জাতীয়

ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা আরো প্রান্তিক হচ্ছেন

সরকার ও রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারক, নিয়ন্ত্রকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকার মধ্য দিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের চূড়ান্ত রূপ আজকে প্রতিফলিত হচ্ছে। এটি আমাদের জীবনকে ভীতসন্ত্রস্ত ও নিরাপত্তাহীন করে তুলছে, একটা শঙ্কিত জীবন নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে। রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করা এবং অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি গড়ে তোলা ছাড়া এ থেকে উত্তরণের আর কোনো পথ নেই। ১০ আগস্ট, ২০১৬ সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ২১ টি মানবাধিকার ও নাগরিক সংস্থার যৌথ আয়োজনে “ভূমি সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ এবং আদিবাসীসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকারের সুরক্ষা” শীর্ষক সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) একথা বলেন।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, আমাদের দেশের যে রাজনৈতিক বাস্তবতা তাতে দলগুলো মিললেই জাতীয় ঐক্য হয়ে যায়- এ ব্যাপারটি সঠিক নয়। যুদ্ধাপরাধী ও গ্রেনেড হামলাকারীরা আজ বিএনপি’র কোয়ালিশনে রয়েছে। বিএনপির সাথে জামায়াতের যে নিবিড় ঐক্য, এটা লাঘব করার সুযোগ খুব কম, কারণ একটা আদর্শিক জায়গা থেকেই সেটা এসেছে। অসাম্প্রদায়িক ও অগ্রসরমান বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক দল ছাড়াও নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ সমাজের সকল স্তরের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষের সাথে ঐক্যের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আদিবাসী অধিকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পাঞ্চল গড়ার ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা জায়গা-জমি হারিয়ে ফেলছে বলে আমার ধারণা, এখানে তাদের অধিকার রক্ষার প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন ও সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে পৃথক দুটি প্রবন্ধের প্রথমটিতে সঞ্জীব দ্রং উল্লেখ করেন, বাঁধ নির্মাণ (কাপ্তাই), ন্যাশনাল পার্ক, ইকো-পার্ক, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সামাজিক বনায়ন, মিলিটারী বেইস নির্মাণ ইত্যাদির কারণে আদিবাসীরা ভূমি হারাচ্ছে। শুধু ভূমিলোভী চক্র নয়, বা কখনও কখনও বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে শুধু নয়, ‘পপুলেশন ট্রান্সফার’-এর কারণেও আদিবাসীদের জায়গা-জমি অন্যের দখলে চলে গেছে। আদিবাসীদের ভূমিরক্ষায় স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন গঠনসহ সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসী অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকারসহ ভূমি ও সম্পদের উপর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। অপর প্রবন্ধে অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস উল্লেখ করেন, জঙ্গিবাদ যেমন একভাবে বহুত্ববাদকে মুছে ফেলতে চায়, ক্ষমতাবান গোষ্ঠী, রাষ্ট্র ও সরকারও তেমনি অন্যভাবে বহুত্ববাদের স্পিরিটে কুঠারাঘাত করতে চায়। এই চিন্তা-কাঠামোর ভেতরেই খুঁজে পাওয়া যাবে কেন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা আরো প্রান্তিক হচ্ছেন, নিহত হচ্ছেন, হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন। কেন জমি হারাচ্ছেন, কেন আদিবাসীসহ সংখ্যালঘু জনগণের ভূমি ক্রমাগত দখল হয়ে যাচ্ছে। জঙ্গীবাদ রোধে পরিবার ও সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রে বহুত্ববাদী চেতনার উন্মেষ ঘটাতে হবে।
এর আগে সূচনা বক্তব্যে এএলআরডি নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্র যে সাম্প্রদায়িকতা লালন করেছে এখন তা জঙ্গীবাদে রূপ নিয়েছে। একে কার্যকরভাবে মোকাবেলার জন্য আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের অধিকারের স্বীকৃতি ও তাদের প্রতি সকল বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে।
এতে অন্যান্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন খুশী কবির, এডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত, সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা, ড. সাদেকা হালিম, ড. স্বপন আদনান প্রমুখ। আলোচকরা বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যারা পেয়েছে তাদের দ্বারা দেশের সম্পদকে ধ্বংস করার নানা প্রক্রিয়া চলছে। সুন্দরবন ধ্বংস হচ্ছে, পাহাড়ে পাহাড়িদের বন পাহাড় ধ্বংস হচ্ছে, আদিবাসী পাহাড়ীরা তাদের জায়গা জমি ও সম্পদ হারাচ্ছেন। মধুপুর, মৌলভিবাজার, গোবিন্দগঞ্জসহ সর্বত্র আদিবাসীদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্রগ্রামে বিভিন্ন কারণে আদিবাসীদের দেশান্তর করা হচ্ছে। আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে যারা কথা বলছে তাদেরও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। একাত্তরে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়টি ছিল আংশিক বিজয়। সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অসাম্প্রদায়িক লড়াইয়ের মাধ্যমে এই আংশিক বিজয়কে সম্পূর্ণ করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন, ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত বিষয় কিন্তু রাষ্ট্রকে হতে হবে সবার, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই বাংলাদেশ কোনো একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করি তাদের আজ ঐক্যবদ্ধভাবে এই সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদকে রুখে দাঁড়াতে হবে।

Back to top button