আঞ্চলিক সংবাদ

দুই বছর ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে মানবেতর জীবন যাপন করছে দীঘিনালার ২১ আদিবাসী পরিবার

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি।।
টানা দুই বছর কৃষি অধিদপ্তরের একটা পরিত্যক্ত ভবনে মানবেতর জীবন যাপন করছেন দীঘিনালার উচ্ছেদ হওয়া ২১ আদিবাসী পরিবার । ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, রাষ্ট্র তাঁদের বাস্তুভিটা কেড়ে নিয়েছে এবং পুনর্বাসনও করে দিচ্ছে না।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ৫১ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)’র চার নম্বর সদর দপ্তর স্থাপনের কারণে উচ্ছেদ হওয়া ২১ চাকমা আদিবাসী পরিবার প্রায় দুই বছর ধরে একটি আশ্রয় কেন্দ্রে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এ নারকীয় জীবন যাপন থেকে মুক্তি পেতে চান তাঁরা। কিন্তু দুই বছর ধরে মিডিয়ায় একটু-আধটু সংবাদ ও জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের মিথ্যা আশ্বাস ছাড়া কিছুই পাননি তাঁরা। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মুক্তি ও স্ব স্ব বাস্তুভিটা ফিরে পেতে দুই বছরে মন্ত্রী-এমপি, চেয়ারম্যান-ডিসি সবখানে কড়া নাড়তে স্মারকলিপি, আবেদন, সংবাদ সম্মেলন, পদযাত্রা, মিছিল, বিক্ষোভ-সমাবেশ সবকিছু করেছেন উচ্ছেদকৃতরা। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। বরং ২০১৫ সালের ১৫ মার্চের শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় সেনাবাহিনীর হামলা ও মামলার শিকার হয়েছেন তাঁরা।

সর্বশেষ চলতি বছরের ২৯ মার্চ ক্ষতিপূরণসহ নিজেদের বাস্তুভিটায় পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবার ও দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটির উদ্যোগে এক মতবিনিময় সভা করা হয়েছে। এ সভায় দীঘিনালার ৫৪টি গ্রামের প্রধানরা(কার্বারী) উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে একই দাবিতে ২৫ মার্চ দীঘিনালা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করা হয় ও ২২ মার্চ জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি দেয়া হয়। দীঘিনালা উপজেলা পরিষদ’র চেয়ারম্যান নবকমল চাকমা জানান, ২১ পরিবারকে পুনর্বাসন করার উদ্দেশ্য ২০১৫ সালের নভেম্বরে সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার নির্দেশে সাত সদস্য বিশিষ্ট জমি নির্বাচন কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির সিদ্ধান্তে একটি কর্মপরিকল্পনাও নেয়া হয়েছিল। পরিবার প্রতি এক একর জমি, প্রতি পরিবারকে ২১বাই ২৪ ফুট আয়তনে চার কক্ষ বিশিষ্ট বাড়ি, বাড়ির সাথে টয়লেট, নলকূপ, রান্নাঘর নির্মাণ এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ সাড়ে তিন লক্ষ টাকা প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত হয় মামলা প্রত্যাহার, সংশ্লিষ্ট গ্রামের জেতবন বৌদ্ধ বিহারটি পুনঃনির্মাণ, যাতায়াতের জন্য প্রধান সড়ক হতে সৃষ্ট নতুন গ্রাম পর্যন্ত ইটসলিং রাস্তা নির্মাণ ও ব্যাটালিয়নের অধিগৃহীত ১০জন রেকর্ডভূক্ত জমির মালিকদের এককালীন ক্ষতিপূরণ প্রদান। কিন্তু অজানা
কারণে সাংসদ কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এ গৃহীত সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়ান বলে জানান চেয়ারম্যান নবকমল চাকমা।

পুনর্বাসনের ব্যাপারে, দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) ড. মোহাম্মদ শহীদ হোসেন চৌধুরী জানান, চলতি বছরের ২২ মার্চে জেলা প্রশাসক দীঘিনালা সফরে গিয়ে উচ্ছেদকৃত ২১ পরিবারের বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন পাঠাতে বলেছেন। কিন্তু সময় হয়ে না উঠায় তিনি এখনো ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যেতে পারেননি। তবে তিনি আন্তরিকতার সাথে যথাশিগগির প্রতিবেদন পাঠাবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।
সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকলে এ সমস্যা আরো আগে সমাধান করা সম্ভব ছিল বলে মন্তব্য করেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান নবকমল চাকমা।
ক্ষতিগ্রস্তদের একজন কার্বারী সন্তোষ কুমার চাকমা জানিয়েছেন, তাঁদের ধৈর্য্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গেছে। অবিলম্বে তাঁদেরকে পুনর্বাসন না করলে আমরণ আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন কার্বারী।

উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন ৫১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের চার নম্বর সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য সন্তোষ কার্বারী পাড়া, যত্নমোহন কার্বারী পাড়া ও গোবিন্দ কার্বারী পাড়ার ৪৫ একর জমি প্রস্তাব করলে সংশ্লিষ্ট গ্রামে উচ্চ আদালতে রিট মামলা দায়ের করেন। পরে জেলা প্রশাসন প্রস্তাবনা থেকে ১০জন রেকর্ডভূক্ত জমি বাদ দিয়ে ২৯ একর জমি অধিগ্রহনের জন্য চূড়ান্ত করে। কিন্তু এলাকাবাসীর দাবি, জায়গাগুলো সম্পূর্ণ বন্দোবস্তকৃত না হলেও তাঁরা ষাটের দশকের আগে থেকে সেখানে বসবাস করে আসছেন।
অবশেষে মামলার শুনানী চলাকালীন ২০১৪ সালের ১০মে গভীর রাতে বিজিবি ব্যাটালিয়ন দীঘিনালা ইউনিয়নের মরা বাঘাইছড়ি এলাকার সন্তোষ কুমার কার্বারী পাড়ায় অনুপ্রবেশ করে তাত্ক্ষনিক অস্থায়ী দপ্তর স্থাপন করলে সমস্যা প্রকট রূপ ধারণ করে। পরেরদিন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন তিনটি আদিবাসী গ্রামের ৪৫ একর জায়গা জোরপূর্বক অধিগ্রহন করে সেখানে বিজিবি’র হেড কোয়ার্টার স্থাপন পাকাপোক্ত করে। সেখানে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী ও পুলিশ। সেনা-পুলিশের প্রহরায় নির্মাণ করতে থাকে দপ্তরের অবকাঠামো।
এর ফলে তিনটি গ্রামের ২১ পরিবার আদিবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ ও উচ্ছেদ আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। বিজিবি ব্যাটালিয়ন স্থাপনের এক মাসের মাথায় ১০ জুন(২০১৪) বিজিবি গ্রামের যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ করে দিলে মহিলাদের সাথে সেনা-পুলিশ সদস্যদের বাক-বিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে মহিলাদের ওপর সেনা-পুলিশ-বিজিবি’র সদস্যরা হামলা করে তাঁদের ঘর-বাড়ি ভাঙ্চুর, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করলে নারীসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়। হামলার পর তিনটি গ্রামবাসীর বিরুদ্ধেও মামলা করে বিজিবি। এ মামলায় কলেজ ছাত্রীসহ ১১জনকে আটক করে
কারাগারে পাঠানো হয়। পরে অবশ্য জামিনে মুক্তি পান তাঁরা। এ হামলা ও মামলায় ২১ পরিবার আদিবাসী অসহায় ও নিরুপায় হয়ে আশ্রয় নেন স্থানীয় বাবুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে কয়েকমাস অবস্থানের পর স্কুল কর্তৃপক্ষের আপত্তির কারণে আশ্রয় নেন পাশের একটি কৃষি অধিদপ্তরের পরিত্যক্ত ভবনে। প্রায় দুই বছর ধরে তাঁরা সেখানে মানবেতর জীবন করছেন বলে জানিয়েছেন, কার্বারী সন্তোষ কুমার চাকমা।

Back to top button