জাতীয়

ধর্ষক ও যৌন নির্যাতনকারীদের শাস্তির দাবিতে ঢাকায় কালো পতাকা মিছিল

অমর শান্তি চাকমাঃ ২৪ ফেব্রুয়ারী শনিবার বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের উদ্যোগে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে দুই মারমা কিশোরী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনকারী নিরাপত্তা বাহিনী সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে এবং ভুক্তভোগীদের গৃহবন্দী করে রাখার প্রতিবাদে এক কালো পতাকা মিছিল ও মিছিল পরবর্তী সমাবেশের আয়োজন করা হয় ।

কালো পতাকা মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে টিএসসি ঘুরে শাহবাগে আসলে সেখানে পুলিশী বাঁধার সম্মুখীন হয় এবং জাতীয় জাদুঘরের সামনেই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি মনিরা ত্রিপুরার সঞ্চালনায় এবং আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক চঞ্চনা চাকমার সভাপতিত্বে সমাবেশে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ফাল্গুনী ত্রিপুরা। এছাড়াও সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিলেন নারী নেত্রী রোকেয়া কবির, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবি সাদিয়া আরমান, জান্নাতুল মরিয়ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, আরডিসির জান্নাত-ই ফেরদৌসী, লেখক ও নৃ-বিজ্ঞানী রেহলুমা আহমেদ, গবেষক সায়দিয়া গুলরুখ প্রমুখ।

এছাড়াও সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রিবেং দেওয়ান, বাগাছাস ঢাকা মহানগরের সভাপতি অলিক মৃ, সাসুর দপ্তর সম্পাদক ইলিয়াস মুরমু।

কালো পতাকা মিছিলের সাথে আরো সংহতি জানান বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, চানচিয়া, মাদল, উদীচীসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।


সমাবেশে বক্তারা বলেন, দেশের এক দশমাংশ অঞ্চল নিয়ে তিন পার্বত্য এলাকা। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় হলেও সত্য বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সেখানে অঘোষিত সেনাশাসন বিদ্যামান রয়েছে। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গনতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এ চারটি মূলনীতি নিয়ে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সেখানে দেশের এক অংশে সেনাশাসন বিরাজমান থাকবে তা হতে পারেনা। নিরাপত্তার নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে অঘোষিত সেনাশাসন বজায় থাকার কারনে সেখানকার পাহাড়ীরা সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন ঘটনার শিকার হচ্ছে। তারা আরো বলেন, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন তৎকালীন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক পাহাড়ী নেত্রী কল্পনা চাকমাকে সেনাবাহিনী দ্বারা অপহরণ করা হয়েছিল । সেই কল্পনা চাকমার আজও কোন হদিস পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত সেনাবাহিনী কর্তৃক মিথ্যে ধরপাকড়, নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষন, গুম, হত্যার মত ঘটনার মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করছে।

বক্তারা আরো বলেন, রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে সেনাবাহিনী কর্তৃক দুই মারমা কিশোরীকে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির মত ঘটনা কোন সভ্য দেশে হতে পারেনা । যে সেনাবাহিনী রক্ষকের ভূমিকা নেওয়ার কথা তারাই আজ ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। অন্যদিকে এ ঘটনাকে চাপা দেওয়ার জন্য ওখানকার পুলিশ প্রশাসন, সেনা প্রশাসন প্রতিনিয়ত বিষয়টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা। তারই ধারাবাহিকতায় ২২ জানুয়ারী দিনের বেলায় স্থানীয় ফারুয়া ক্যাম্পের একদল সেনা সদস্য ভিকটিমদের বাড়িতে গিয়ে বিভিন্নভাবে হুমকি প্রদান করে এবং ধর্ষণ করা হয়েছে বলে যাতে কেউ না বলে সে হুমকি দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ঘটনার পরে উক্ত সেনা সদস্যদের নেতৃত্ব দানকারী সুবেদার মিজান ঘটনাটির বিষয়ে কাউকে না জানানোর জন্য ১০০ টাকা ভিকটিমদের বাবার হাতে গুঁজে দেন বলেও এলাকাবাসীরা দাবি জানান। এছাড়াও ২৩ তারিখে ঘটনার শিকার দুই বোনকে রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর প্রশাসন কড়া নজরদারি আরোপ করে। তারা কোন সাংবাদিক, মিডিয়া, মানবাধিকার কর্মী, সুশীল প্রতিনিধি কাউকেই ভিকটিমদের সাথে সাক্ষাৎ করতে দেয়নি।

অন্যদিকে ২৬ জানুয়ারী দুপুরের দিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য মিস বাঞ্চিতা চাকমা ও চাকমা সার্কেলের রাণী ইয়েন ইয়েন দুই মারমা বোনকে ছাড়িয়ে আনতে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের হেফাজতে ছেড়ে দিতে অস্বীকার করে । তাদের উপর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপ রয়েছে বলে তারা জানায়। এ ঘটনার মেডিক্যাল রিপোর্ট ৩০ জানুয়ারীর মধ্যে দেওয়ার কথা থাকলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গড়িমসির কারণে রিপোর্টটি ৮ ফেব্রুয়ারী প্রকাশ করা হয়। রিপোর্টে ভিক্টিমদের শুক্রাণুতে ধর্ষণের কোন আলামত পাওয়া যায়নি বলেও মিথ্যাচার করা হয়। এদিকে ভিকটিমরা প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে নিজ জিম্মায় মুক্তি চেয়ে আইন বিশেষজ্ঞ ও সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন এবং চাকমা রাজা ব্যরিষ্টার দেবাশীষ রায়ের মাধ্যমে ৮ ফেব্রুয়ারী হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয় । রিটটি ১১ তারিখে যুক্তিতর্ক শুনার পর ১৩ তারিখে রায়ের দিন ধার্য করা হয় এবং রায় না হওয়া পর্যন্ত ভিকটিমদের কোথাও না নেয়ার জন্য মাননীয় হাইকোর্ট নির্দেশ প্রদান করে।

এরই মধ্যে ধর্ষক সেনাদের বাঁচাতে ১২ তারিখ বাবা-মা মেয়েদের নিজ জিম্মায় নেয়র জন্য আরও একটি রিট দায়ের করা হয় এবং সে রিটটি ১৩ তারিখ সকালে শুনানি হয়ে যায় এবং মেয়েদের বাবা মার জিম্মায় তুলে দেওয়ার জন্য আদেশ প্রদান করা হয়। অথচ তখনও পর্যন্ত ৮ তারিখের রিটটি শুনানিতে নিয়ে আসা হয়নি। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দোষীদের বিচার না করে বরং ভিক্টিমের মতকে উপেক্ষা করে ১৫ তারিখে নারী পুরুষের ১৬ জনের সাদা পোশাক পরিহিত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি টিম হাসপাতালে গিয়ে সেখানে ভিকটিমদের সাথে সার্বক্ষনিক থাকা চাকমা সার্কেলের রানী ইয়েন ইয়েন এবং তার সাথে থাকা স্বেচ্ছাসেবীদের উপড় সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা এবং যৌন নিপীড়ন চালিয়ে ভিক্টিমদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

উল্লেখ্য যে, গত ২২ জানুয়ারী ২০১৮ দিবাগত রাতে আনুমানিক ২.৩০ টায় রাঙ্গামাটি জেলাধীন বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের ওড়াছড়ি গ্রামে এক মারমা কিশোরী (১৯) ফারুয়া ক্যাম্পের সেনাসদস্য কর্তৃক নিজ বাড়িতে ধর্ষণের শিকার এবং তার আরেক ছোট বোন (১৫) শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছিল বলে গ্রামবাসীরা দাবি করে।
সমাবেশ থেকে নিম্নোক্ত দাবিনামা উত্থাপন করা হয়-

১) অবিলম্বে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে দুই মারমা বোনকে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনকারী অভিযুক্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

২) ভিক্টিমদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রদান ও গৃহবন্দী থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে ভিক্টিমদের সহায়তাকারীদের উপড় হামলার বিচার করতে হবে।

৩) পুনঃরায় মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রকাশ এবং তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।

৪) পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশে আদিবাসী নারীর উপড় সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে।

৫) আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তা দিতে হবে।

৬) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক অস্থায়ী সেনাক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার করতে হবে।

৭) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।

Back to top button