মতামত ও বিশ্লেষণ

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থাঃ মঙ্গল কুমার চাকমা

আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের এক দশক পূর্ণ হতে চলেছে। তাই জাতিসংঘ এ বছর ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রের এক দশকপূর্তি ঘোষণা করেছে। ২৪ এপ্রিল ৫ মে ২০১৭ তারিখে নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের সদরদপ্তরে অনুষ্ঠিত আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ১৬তম অধিবেশনেও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রের এক দশকপূর্তিকে মূল আলোচ্য বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। ২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক এই ঘোষণাপত্র গ্রহণের পর বিগত দশ বছরে ঘোষণাপত্রের বিপক্ষে ভোটদানকারী চারটি রাষ্ট্র (অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যা- ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ঘোষণাপত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তৎসময়ে ভোটদানে বিরত থাকা তিনটি রাষ্ট্র (কলম্বিয়া, সামোয়া ও ইউক্রেন) ঘোষণাপত্রের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। এছাড়া এই ঘোষণাপত্র মোতাবেক অনেক রাষ্ট্র আদিবাসী জাতিসমূহের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণে এবং আদিবাসীদের সমষ্টিগত অধিকার স্বীকৃতি প্রদানে সাংবিধানিক সংস্কার করেছে, নতুন আইন প্রণয়ন বা পুরোনো আইন সংশোধন করেছে। তবে এখনো পর্যন্ত আদিবাসী জাতি (ওহফরমবহড়ঁং চবড়ঢ়ষব) এর সংজ্ঞা, এবং ভূমি অধিকার ইস্যু নিয়ে বিদ্যমান বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশসহ এশিয়া মহাদেশে এই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মন্থর গতি লক্ষ করা যায়।
ক. পটভূমি
জাতিসংঘ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক যুগ থেকে ৯০টি দেশে বসবাসকারী প্রায় ৪০ কোটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর উপর চলমান শতাব্দী ব্যাপী বৈষম্য ও জাতিগত আগ্রাসনের বিষয়টি স্বীকার করেছে। ১৯২৩ সালে কানাডার হৌদেনসোনি প্রধান দেসকাহেহ্ সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে সফর করেন তৎকালীন জাতিপুঞ্জে কথা বলার জন্য এবং তাঁর স্বজাতির লোকরা যাতে তাদের আইনানুসারে, তাদের নিজস্ব আবাসভূমিতে এবং তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী বসবাস করতে পারে সেই অধিকারের কথা তুলে ধরতে। কিন্তু তাঁকে জাতিপুঞ্জে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়নি। এমনকি তাঁকে ১৯২৪ সালে তাঁর দেশে (আবাসভূমিতে) ফিরতেও দেয়া হয়নি। যদিও তিনি সেসময় জাতিপুঞ্জে কথা বলতে পারেনি, কিন্তু তাঁর সেই লক্ষ্য ও স্বপ্ন পরবর্তী প্রজন্মকে প্রবলভাবে উজ্জীবিত করেছিল যা আজো অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
১৯৭০ সালে জাতিসংঘের সংখ্যালঘু রক্ষা ও বৈষম্য প্রতিরোধ সংক্রান্ত সাব-কমিশন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সংক্রান্ত পরিস্থিতির উপর এক সামগ্রিক পর্যালোচনা শুরু করার সুপারিশ গ্রহণ করে। উক্ত সুপারিশ অনুসারে ১৯৭১ সালে মি. হোজে মার্টিনেজ কোবো’কে এ বিষয়ে গবেষণার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি দীর্ঘ ১২ বছর ধরে গবেষণার পর ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্যের সমস্যাবলীর গবেষণাকর্ম’ শিরোনামে ২২টি অধ্যায় বিশিষ্ট ১৪০০ পৃষ্ঠার একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করেন। উক্ত প্রতিবেদনে যে সকল সুপারিশ গ্রহণ করা হয় তন্মধ্যে অন্যতম ছিল আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সম্বলিত একটি আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা ।
উক্ত সুপারিশ মূলে ‘সংখ্যালঘু রক্ষা ও বৈষম্য প্রতিরোধ সংক্রান্ত সাব-কমিশন’ (পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে ‘মানবাধিকার বিষয়ক সাব-কমিশন’ করা হয়) কর্তৃক ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ’ স্থাপন করে ১৯৮২ সালে। মি. হোজে মার্টিনেজ কোবো’র পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশমালা অনুসারে উক্ত ওয়ার্কিং গ্রুপে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সংক্রান্ত পরিস্থিতির উপর এক ঐতিহাসিক পর্যালোচনা শুরু করে।
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ও আদিবাসী প্রতিনিধিদের মধ্যে ১৯৮৫ হতে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত আলোচনা-পর্যালোচনার পর উক্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ কর্তৃক ৪৬টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’-এর একটি খসড়া প্রণয়ন করা হয় এবং তা ১৯৯৪ সালে মানবাধিকার সাব-কমিশনে পেশ করা হয়। সাব-কমিশন উক্ত খসড়া ঘোষণাপত্র অনুমোদন পূর্বক মানবাধিকার কমিশনে প্রেরণ করে।
1. Sub-Commission on the Prenvention of Discrimination and protection of Minorities
2. Study of the Problems of Discrimintion Against Indigenous Propulation
জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ এবং ৯ই আগষ্টকে আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। অপরদিকে ১৯৯৩ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯৫-২০০৪ সাল’কে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক হিসেবে ঘোষণা করে। উক্ত দশকের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য ছিল ঘোষিত দশকের মধ্যে ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্ত করা। তারই ধারাবাহিকতায় উক্ত খসড়া ঘোষণাপত্রের বিস্তৃত ও দফাওয়ারী পরীক্ষা-নিরীক্ষার লক্ষ্যে মানবাধিকার কমিশন ১৯৯৫ সালে ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ’ স্থাপন করে।
১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত উক্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রত্যেক বছর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী ও এনজিও প্রতিনিধিদের মতামত গ্রহণসহ ঘোষণাপত্র পর্যালোচনার নিয়মিত অধিবেশনে বসে, কিন্তু খসড়া ঘোষণাপত্রের চূড়ান্তকরণের নিমিত্তে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণে উক্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ ব্যর্থ হয়। সর্বসম্মত ঐকমত্যে উপনীত না হওয়ার পেছনে মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল আদিবাসী জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার, আদিবাসীদের ‘ঢ়বড়ঢ়ষবং’ হিসেবে আখ্যায়িত করা, ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আদিবাসী জাতিসমূহের সমষ্টিগত অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে মতানৈক্য।
২০০৫ সালের ২০ এপ্রিল মানবাধিকার কমিশন ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ’ এবং ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ’ এই দু’টি ওয়ার্কিং গ্রুপের কাজ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ’-এর চেয়ারম্যান লুইস এনরিক চেভেজ (পেরু’র নাগরিক) খসড়া ঘোষণাপত্রের বিতর্কিত অনুচ্ছেদগুলো সংশোধন পূর্বক মতৈক্যমূলক শব্দ সন্নিবেশ করে মানবাধিকার কমিশনের পেশ করে।
এরপর ২৯ জুন ২০০৬ ‘মানবাধিকার কমিশন’-এর পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত ‘মানবাধিকার পরিষদ’ ইহার উদ্বোধনী অধিবেশনে পক্ষে ৩০ ভোট, বিপক্ষে ২ ভোট ও অনুপস্থিত ১২ ভোটে উক্ত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করে এবং সাথে সাথে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরবর্তী অধিবেশনে চূড়ান্ত অনুমোদনের প্রেরণ করে। ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর উক্ত খসড়া ঘোষণাপত্র সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে নামিবিয়া উক্ত ঘোষণাপত্রের উপর সাধারণ পরিষদের ভোট গ্রহণ পিছিয়ে নেয়ার প্রস্তাব পেশ করে। পক্ষে ৮২ ভোট, বিপক্ষে ৬৭ ভোট ও অনুপস্থিত ২৪ ভোটে এই কমিটি উক্ত প্রস্তাব অনুমোদন করে এবং এর ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদও তৃতীয় কমিটির প্রস্তাবানুসারে খসড়া ঘোষণাপত্রের উপর ভোট গ্রহণ স্থগিত করে। এর ফলে সাধারণ পরিষদের ভোট গ্রহণ পরবর্তী ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে যায়।
অবশেষে ২০০৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬১তম অধিবেশনে পক্ষে ১৪৩ ভোট, বিপক্ষে ৪ ভোট ও ভোটদানে বিরত ১১ ভোটে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক এই ঘোষণাপত্র চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। ভোটদানে বিরত থাকা ১১টি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশ একটি।
সাধারণ পরিষদ কর্তৃক অনুমোদনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ আড়াই দশকের কর্মপ্রচেষ্টার সফল পরিসমাপ্তি ঘটে এবং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র নি:সন্দেহে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে একটি মাইলফলক।
খ. ঘোষণাপত্রের প্রতি ক্রমবর্ধমান স্বীকৃতি
ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক এই ঘোষণাপত্র গ্রহণের পর বিগত দশ বছরে ঘোষণাপত্রের বিপক্ষে ভোটদানকারী চারটি রাষ্ট্র (অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যা- ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ঘোষণাপত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার মধ্যে ২০০৯ সালের এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রী এই ঘোষণাপত্রের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ৯ম অধিবেশন চলাকালে ২০১০ সালের এপ্রিলে নিউজিল্যা-ের মাওরি বিষয়ক মন্ত্রী এই ঘোষণাপত্রের সমর্থন প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ২০১০ সালে নভেম্বরে কানাডা এই ঘোষণাপত্রকে একটি ‘আশা-আকাক্সক্ষার দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং তদনুসারে ২০১৬ সালের মে মাসে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ৯ম অধিবেশনে কানাডার আদিবাসী ও নদার্ণ বিষয়ক মন্ত্রী এই ঘোষণাপত্রকে পূর্ণ স্বীকৃতি প্রদান করেন। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে হোয়াইট হাউসের ট্রাইবাল কনফারেন্সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এই ঘোষণাপত্রের প্রতি সমর্থন প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এছাড়া তৎসময়ে ভোটদানে বিরত থাকা তিনটি রাষ্ট্র (কলোম্বিয়া, সামোয়া ও ইউক্রেন) ঘোষণাপত্রের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে।
গ. জাতীয় পর্যায়ে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের স্বীকৃতি
জাতিসংঘ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক এই ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে “আদিবাসী জাতি” সংক্রান্ত কোন সুনির্দিষ্ট ও সর্বসম্মত সংজ্ঞা ছাড়া। কিন্তু আদিবাসী জাতিসমূহের অধিকার রয়েছে যে, তারা তাদের প্রথা ও রীতি অনুসারে তাদের নিজস্ব পরিচিতি বা জাতিগোষ্ঠীর সদস্যপদ নির্ধারণ করতে পারবে [ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ৩৩(১)]। এভাবে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও জাতি বলতে “আদিবাসী জাতি”-এর এই সাধারণ প্রত্যয়টি জাতিসংঘ ব্যবহার করে আসছে। তবে আফ্রিকা ও এশিয়ার ক্ষেত্রে আদিবাসী সংজ্ঞা নিয়ে অব্যাহতভাবে আলোচনা হয়ে আসছে। ঘোষণাপত্র গৃহীত হওয়ার পর মানবাধিকার ও জনঅধিকার সংক্রান্ত আফ্রিকান কমিশন অভিমত ব্যক্ত করে যে, “আদিবাসী জাতি” সংক্রান্ত সংজ্ঞা অত্যাবশ্যক নয় বা ব্যবহারযোগ্য নয়, কারণ সর্বসম্মত সার্বজনিন কোন সংজ্ঞা নেই এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যসমূহকে প্রতিফলিত করে এমন কোন একক সংজ্ঞা নেই। তাই আফ্রিকায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের পরিচিহ্নিতকরণে গ্রহণযোগ্য মূল বৈশিষ্ট্যসমূহকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা অধিকতর প্রাসঙ্গিক ও গঠনমূলক হবে বলে আফ্রিকান কমিশন মনে করে। এশিয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে এ ধরনের জনগোষ্ঠীর অবস্থান ও বৈচিত্র্যতা ভেদে এই অভিধা ব্যবহারের ভিন্নতা রয়েছে। যেমন উপজাতি, পাহাড়ি, তফসিলী উপজাতি, জনজাতি, ওরাং ওসলি, মাসয়ারাকাত আদাত, আদিবাসী, জাতিগত সংখ্যালঘু ও জাতিসত্তা ইত্যাদি অভিধা ব্যবহার করা হয়।
শুধু আইনী স্বীকৃতি নয়, নৈতিক ও মনস্তাত্তিক উপাদানের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এই ঘোষণাপত্র গৃহীত হওয়ার পর অস্ট্রোলিয়া ও কানাডা তাদের দেশের আদিবাসী জাতিসমূহের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করে। অস্ট্রেলিয়া সরকারসমূহের আইন ও নীতির ফলে আদিবাসীদের যে ক্ষতি সাধিত হয় তজ্জন্য অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের কাছে অস্ট্রেলিয়া সরকার ক্ষমা প্রার্থনা করে। আবাসিক বিদ্যালয়ের কারণে আদিবাসী শিশু ও পরিবারসমূহের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তজ্জন্য কানাডা সরকার আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং ২০০৮ সালে একটি ট্রুথ এ- রিকনসিয়েলেশন কমিশন গঠন করে।
১. সাংবিধানিক স্বীকৃতি
এই ঘোষণাপত্র অনুসারে বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশে আদিবাসী পরিচিতি ও অধিকার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ২০০৮ সালে গৃহীত ইকোয়েডরের সংবিধানে ইকোয়েডরকে একটি আন্ত:সাংস্কৃতিক, বহুজাতি ও বহুভাষিক দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং আদিবাসীদের ২১টি সমষ্টিগত অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়। ২০০৯ সালে বহুজাতিক বলিভিয়ার সংবিধানে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও স্বশাসিত সরকার ব্যবস্থাসহ আদিবাসীদের অধিকার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ২০১৪ সালে কোষ্টারিকাকে একটি “বহু-জাতিসত্তা ও বহুজাতি” দেশ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য এবং জাতীয় আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণ ও চর্চার নিমিত্ত সাংবিধানিক গ্যারান্টির প্রদানের জন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়। ২০১৪ সালে আদিবাসীদের স্বীকৃতি এবং আদিবাসী পরিচিতি সংরক্ষণ ও উন্নয়নে আইন প্রণয়নের জন্য এল সালভাদর দেশের সংবিধান সংশোধন করে। ২০১৭ সালে দেশের সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসীদের আভ্যন্তরীণ স্বশাসিত সরকারের মাধ্যমে আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করে মেক্সিকো।
২০১৪ সালে নিকারাগুয়া আটলান্টিক উপকূলের আদিবাসী ও জাতিসত্তাসমূহের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের অনুচ্ছেদ দেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত করে। ২০১০ সালে কেনিয়া দেশের সংবিধানে আদিবাসী হিসেবে স্বীকার না করলেও পশুপালক ও শিকারী জাতিসমূহকে যারা নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে পরিচিতি প্রদান করে তাদের অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করে। আইএলও-এর আদিবাসী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠী কনভেনশন নং ১৬৯ অনুসারে চিলি আদিবাসীদের অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিতকরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যা- আদিবাসীদের স্বীকৃতি প্রদানে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ না করলেও মায়ারমারও “জাতীয় নৃগোষ্ঠী” উল্লেখ করে (যারা নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে) তাদের কিছু অধিকার সংবিধানে স্বীকৃতি দিয়েছে। নেপাল তার নতুন সংবিধানে আদিবাসী জাতিসমূহকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং পার্লামেন্টে আদিবাসী আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে।
২. আইনী ও নীতি সংক্রান্ত পদক্ষেপ
বলিভিয়া ২৬ জুন ২০০৮ এর আইন নং ৩৮৯৭ গ্রহণ করে যেখানে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রকে জাতীয় আইন হিসেবে গৃহীত হয়। কলোম্বিয়া ২০১১ সালের ক্ষতিগ্রস্ত ও ভূমি পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত আইনে আদিবাসীদের সাথে পরামর্শ করার বাধ্যবাধকতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৮ সালে জাপান আইনু জনগোষ্ঠীকে হোক্কাইদোর আদিবাসী জাতি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০১১ সালে কঙ্গো আদিবাসীদের অধিকার ত্বরান্বিতকরণ ও সুরক্ষা সংক্রান্ত আইন নং ৫-২০১১ পাশ করে।
ইন্দোনেশিয়ার সাংবিধানিক আদালত ইহার এক রায়ে (নং ৩৫/পিইউইউ-এক্স/২০১২) প্রথাগত বন আর রাষ্ট্রীয় বন হিসেবে থাকবে না বলে নির্দেশনা দেন, যার বদৌলতে আদিবাসীরা তাদের বসবাসরত ভূমি ব্যবস্থাপনার অধিকার লাভ করে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি অধিকার সংক্রান্ত এক মামলার রায়ে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের সূত্র উল্লেখ ও বিশেষভাবে উদ্ধৃতি প্রদান করেছে। ২০১২ সালে ফিলিপাইনের আদিবাসী বিষয়ক জাতীয় কমিশন স্বাধীন ও পূর্বাবহিত পূর্বক সম্মতি ও সংশ্লিষ্ট নীতিমালার গাইডলাইন সংশোধন করে এবং আদিবাসীদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত পূর্বক সম্মতির অধিকার অন্তর্ভুক্ত করে।
এভাবে বিভিন্ন দেশে ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিকার, সিদ্ধান্ত-নির্ধারণে অংশগ্রহণের অধিকার, পরামর্শ ও সম্মতির অধিকার, মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকার, সর্বোচ্চ মানে স্বাস্থ্যসেবা এবং আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী ঔষধি ও চিকিৎসার অধিকার, আদিবাসী নারী ও শিশুদের অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
ঘ. বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা
বাংলাদেশ সরকার “আদিবাসী” নামে আদিবাসী জাতিসমূহের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। ২০০৭ সালে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র গৃহীতকরণের সময় অন্যান্য ১০টি রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশও ভোট দানে বিরত থাকে। ভোটদানে বিরত থাকা কয়েকটি রাষ্ট্র পরবর্তীতে এই ঘোষণাপত্রকে সমর্থন দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও বাংলাদেশ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন প্রদান করেনি। ভোটদানে বিরত থাকার বিষয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের প্রতিনিধি ইশরাত জাহান আহমেদ যুক্তি দেখান যে, বাংলাদেশ মিশন যে কোন অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের প্রতি সমর্থন করে। বাংলাদেশ প্রধান প্রধান সকল মানবাধিকার চুক্তির প্রতি অনুগত রয়েছে এবং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সমর্থন করে। কিন্তু এই ঘোষণাপত্রে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে, বিশেষ করে ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী’ সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি বা সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হয়নি। অধিকন্তু ঘোষণাপত্রের উপর সকল সদস্য-রাষ্ট্রের মধ্যে সর্বসম্মত সমর্থন নেই। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ ভোট দানে বিরত থাকে বলে তিনি জানান।
‘যে কোন অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের প্রতি সমর্থন করে’ বলে তৎসময় বাংলাদেশ মিশন উল্লেখ করলেও বাংলাদেশের আদিবাসীদের যথাযথ সাংবিধান স্বীকৃতির বেলায় বাংলাদেশ বরাবরই উপনিবেশিক ভূমিকা প্রদর্শন করে চলেছে। তবে বর্তমান সরকারের আমলে বিগত ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং বর্তমানে চলমান ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন, আইএলও’র কনভেনশন নং ১৬৯ অনুস্বাক্ষর করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ রয়েছে। ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আদিবাসীদের বিষয়ে রূপকল্পে তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিতকরণ; নিরাপত্তা ও মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান; তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি সুরক্ষা ও সংরক্ষণ করার বিষয়গুলো উল্লেখ রয়েছে। আদিবাসীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য ও পুষ্টি, কর্মসংস্থান এবং ভূমি ও অন্যান্য সম্পদের উপর তাদের অধিকার সুরক্ষার কথাও উক্ত রূপকল্পে বলা হয়েছে। তবে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো এখনো পরিকল্পনা ও নীতির মধ্যে রয়ে গেছে। প্রকৃত বাস্তবায়ন থেকে এসব কর্মপরিকল্পনাগুলো এখনো অনেক দূরে অবস্থান করছে।
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র আলোকে কোন কর্মউদ্যোগ দেখা না গেলেও আদিবাসী বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো- ৩০ জুন ২০১১ জাতীয় সংসদে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘২৩ক’ নামে একটি নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজন করে আদিবাসীদের ‘অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের’ বিধান করা।উক্ত ২৩ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “উপজাতি, ক্ষুদ্রজাতিসত্ত্বা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি।- রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।” বিতর্ক বা ত্রুটি সত্ত্বেও এই ‘২৩ক’ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে এটাই প্রথম যেখানে সংবিধানে আদিবাসীদের সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে।
আদিবাসী জনগণ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রদত্ত জাতিগত পরিচিতির অভিধাগুলো “উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়” ইত্যাদি গ্রহণ করেনি। দ্বিতীয়ত: উক্ত সংশোধনীর মাধ্যমে আদিবাসীদের কেবলমাত্র “অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের” স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। বস্তুত: সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিষয়টি বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সুরক্ষার সাথে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, ভূমি অধিকার, সকল ক্ষেত্রে অর্থবহ অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকা এবং স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতির অধিকারসমূহঅবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে। এসব অধিকার ছাড়া পৃথক বা বিচ্ছিন্নভাবে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত হতে পারে না। তাই আদিবাসী সংগঠনগুলো সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আদিবাসী জাতিসমূহের আশা-আকাক্সক্ষা ও দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে আদিবাসী জাতিসমূহের জাতিসত্তা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভূমি অধিকারসহ মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানিয়ে আসছে। উল্লেখ যে, আদিবাসীদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত পূর্বক সম্মতির অধিকারকে এবং আত্মপরিচয়ের অধিকারকে লঙ্ঘন করে সরকার আদিবাসী সংক্রান্ত উক্ত সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে, যা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের সরাসরি লঙ্ঘন বলে বিবেচনা করা যায়।
আদিবাসী সংক্রান্ত বাংলাদেশ সরকারের আরেকটি কার্যক্রম উল্লেখ করা যেতে পারে সেটা হলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০ প্রণয়ন করা। দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে এই আইন প্রণীত হয়েছে বলে প্রস্তাবনায় উল্লেখ রয়েছে। উক্ত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনের তফসিলে ত্রুটিপূর্ণভাবে কেবলমাত্র ২৭টি জাতির নাম উল্লেখ রয়েছে। আদিবাসীদের মতে দেশে ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতি রয়েছে। ফলে প্রায় অর্ধেকাংশ আদিবাসী জাতি উক্ত তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়। বাদপড়া জাতিসমূহ নানাভাবে হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ তালিকার কারণে গত ২০১১ সালের আদমশুমারীতে আদিবাসীদের প্রকৃত জনগণনা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়নি এবং বাদপড়া জাতিসমূহ প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের বিশেষ কার্যাদি বিভাগের উন্নয়ন সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। তবে সম্প্রতি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক আদিবাসী জাতিসমূহের চিহ্নিতকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে এই তালিকা এখনো গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়নি। ২০১০ সালে এই আইন প্রণয়ন কালেও সরকার আদিবাসী জাতিসমূহের সাথে যথাযথ ও অর্থবহ পরামর্শ ও মতামত গ্রহণ করেনি, যা আদিবাসীদের অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী অধিকারের লঙ্ঘন বলে নি:সন্দেহে বলা যায়।
আদিবাসীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে নীতিগত বিষয়ে সরকারি কার্যক্রমের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষা নীতিতে আদিবাসী বিষয়ে বিশেষ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা। শিক্ষা নীতিতে উল্লেখিত ‘আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষা শিখতে পারে সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে’ এই বক্তব্য বেশ বিভ্রান্তিমূলক। কারণ আদিবাসীরা পরিবারের মধ্যে নিজেদের ভাষা শিখে থাকে। তাদের প্রয়োজন হচ্ছে ‘নিজেদের ভাষায় শিক্ষা’ গ্রহণের সুযোগ প্রদান করা। কিন্তু নীতিতে মাতৃভাষায় শিক্ষার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে আসেনি। অধিকন্তু শিক্ষানীতির এই পরিকল্পনাগুলো এখনো নীতিমালাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এখনো তা বাস্তবায়নের মুখে দেখেনি। বাংলাদেশ কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত আইএলও কনভেনশন নং ১০৭ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭-এওআদিবাসী শিশুদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের বিষয়টি স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু আদিবাসী ছেলেমেয়েদের নিজস্ব মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ থেকে এখনো বঞ্চিত। সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার পদ্ধতি প্রচলনের উদ্যোগ হিসেবে এ বছর ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি ভাষাসহ দেশের মোট পাঁচটি আদিবাসী ভাষায় প্রায় ২৫ হাজার ছাত্রছাত্রীর জন্য ৫০ হাজার বই ছাপিয়ে বিলির ব্যবস্থা করেছে। সরকারের এই কর্মপ্রয়াস প্রসংশনীয় হলেও বস্তুত সরকারের এই উদ্যোগ ছিল দায়সারা গোছের ও পরিকল্পনাহীন। ফলে অনেক আদিবাসী ছাত্রছাত্রী মাতৃভাষার বই পায়নি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাবে উক্ত মাতৃভাষার বই পড়ানোর ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
আদিবাসীদের প্রথাগত আইন, রীতি ও পদ্ধতি স্বীকৃতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অন্যতম উদাহরণ হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬। এই আইনে ‘কমিশনের কার্যাবলী ও ক্ষমতা’ সংক্রান্ত ৬ ধারায় “(১) কমিশনের কার্যাবলী নিম্নরূপ হইবে, যথা:- (ক) পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ এবং অবৈধ বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা; (খ) আবেদনে উল্লেখিত ভূমিতে আবেদনকারী, বা ক্ষেত্রমত সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষের, স্বত্ব বা অন্যবিধ অধিকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নির্ধারণ এবং দখল পুনর্বহাল; (গ) পাবর্ত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বহির্ভূতভাবে জলেভাসা ভূমিসহ (ঋৎরহমব খধহফ) কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান বা বেদখল করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিলকরণ এবং বন্দোবস্তজনিত বা বেদখলজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল” মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৬ সালে সেপ্টেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা হলেও কমিশনের কার্যবিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়ায় এখনো ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিচারিক কাজ শুরু করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক ভূমি কমিশনের কার্যবিধিমালার খসড়া তৈরি করে ১লা জানুয়ারি ২০১৭ সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছিল। বর্তমানে সেই খসড়া কার্যবিধিমালা ভূমি মন্ত্রণালয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া সরকার এখনো ভূমি কমিশনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, জনবল নিয়োগ এবং রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় শাখা অফিস স্থাপনের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে বিধান করা হয়েছে, চুক্তি মোতাবেক এসব পরিষদে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভূমি সংক্রান্ত কার্যাবলী হস্তান্তর করা এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের ভোটার তালিকা প্রণয়ন পূর্বক এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা; ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনা শাসনসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা, আঞ্চলিক পরিষদের আলোচনা ও সম্মতিক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেটেলার বাঙালিদের সরিয়ে নেয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো বাস্তবায়ন বিষয়ে সরকার অব্যাহতভাবে গড়িমসি করে চলেছে। ৬ষ্ঠ ও ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের যে প্রতিশ্রতি ব্যক্ত করা হয়েছে এটা তার সরাসরি বরখেলাপ এবং সরকারের উল্টো অবস্থান বলে বিবেচনা করা যায়।
ঙ. উপসংহার
গবীর জনগোষ্ঠীর মধ্যে আদিবাসীরা সবচেয়ে বেশি গবীর। তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে দরকার আর্থ-সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান। অথচ আদিবাসীদের বিষয়ে সরকারের কাছে কোন পৃথক পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশ সরকার সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) এর অর্জনকে কাজে লাগিয়ে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নেও জাতীয় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এসডিজিতে আয়, লিঙ্গগত, জাতিগত, সম্প্রদায়গত, প্রতিবন্ধী, ভৌগলিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উন্নতমানের, সময়োপযোগী ও নির্ভরযোগ্য তথ্য বা পরিসংখ্যান গড়ে তুলতে রাষ্ট্রসমূহকে আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো আদিবাসীদের জন্য পৃথক কোন পরিসংখ্যানের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ-পেশা নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে এসডিজি বাস্তবায়ন সফল করতে গেলে এবং ‘কাউকে পেছনে ফেলে না রাখা’ Ñ এসডিজির অন্যতম এই স্পিরিট বাস্তব রূপদান করতে চাইলে অবশ্যই এসডিজি বাস্তবায়নে আদিবাসীদেরকে দৃশ্যমান করতে হবে এবং তাদের অর্থবহ অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ক্ষদ্র খাদ্য উৎপাদকদের কৃষি উৎপাদন ও আয় সংক্রান্ত ২.৩ নং লক্ষ্য এবং শিক্ষার সকল স্তরে সমপ্রবেশাধিকার সংক্রান্ত ৪.৫ নং লক্ষ্য সফলভাবে এগিয়ে নিতে চাইলে আদিবাসীদের পৃথক পরিসংখ্যানের ব্যবস্থা করতে হবে। এমডিজি থেকে দেশের আদিবাসীরা সুফল লাভ করেনি। তাদের কাছে পৌঁছেনি এমডিজি সেই কাক্সিক্ষত উন্নয়নের ছোঁয়া। তাই তারা এসডিজি বাস্তবায়নে তাদের অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে চায়। তারা পিছিয়ে থাকতে চায় না। আদিবাসীরাও এসডিজির স্বপ্নযাত্রায় শরীক হতে চায়।
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রে চারটি মূলনীতি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সেগুলো হলো- (১) আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার; (২) সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী প্রক্রিয়া অংশগ্রহণ, যা স্বাধীন ও পূর্বাবহিত পূর্বক সম্মতি ও সরল বিশ্বাসের নীতিতে পরিচালিত; (৩) সংস্কৃতির প্রতি সম্মানপ্রদর্শন ও সুরক্ষা; এবং (৪) সমতা ও বৈষম্যহীনতা। আদিবাসী জাতিসমূহের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই চারটি মূলনীতি ভিত্তিতে অগ্রসর হতে হবে যা জাতিসংঘের সদস্য-রাষ্ট্রসমূহকে সর্বদা বিবেচনায় রাখতে হবে। এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার আদিবাসী জাতিসমূহকে ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা’, ‘নৃ-গোষ্ঠী’ ও ‘সম্প্রদায়’ যেই নামে অভিহিত করুক না কেন, জাতিসংঘের সদস্য-রাষ্ট্র হিসেবে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রে সন্নিবেশিত অধিকার বাস্তবায়নে সরকারের দায়বদ্ধতা রয়েছে।
তারিখ: ৫ আগস্ট ২০১৭
তথ্যসূত্র:
1. THE UN DECLARATION ON THE RIGHTS OF INDIGENOUS PEOPLES: MONITORING AND REALIZING INDIGENOUS RIGHTS IN CANADA, TERRY MITCHELL AND CHARIS ENNS, Policy Brief No. 39, CIGI, April 2014.
2. Implementing the United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples at the local level: Gugu Badhun Self-Determination, Janine Gertz, College of Arts, Society & Education, James Cook University, Townsville, QLD 4811, 23-26 November 2015.
3. Tenth anniversary of the United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples: measures taken to implement the Declaration, Note by the Secretariat, Permanent Forum on Indigenous Issues, Sixteenth session, New York, 24 April-5 May 2016, Economic and Social Council, (E/C.19/2017/4).
4. PFII Reports on Implementing UNDRIP, 2030 Agenda, 8 February 2017.
5. Implementing the Policy of the U.N. Declaration on the Rights of Indigenous Peoples, Roxanne T. Ornelas, Miami University, Ohio, [email protected], The International Indigenous Policy Journal, Volume 5, Issue 1, Article 4, January 2014.
6. দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক : অর্জন ও বাংলাদেশের আদিবাসীদের অবস্থা, মঙ্গল কুমার চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও কাপেং ফাউন্ডেশন, আগস্ট ২০১৫।
7. National Seminar on Indigenous Peoples in Bangladesh: Human Rights and Sustainable Development Goals, Raja Devasish Roy and Mangal Kumar Chakma, Bangladesh Indigenous Peoples Forum, 10 December 2015, Hotel Lakeshore, Dhaka.
8. Update on indigenous peoples and the 2030 Agenda, Note by the Secretariat, Permanent Forum on Indigenous Issues, Economic and Social Council, 8 February 2017, (E/C.19/2017/5).

Back to top button