অন্যান্য

দেশের বিভিন্ন স্থানে আদিবাসী দিবস পালিত

বিশ্বের ৯০টি দেশের প্রায় ৪০ কোটির অধিক আদিবাসী জনগনের মতো বাংলাদেশে বসবাসকারী ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগন এবারও জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস জাতীয় ভাবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ২০১৮ সালের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়- আদিবাসী জাতিসমূহের দেশান্তর : প্রতিরোধের সংগ্রাম । এই প্রতিপাদ্যকে নিয়েই আজ (বৃহস্পতিবার) ৯ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের আয়োজনে জাতীয়ভাবে এই দিবস পালন করা হয়। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে আদিবাসী দিবস পালন করা হয়েছে।

সিলেটঃ শ্রীমঙ্গল উপজেলার অফিস প্রাঙ্গনে শ্রীমঙ্গল শাখা বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের আয়োজনে আদিবাসী দিবস পালিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে শ্রীমঙ্গল শাখা বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি মি. পংকজ কন্দের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান রনীন্দ্র কুমার দেব। প্রধান অতিথির উদ্ধোধনীর মাধ্যমে উপস্তিত বিভিন্ন আদিবাসী নেএীবৃন্দরা বক্তব্য রাখেন।

এরপর শ্রীমঙ্গল উপজেলা চত্বর হয়ে গৌহ রোড, কলেজ রোড, মূল চৌমূনার রাজপথের মধ্য দিয়ে উপজেলা পৌরসভা শহীদ মিনার পযর্ন্ত্য বিশাল র‍্যালী প্রদক্ষিণ করে মূল অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয়।

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে আরো উপস্তিত ছিলেন শ্রীমঙ্গল প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি ইসমাইল মাহমুদ, শ্রীমঙ্গল আদিবাসী ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক হিরনময় সিং, শ্রীমঙ্গল ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার নিকোলাস বাড়ৈ, শ্রীচুক সংগঠনের ও পার্থ হাজং। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকার আদিবাসী জনগন ও নেএীবৃন্দ এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ।

রাজশাহীঃ “আদিবাসী জাতিসমূহের দেশান্তর: প্রতিরোধের সংগ্রাম” প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবস ২০১৮ উপলক্ষে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ রাজশাহী মহানগর শাখার উদ্যোগে আদিবাসীদের জমি-জল-জঙ্গল-বসতিসহ অধিগ্রহণের নামে উচ্ছেদ, জবরদখল, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, মিথ্যা মামলা, লুটপাট, অপহরণ ও দেশত্যাগ বন্ধ করতে হবে এবং সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠনের দাবিতে আজ সকাল ১০.০০টায় রাজশাহী সাহেব Ÿাজার জিরো পয়েন্টে মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
মানববন্ধনে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ রাজশাহী মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক আন্দ্রিয়াস বিশ্বাসের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট কলামিষ্ট প্রশান্ত কুমার সাহা, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের দপ্তর সম্পাদক সূভাষ চন্দ্র হেমব্রম, আদিবাসী যুব পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নবদ্বীপ লাকড়া, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি বিভূতী ভূষণ মাহাতো, সভাপতি নকুল পাহান, বাংলাদেশ রবিদাশ উন্ন্য়ন পরিষদ রাজশাহী জেলা সভাপতি রঘুনাথ রবিদাস, ব্লাস্ট রাজশাহী জেলা সমন্বয়কারী সামিনা বেগম, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক পলাশ পাহান প্রমূখ।
মানববন্ধন সমাবেশে বক্তারা, ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন, আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন, আদিবাসীদের উচ্ছেদ, দেশত্যাগ সহ সকল প্রকাল নির্যাতন বন্ধ করার দাবি জানান। এছাড়াও বাদপড়া আদিবাসীদের দ্রুত গেজেটে অন্তর্ভূক্ত করে গেজেট প্রকাশ করার দাবি জানান বক্তারা।

চট্টগ্রামঃ আজ ৯ আগস্ট ২০১৮ সকাল ১০ ঘটিকায় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আদিবাসী দিবসের অনুষ্টানমালার উদ্বোধন করেন নারী নেত্রী ও মানবাধিকার কর্মী নূর জাহান খান। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম,চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি শরৎ জ্যোতি চাকমার সভাপতিত্বে উদ্বোধনী পর্বে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মহিউদ্দিন মাহিম একই বিভাগের আরেক সহকারী অধ্যাপক বসু মিত্র চাকমা। উদ্বোধনী বক্তব্যে নূর জাহান খান বলেন, আমরা সবাই বাংলাদেশী। এই দেশে বাস করার অধিকার সকলের। কেন আদিবাসীরা দেশ থেকে বিতারিত হবে তা রাষ্ট্রকে জবাব দিতে হবে। বক্তারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে হলে দেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার ভোগ করতে দিতে হবে বলে মতামত দেন নূর জাহান খান।

এরপর একটি র‌্যালি শহীদ মিনার থেকে নিউমার্কেট মোড় হয়ে কোতোয়ালি ঘুরে আবার শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়।

সকাল ১১.৩০ মিনিটে শুরু হয় আলোচনা সভা। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম,চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি শরৎ জ্যোতি চাকমার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি ও প্রাবন্ধিক জনাব আবুল মোমেন। প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি ও সাংবাদিক জনাব হাফিজ রশিদ খান। বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের তাপস হোড়,বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক জিংমুনলিয়ান বম প্রমুখ।

দুপুর ১.১০ ঘটিকায় আদিবাসী শিল্পীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন ভারতীয় দূতাবাস চট্টগ্রামের মাননীয় সহকারী হাই কমিশনার শ্রী অনিন্দ্য ব্যানার্জী। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে গিয়ে সম্মানিত অতিথি অনিন্দ্য ব্যানার্জী বলেন, জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী দিবসটি নৃতাতত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীব্যাপী আদিবাসী জাতিসমূহের জাতীয় অস্তিত্ব ও অধিকারের অব্যাহত সংকট এবং স্বকীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রতিবছর এ দিবসটি নতুন বার্তা নিয়ে আসে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৩ পার্বত্য জেলাসহ সমতলেও প্রচুর আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে। এই উপমহাদেশে অনাধিকাল থেকে বনাঞ্চল রক্ষা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ করনে আদিবাসী জনগোষ্ঠী সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্ত তাদের জীবনমান উন্নয়নে কাংখিত লক্ষ্যে পৌছাতে সম্ভব হয়নি। আমি মনে করি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষা অপরিহার্য। তাই তাদের সুশিক্ষিত করতে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। নৃতাত্তিক জনগোষ্ঠীর আলাদা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। যা অত্র অঞ্চলের মানুষ চিরকাল উজ্জীবিত করেছে। নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও আদিবাসীরা এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যধারণ করে আসছে। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি জাতির জনগোষ্ঠী তার নিজস্ব সত্ত্বাকে ধারণ করে তাদের আগামী প্রজন্মকে বেঁচে থাকতে হবে। আমরা চাই আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের সকল অধিকার নিয়ে অন্যান্য নাগরিকবৃনেদর মত শান্তিপূর্ণ সহবস্থানে বসবাস করুক।

আলোচনা সভার প্রদান অতিথি আবুর মোমেন বলেন,দেশে সংখ্যালঘুদের ভূমি বেদখল খুবই সহজ। কারণ তারা নানা দিক থেকে দুর্বল। এই সুযোগটা আমরা বাঙালিরা নিচ্ছি। আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেভাবে আদিবাসীদের ভূমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে আড়াই শতাংশ ছিল মুসলিম। বাকীরা আদিবাসী। আর আজ তা অর্ধেকে পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থায় আদিবাসীরা আজ চরম অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে। এই দেশে অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগনও। আবুল মোমেন বলেন, আদিবাসীরা যে দেশান্তরিত হচ্ছে তা উদ্বেগের বিষয়। শাসক গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের বহুমাত্রিকতার বিষয়টি ভাবতে হবে। অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন বলেন, উদারনৈতিক রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। পাশাপাশি সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরু না ভেবে জাতি বৈচিত্র্যতাকে মনে ধারণ করে এগিয়ে যেতে না পারলে কল্যাণমুলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যাবেনা। তিনি বলেন, জাতি জাতিই। সংখ্যা দিয়ে জাতির হিসাব হয়না। ড. নাসির বলেন, আমার দেশে অনেক ফ্লাইওভার হয়েছে। দেশে জিডিপি বেড়েছে কিন্ত রাষ্ট্রের চরিত্র পাল্টায়নি। দেশে আদিবাসীরা এখনও নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে।
অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথি হাফিজ রশিদ খান বলেন, পাহাড়ে অনেক রক্ত ঝরেছে। একটা পর্যায়ে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা যখন বুঝতে পারলো এই সমস্যার একটি সমাধান দরকার তখনই শান্তি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এই চুক্তিও বাস্তবায়িত না হওয়ায় আদিবাসীরা আজ দিশাহীন। এই অবস্থান থেকে উত্তরণ প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন হাফিজ রশিদ খান।

বক্তারা সবাই আদিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহবান জানান । আদিবাসীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করিয়ে না দিয়ে তাদেরকে ঐক্যদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি কওে দিতে সরকারের প্রতি আহবান জানান।

এছাড়াও শেরপুর, ময়মনসিংহ, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলা, দিনাজপুর সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসী দিবস পালন করা হয়েছে।

Back to top button