৯ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের পক্ষ থেকে সবাইকে জানাই সংগ্রামী শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন। আপনারা জানেন, সমাজে নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক সকল ক্ষেত্রে নারীর উপর চলমান বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন, সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সংগ্রামসহ সমাজ প্রগতির আন্দোলনে ৮ মার্চ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। উল্লেখ্য যে, ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে বিশ্বের সংগ্রামী ও সমাজতান্ত্রিক নারীদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা নেত্রী ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব অনুসারেই ৮ মার্চ তারিখে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উদযাপনের সূত্রপাত ঘটে। মূলত ১৯০৮ সালে নিউইয়র্ক শহরে কাজের অমানবিক অবস্থা ও বৈষম্যমূলক মজুরীর প্রতিবাদে পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের স্মরণে এই দিবসটিকে বেছে নেয়া হয়। পরবর্তীতে বিশ্বের দেশে দেশে অব্যাহতভাবে নারী সমাজের জাগরণ ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘও ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৭৬ হতে ১৯৮৫ সময়কালকে নারী দশক হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে এই আন্তর্জাতিক নারী দিবস আরও ব্যাপকতা লাভ করে এবং বিশ্বব্যাপী নারী সমাজের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ ও গভীর অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে থাকে। বলাবাহুল্য, ইতোমধ্যে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদার বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও বাস্তবে গুণগত ও সামগ্রিকভাবে বিশ্বের দেশে দেশে নারীরা এখনও শোষণ, বঞ্চনা, অবহেলা, নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হয়ে চলেছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নারীরা প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লংঘন এবং জাতিগত আগ্রাসন, সহিংসতা ও বৈষম্যের শিকার হতে বাধ্য হচ্ছে।
জাতিসংঘ এবার এই দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে- ‘ Think equal, build smart, innovate for change’। ‘ইউএন ওমেন’-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সারাবিশ্বে বর্তমানে ৭৪ কোটি নারী অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক জীবনধারায় বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে, যাদের সামাজিক নিরাপত্তা, সরকারি সেবা ও অবকাঠামোর সুবিধা লাভে কোন সুযোগ নেই বললেই চলে। নারীরা পুরুষের তুলনায় ২.৬ গুণ বেশি অবৈতনিক ও গৃহস্থলী কাজ করে থাকে। বিশ্বে মাত্র ৪১ শতাংশ প্রসৃতি তাদের নবজাতকসহ মাতৃকালীন সুবিধা পেয়ে থাকে। বাকি ৫৯ শতাংশ প্রসুতি নারীরা মাতৃকালীন সুবিধা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। তিনজন নারীর মধ্যে অন্তত একজন নারী তাদের জীবনে সহিংসতা শিকার হয়ে থাকে। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সকল নারী ও কন্যাশিশুর ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত ৫নং লক্ষ্য পরিপূরণের ক্ষেত্রে দরকার গুণগত পরিবর্তন, সমন্বিত উদ্যোগ ও নতুন সমাধান।
এমতাবস্থায় ‘ইউএন ওমেন’ এ বছর বিশ্বব্যাপী লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এই প্রতিপাদ্য বিষয়টি তুলে ধরেছে। জাতিসংঘের এই প্রতিপাদ্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারী সমাজের বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন এ বছর তার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছেÑ ‘সমচিন্তায়-সমভাবে, সমাজ বিকাশে ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সংগ্রামী হই’।
বলাবাহুল্য, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির একুশ বছর পার হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ বিষয়ই অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে। উদ্বেগের বিষয় যে, ২০০৯ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার একনাগাড়ে একদশক ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন থাকলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ফলে চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ পূর্বের মতোই অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। শেখ হাসিনা সরকার কেবল চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত অবস্থায় ফেলে রেখে দেয়নি, উপরন্তু একের পর এক চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তির কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন করে ২০০১ সালে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে একপ্রকার সেনাশাসন কায়েমের ফলে সেনাবাহিনী পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, বিচার, ভূমি ব্যবস্থাপনা, উন্নয়নসহ সকল ক্ষেত্রে উপনিবেশিক কায়দায় হস্তক্ষেপ করে চলেছে। অপারেশন উত্তরণের বদৌলতে পার্বত্য চট্টগ্রামে আনাচে-কানাচে সেনা অভিযান পরিচালনা, ঘরবাড়ি তল্লাসী, মিথ্যা মামলা, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার, ক্যাম্পে আটকে রেখে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন ও বিচার-বহির্ভুত হত্যা, নারী ও শিশু ধর্ষণ, বিচার ও সভা-সমাবেশের উপর হস্তক্ষেপ এবং ভূমি বেদখল ও সাম্প্রদায়িক হামলায় সেটেলার বাঙালিদের মদদ দান ইত্যাদি জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তির ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় রেখে নিজেদের হীন কায়েমী স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তিবিরোধী সশস্ত্র সংগঠনসমূহের পরস্পরের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত, চাঁদাবাজি, হত্যা, অপহরণ ইত্যাদি ঘটনা অবাধে চালিয়ে যেতে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এহেন অনিশ্চিত ও নাজুক পরিস্থিতিতে জুম্ম নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা যেমনি প্রতিনিয়ত ভূলুন্ঠিত হয়ে চলেছে, তেমনি তাদের নিরাপত্তাহীন জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়া এবং উল্টো চুক্তি বিরোধী ষড়যন্ত্র জোরদার হওয়ার কারণে চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও বিশেষত সেটেলার বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা বহু জুম্ম নারী যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতার স্বীকার হয়েছে। গভীর উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এসব অপরাধের যথাযথ বিচার হয়নি এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হয়নি আদিবাসী নারী ও শিশুর উপর সহিংসতা সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ সালে অন্তত ৫০ জন আদিবাসী নারী ও শিশু যৌন হয়রানি, অপহরণ, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। গত ২৭ নভেম্বর বান্দরবানে এক প্রতিবন্ধী তঞ্চঙ্গ্যা নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা; ২২ আগস্ট লামায় ১৪ ও ১৭ বছরের দুই ত্রিপুরা কিশোরীকে বিজিবি সদস্য কর্তৃক ধর্ষণ, ৫ আগস্ট লংগদুতে বাক-প্রতিবন্ধী চাকমা নারীকে ধর্ষণ, ২৯ জুলাই দীঘিনালায় ৫ম শ্রেণির এক ত্রিপুরা ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নে সেনাসদস্য কর্তৃক এক মারমা কিশোরী ধর্ষণ ও তার ছোট বোনের শ্লীলতাহানি ইত্যাদি ঘটনার এখনো সুবিচার মেলেনি।
বলাবাহুল্য, সমাজের অর্ধেক অংশ নারীদের অবহেলিত, অবদমিত ও বঞ্চিত রেখে যেমনি কোন সমাজের প্রগতি অর্জন সম্ভব নয়, তেমনি নারীর উপর রাষ্ট্রীয় বৈষম্য, জাতিগত-সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, নিপীড়ন ও বঞ্চনা জিইয়ে রেখে কোন দেশে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণ সম্ভব হতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জাতির উপর যে জাতিগত নিপীড়ন ও সহিংসতা, তা থেকে জুম্ম নারীর মুক্তি ও নিরাপত্তা, সর্বোপরি জুম্ম নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। জুম্ম জাতির অধিকারের সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়া এবং চুক্তিবিরোধী ও জুম্মস্বার্থ পরিপন্থী কর্মকান্ড প্রতিরোধ ও প্রতিবিধানের লক্ষ্যে জুম্ম নারী সমাজকে অধিকতর সংগ্রামী ও সোচ্চার হতে হবে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের আহ্বান- আসুন, জুম্ম নারীর নিরাপত্তা বিধান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠাসহ নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে এবং পার্বত্য সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে সমচিন্তায়, সমভাবে, সমাজ বিকাশে ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সংগ্রামী হই।
……………………………………………………
৮ মার্চ ২০১৯ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন কর্তৃক কল্যাণপুর, রাঙ্গামাটি থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত।