নারী দিবসে অগ্রগামী আদিবাসী নারী ও উদ্যোক্তাদের সম্মাননা প্রদান
বিশেষ প্রতিবেদন: আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২০ উপলক্ষ্যে রাজধানীতে দুই অগ্রগামী আদিবাসী নারী এবং আদিবাসী নারী’র উদ্যোগে পরিচালিত ‘হেবাং’ রেস্টুরেন্টকে দেয়া হল সম্মাননা। বাংলাদেশ আদিাসী নারী নেটওয়ার্ক কর্তৃক এ সম্মাননা প্রদান করা হয় রাজধানী ছায়ানট সাংস্কৃতিক ভবনের দ্বোতলার মিলনায়তনে। আদিবাসী নারীর উদ্যোগে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ‘হেবাং’ রেস্টুরেন্ট ছাড়াও যে দুই আদিবাসী নারী সম্মাননা পেলেন তাঁরা হলেন ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সর্বপ্রথম নারী আইনজীবি সৃজনী ত্রিপুরা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি ও ভূমি রক্ষার লড়াইয়ে অগ্রগামী বিচিত্রা তির্কী।
সৃজনী ত্রিপুরা: ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সর্বপ্রথম নারী আইনজীবি সৃজনী ত্রিপুরা। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ১৯৮৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তিনি রত্নবিকাশ ত্রিপুরা এবং চম্পা ত্রিপুরার জ্যেষ্ঠ কন্যা। তার বাবা-মা দু জনেই সরকারী কর্মচারী। তিনি নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি (অনার্স) এবং এল.এল.এম ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল তিনি জেলা আদালতের অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকভুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশে বসবাসকারী ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের প্রথম মহিলা আইনজীবী হন বলে জানান এই অগ্রগামী নারী। খাগড়াছড়ি আইনজীবী সমিতির প্রথম অনুশীলনকারী মহিলা আইনজীবী হিসেবেও তাকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল বলে জানান এই নারী আইনজীবি।২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের হাই কোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে ত্রিপুরা আদিবাসীদের মধ্যে প্রথম মহিলা আইনজীবী হিসেবেও তিনি হাইকোর্ট বিভাগে অনুশীলন করছেন।
তিনি বলেন, এই পেশায় পথ চলা কখনও খুব সহজ ছিল না। একজন সফল আইনজীবী হয়ে ওঠার স্বপ্নের তাড়না থেকে বিরত হইনি বলে মানবাধিকার এবং সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে অংশগ্রহন জারি রাখছি এখনো। তিনি তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে যতই বাধা আসুক না কেন তা মোকাবেলার জন্য সবসময় প্রস্তুত বলেও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
বিচিত্রা তির্কী: সম্মাননা প্রাপ্ত আরেক অগ্রগামী নারী হলেন উত্তরবঙ্গের চাঁপায়নবাবগঞ্জ জেলার জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য বিচিত্রা তির্কী। তিনি ২০১২ সাল থেকে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কমিটি’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।তাঁর জন্ম ১৯৭৮ সালে নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার পাঁচপাকিয়া গ্রামে। পিতা শ্রী মধাব তির্কি, মাতা বিমলা বারোয়ার। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়পশুনার সুযোগ হওয়া এই অদম্য নারীর ১৯৯৬ সালে বিয়ে হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার জিনারপুর গ্রামে মঙ্গলা সরদারের সাথে। দিনমজুর মঙ্গলা সরদার পৈত্রিক সূত্রে ৪৮ বিঘা জমি পেয়েছিলেন। কিন্তু জালিয়াতি চক্রের লোকজন জাল দলিল করে ওই জমি দখল করে নেয়। জাল দলিল বাতিলের জন্য আদালতে মামলা করেন মঙ্গলা সরদার কিন্তু রায় পাওয়ার আগেই ১৯৯৯ সালে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যান। স্বামীর মৃতদেহ ছুঁয়ে শপথ নেওয়া বিচিত্রা তির্কী দিনমজুরি করে জমি উদ্ধারের জন্য প্রাণপণে মামলা লড়তে থাকেন। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পরে ১৯৯৯ সালে আবারও জিনারপুর গ্রামের দিমল কিসপট্টার সাথে বিয়ে হয়। কিন্তু তিনি থেমে থাকেন নি। গ্রামবাসী ও শ্রমজীবী আদিবাসী নারীদের সংগঠিত করতে থাকেন। একটি মানবাধিকার সংস্থার আইনী সহায়তায় একের পর এক মামলা জিততে থাকলেও জমি দখলে নিতে পারছিলেন না।
২০০৯ সালে নওগাঁর পোরশা উপজেলার খাতিরপুর গ্রামে আদিবাসী পল্লীতে ভূমিদস্যূদের লাঠিয়াল বাহিনীর হামলার প্রতিবাদে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ২৬-২৭ জুলাই পোরশার সরাগাছি থেকে নওগাঁ জেলা প্রশাসক কার্যালয় পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার গণপদযাত্রা করে।সেই দীর্ঘ লংমার্চে বিচিত্রা তির্কীও নেতৃত্ব দেন। তখন তাঁর কোলে প্রায় দেড় বছর বয়সী ছোট ছেলে সংগ্রাম। ছোটে ছেলে সংগ্রামকে কোলে নিয়েই তিনি পুরো পথ হেটেছিলেন বলে জানান তিনি। এই পদযাত্রায় এসে তিনি বৃহত্তর সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়ে ঘোষণা দেন, বাড়ি ফেরার পর গ্রামের আদিবাসী নারীদের নিয়ে তার স্বামীর বেদখল হওয়া জমি দখল করবেন। তারপর নেমে পড়েন জমি দখলের কাজে। গ্রামের নারীদের নিয়ে উদ্ধার করেন প্রভাবশালী ভূমিদস্যুর দখলে থাকা জমি। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর কঠোর সংগ্রাম এবং এগিয়ে চলা। যুক্ত হয়ে যান আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের বৃহত্তর সংগ্রামে। তিনি দৃঢ় কন্ঠে বলেন, এ লড়াই শুধু নিজের জমির জন্যই নয়, এই সংগ্রাম আদিবাসীদের সামগ্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ২০১১ সালে তিনি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পার্বতীপুর ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন।
অন্যদিকে ২০১৪ সালে নিজের জমিতে ধান রোপন করতে গিয়ে ভূমিদস্যু কর্তৃক মারাত্মকভাবে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনে শিকার হয়েছেন। সেসময় তিনি বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার পার্বতীপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্যও ছিলেন। তাঁর উপর নির্যাতনের বিচারের দাবিতে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উদ্যোগে বৃহত্তর কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে তিনি তাঁর সকল বেদখল হয়ে থাকা জমি উদ্ধার করতে পরেছেন। যা ইতিহাস হয়ে থাকবে আদিবাসীদের সংগ্রামের সাথে।
হেবাং রেস্টুরেন্ট: আদিবাসী নারী পরিচালিত আরেকটি প্রতিষ্ঠান ‘হেবাং’ রেস্টুরেন্ট।হেবাং রেস্টুুরেন্টের পক্ষ্যে সম্মাননা গ্রহন করেন এ রেস্টুরেন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা বিপ্লী চাকমা। এ রেস্টুরেন্টের পেছনে যারা আছেন তাঁরা হলেন বিপ্লী চাকমা এবং তাঁর মেঝো বোন প্রিয়াংকা চাকমা, সেজো বোন সুচিন্তা চাকমা এবং ছোট বোন স্বস্তি চাকমা। চার বোনের উদ্যোগে পরিচালিত এই রেস্টুরেন্টটির যাত্রা শুরু হয় অনলাইন ভিত্তিক খাবার ডেলিভারি প্রদানের প্রারম্ভিকতার মধ্য দিয়ে।২০১৬ সাল থেকে চলমান এ রেস্টুরেন্টটি ঢাকার মীরপুরের কাজীপাড়ায় এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। মূলত পাহাড়ী বিভিন্ন ব্যাঞ্জন দিয়েই এ রেস্টুরেন্টেটি তাঁর স্বকীয়তা অর্জন করেছে রাজধানীর বুকে। বিপ্লী চাকমা জানান, বাঙালী, থাই, চাইনিজ, ইতিালিয়ান সহ বিভিন্ন বিদেশী খাবারের পাশাপাশি নিজেদের স্বকীয় খাবারগুলো অন্যদের কাছে পরিচয় করানোর উদ্দেশ্যেই এ উদ্যোগ। এ রেস্টুরেন্ট করার পেছনে চার বোনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করা প্রিয়াংকা চাকমা’র অবদান অত্যাধিক বলেও জানান উদ্যেক্তারা।সম্মাননা গ্রহন করে হেবাং রেস্টুরেন্ট এর অন্যতম উদ্যোক্তা বিপ্লী চাকমা জানান, যারা আমাদেরকে এই উদ্যোগে নিরুৎসাহিত করেছিলেন এবং নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করেছিলেন তারাও এখন আমাদেরকে প্রসংশা করে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণায় যুগাচ্ছেন।
বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা জানান, বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর পথচলা খুব সহজ নয়। তার চাইতেও সহজ নয় আদিবাসী নারীদের। মূল ধারার বাঙালি নারীদের পাশাপাশি আদিবাসী নারীরাও যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে তার স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার পথে সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে উৎসাহিত করা এবং পাশে থাকার জন্যই বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের এই আয়োজন বলে জানান তিনি।