মতামত ও বিশ্লেষণ

তবুও নিতে হবে উজানে যাওয়ার দায়ভারঃ প্রসঙ্গ আদিবাসী তারুণ্য- সতেজ চাকমা

১)
পাহাড়ে আজ প্রতিকূল স্রোত:
সময়টা ভালো নেই। বাংলাদেশে বসবাসকারী ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগণ আজ কঠিন এক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি জুমিয়া আদিবাসী জীবনের নিরাপত্তা দিতে আজ ব্যর্থ। যে শ্বেত কপোত জোড়া ১৯৯৭ এ উড়েছিল রাষ্ট্রের শান্তির প্রতিশ্রতি নিয়ে তা আজ ফিঁকে হতে হতে অশান্তির দাবানল প্রায় উদগিরণের পর্যায়ে। লামা’র ম্রো জনপদে রাবার কোম্পানির হানা। ক’দিন পর রাবার কোম্পানির লোকজন কর্তৃক ঝিরিতে বিষ প্রয়োগের ঘটনা। পাহাড়ে পাঁচ তারকা হোটেল তৈরীর ষড়যন্ত্রে মাতোয়ারা নানা কোম্পানি আর প্রভাবশালী গোষ্ঠী। রুমা, আলীকদম, থানচি, নাইক্ষংছড়ি, রোয়াংছড়িসহ যে জুমিয়া জনপদগুলোর আদিবাসী মানুষ ঝিরি-ঝরণার পানির উপর নির্ভর করে এতদিন ধরে লালন করছে নিজেদের স্বীয় সভ্যতা সেখানে আজ পানির তীব্র সংকট। বান্দরবান শহরের অনতিদূরেই তো চিম্বুক জনপদ। পুরো ম্রো সভ্যতার আবাসভূমি। সেখানে এই পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে বলে শুনলাম।

শুধু চিম্বুক কেন! রাঙ্গামাটির বরকল, জুরাছড়ি, সাজেকসহ নানান জায়গায় এই সংকট। এসবের পেছনে কাজ করছে বন উজারকরণ, ঝিরি থেকে পাথর উত্তোলনসহ নানা প্রসঙ্গ। পুরো পাহাড়ের সবুজ’কে আজ ক্রমাগত আক্রান্ত করতে করতে ন্যাড়া বানানো হচ্ছে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে। এই যে আজ মানুষের মুখে মুখে ‘সাজেক’ এর কথা শুনি। এই একখন্ড সাজেকই তো কত কিছুর কথা বলে। ছোটকালে যে সাজেক এর নাম শুনেছি- গহীন এক অরণ্য আচ্ছাদিত জুমিয়া জনপদ হিসেবে। সেখানে সাজেক আজ হাজারো মৌসুমী পর্যটকবাহী গাড়ির হর্ণ আর পর্যটকদের অবকাশ যাপনের চাহিদা পূরণে ব্যস্ত একটি জনপদে পরিণত হয়েছে। মানুষের অবকাশ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে ক্রমশ ন্যাড়া হচ্ছে এই সাজেক। প্রতিদিন হাজারো পর্যটক যাচ্ছে আর আসছে। কিন্তু সেই সাজেকের ভ‚মি পুত্র লুসাইরা আজ ইতিহাসের অন্তরালে। ‘ঐতিহ্যবাহী লুসাই গ্রাম’ নামে একখন্ড জায়গাজুড়ে যে উপহাসের জাদুঘর বানানো হয়েছে সাজেক পর্যটন এলাকায় সেখানে আজ সমতলের বাঙালী বন্ধুরা পর্যটকী বেশে লুসাই ড্রেস পরিধান করে সেলফী ক্যাপচার করছে। শুধু সেলফী আর বাহারী ফ্রেমে ফটো তুলে তারা ক্ষান্ত নন। যারা যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তাঁদের নামাজ পড়ার জন্য দরকার পড়ছে একটি মসজিদের। মসজিদ এই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে খুব পবিত্র স্থান। সাজেকের পাহাড়ে গড়ে উঠল পাকা একটি মসজিদ। প্রথমে রাস্তা গেল। পরে পর্যটক গেল। সেই সাথে এই জনপদে পরিচয় করানো হল এই দেশে আধিপত্য বিস্তার করা ধর্মের একটি প্রতিষ্ঠানকে। এইতো ‘উন্নয়ন’। অথচ এই সাজেক জনপদের মানুষের ভাগ্য আজ বদল হল না। এখনো সাজেকের গহীনে যাপন করা সন্তান সম্ভাবা জুমিয়া নারীকে হাসপাতালের অভাবে হারাতে হচ্ছে তাঁর আসন্ন আগামী নির্মাণের ফুটফুটে বাচ্চাকে। রোগী বহন করতে হচ্ছে কাপড় মুড়িয়ে। অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে দেখুন সাজেকে আজ যেসব রঙিন বাহারী কটেজ গড়ে উঠেছে সেসবের কয়টির মালিকানা স্থানীয় আদিবাসীদের নামে! পর্যটকরা যাচ্ছে, স্থানীয় জুমিয়া আদিবাসীরা কিছু পণ্য ও খাবার ব্রিক্রি করার সুযোগ পাচ্ছে, এই তো লাভবান হচ্ছে- বলে যে যুক্তি বাজারে প্রচলিত আছে তা রীতিমতই সেখানে ভ‚মি দখলের হাজারো প্রয়াস যে চলমান আছে, ক্রমশ আধিপত্যবাদী চক্রান্ত যে খেলা করছে সেটাকেই সুকৌশলে আড়াল করছে। আর দেশান্তরী হচ্ছে লুসাই মানুষ। বাস্তুহারা হচ্ছে সেখানকার ত্রিপুরা জুমিয়ারা। অন্যদিকে উৎযাপনে ব্যস্ত সময় পার করছে সমতলের পর্যটক বেশধারী বাঙালী বন্ধুরা। এই তো চলছে উপহাসের বিচিত্র রকম সার্কাস।

পাহাড়ের সীমান্ত সড়কে’র নাম শুনেছেন? সম্ভবত এই সড়কের বাহারী বিজ্ঞাপন আজ বাজারে আসে আসে অবস্থায় আছে। আহা! খাগড়াছড়ির রামগড়, পানছড়ি, দীঘিনালা; রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল,বিলাইছড়ি; বান্দরবানর রোয়াংছড়ি,রুমা,থানচি, নাইক্ষংছড়ি’র সীমান্ত লাগোয়া এই বিস্তীর্ণ সড়ক তৈরীর কান্ডকারখানা চলছে। আমি যদি ভুল না করি এই সড়কটি তৈরীর দায়িত্ব পেয়েছে পাহাড়ের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে থাকা বাহিনীটি। যদিও ভাশুরের নাম মুখে আনতে নেই। যাইহোক, অনেকেই নানা লেন্স দিয়ে এই সড়টিকে দেখছে। অনেকেই উন্নয়নের গন্ধ পাচ্ছে। তবে কিছুক্ষণে সাজেক এর রঙিন বাহারী কটেজ, আবার ক্ষণিক পরে পাঁচতারা হোটেল, আবার কিছু পরে সীমান্ত সড়কের নামে যে চটকদারী বিজ্ঞাপনগুলো পাহাড়ের বাজারে চলমান রেখেছে শাসকগোষ্ঠী তার কোনোটিই যে সেখানকার জুমিয়া জীবনকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না তা আজ দিবালোকের মত পরিষ্কার। এসব নানা সংকট তুলে ধরলে আজ পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যাবে। তবে এই বলে আজ পাহাড়ের সামগ্রিক বাস্তবতাকে তুলে ধরে পাঠকের মনকে ভারী করতে চাইনা।

২)
সমতলে ভূমি হারানোর যন্ত্রণা:

বেশ ক’দিন আগে পটুয়াখালী গেলাম। কুয়াকাটা নামটির সাথে পরিচয় অনেকের আছে। সেখানকার রাখাইন জনপদের জীবনকে দেখতে এক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে সেখানে যাওয়া। রাখাইনদের পুরাতন বৌদ্ধ বিহারের জায়গা দখলে ব্যস্ত সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড। কুয়াকাটা রক্ষায় যে বেরিবাঁধটি তৈরী করা হয়েছে সেসময়ও বৌদ্ধ বিহারের জায়গা অধিগ্রহন করা হয়েছে বলে আমাদেরকে শুনালেন ষাটোর্ধ লুমা রাখাইন। তিনি বলছেন, সামগ্রিক মঙ্গলের কথা ভেবে আমরা বেরিবাধ নির্মাণের সময় আমাদের জায়গা ছেড়েছি। এখন আবার বেরিবাঁধ লাগোয়া যে বটবৃক্ষটি আছে, সেখানে যে পবিত্র চৈত্যটি রাখাইনরা পূজা করেন তা দখলে নিতে চায় উল্লিখিত বোর্ড। পানি উন্নয়ন বোর্ডের চালাকি আমার কাছে বেশ চমকপ্রদ লেগেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এই জায়গাটিতে প্রেস ক্লাব নির্মাণের জন্য সাংবাদিকদের কাছে লীজও দিয়েছে। একটি বিলুপ্তপ্রায় জনগোষ্ঠীকে তাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে সাংবাদিকদের। যারা নাকি সমাজের দর্পন। এই সাংবাদিকদের উপর স্থানীয় রাখাইন মহিলা মার্কেট এর সাধারণ সম্পাদক লুমা রাখাইন এর আক্রোশ আমার কাছে বেশ লক্ষণীয় বলে মনে হয়েছে। আমাদের প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আমার প্রিয়ভাজন অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস স্যার স্থানীয় সাংবাদিক নেতাদের বললেন, “সাংবাদিকরা যুগে যুগে নিপীড়িতের পক্ষ নিয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম চালিয়েছে। কিন্তু এটা যদি করা হয় তাহলে আপনারা (সাংবাদিকরা) কলঙ্কিত হবেন।”

শুধু কী বৌদ্ধ বিহারের ভূমি! নোয়াপাড়া নামে সেখানকার এক রাখাইন গ্রামের শশ্মান দখলে নিয়েছে স্থানীয় দুই প্রভাবশালী বাঙালি পরিবার। শশ্মান ঘুরে দেখলাম। শশ্মান বলে মনে হয়নি আমার। দখলকারীরা বৃক্ষ রোপন করেছে। কেবল সদ্য পুঁতে ফেলা একজন মৃত রাখাইন ব্যক্তির কবর চোখে পড়ল। জানলাম সেই ব্যক্তির লাশ শশ্মানে নেওয়ার পথেও নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে স্থানীয়দের। যেন মরেও শান্তি মিলছে না এই এলাকার ভ‚মি পুত্রদের। সেই অঞ্চলে গত শতকের ষাটের দশকে ষাট-সত্তর হাজার রাখাইন আদিবাসী ছিল। আজ তারা আড়াই হাজারে নেমে এসেছে। ভাবা যায় ?

কেবল কী রাখাইন মানুষরা ভালো নেই? গত জুলাইয়ে এক গবেষণার কাজে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। পুটিয়াবুনিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যেই একটি চাকমা গ্রাম। এই গ্রামে ৩০ টি চাকমা পরিবারের বাস। তাদেরকে ঘিরে আছে ২২ হাজার রোহিঙ্গা। তারা বলছে, প্রতিনিয়ত নানা উৎপীড়নের মধ্যেই চলছে তাঁদের জীবন। কাটাখালী নামে আরেকটি গ্রামে যাওয়া হল। সেখানের বয়োবৃদ্ধরা বলছে তারা চাকমা। কিন্তু তরুণ যুবা’রা বলছে তারা তঞ্চঙ্গ্যা। তাদের মধ্যেও দেখলাম এই পরিচয় নিয়ে আন্ত: প্রজন্মের বিতর্ক জারী আছে। এই গোবেচারা’রাও সংখ্যায় খুব বেশি নয়। কয়েক পরিবারের এই বিচ্ছিন্ন আদিবাসী জনপদটি মুল ধারার বাঙালি বেষ্টিত। তারা বিচ্ছিন্ন ছিল না, তাদের ভূমি দখল করতে করতে ক্রমাগত বিচ্ছিন্নই করে ফেলা হয়েছে বলে তাদের দাবি।

এদিকে গত বছরের (২০২২) অক্টোবরে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে গিযে প্রত্যক্ষ করে এলাম অভিলিয়া হেমব্রম এর চোখের জল। মূলত গোবিন্দগঞ্জে ২০১৬ সালের নভেম্বরে যে সান্তালদের উচ্ছেদ করে তিনজন সান্তালকে হত্যা করা হল এবং কয়েকজনকে আহত করা হল, আখ চাষের কথা বলে সেখানকার সান্তালদের ভ‚মি দখল করা হয়েছিল তা ফেরত দিতে যে সান্তাল ও সাধারণ বাঙালিরা সংগ্রাম করছে তাঁদের খবর নিতেই সেখানে যাওয়া। সেবারই কথা হল অভিলিয়া হেমব্রমের সাথে। অভিভিয়া দ্বিজেন টুডু’র স্ত্রী। দ্বিজেন টুডু হলেন সেই ২০১৬ সালে পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো এক অভাগা । আমরা অলিভিয়া দি’ কে প্রশ্ন করলাম- ‘দ্বিজেন দা এখন কেমন আছেন?” মুখ থেকে উত্তর না বেরুতেই চোখ ফেটে এল জল। গাল বেয়ে গড়িয়েই পড়ল মাটিতে। অলিভিয়া হেমব্রম বলছেন- দ্বিজেন টুডু এখন আর কাজ করতে পারে না। চোখের যন্ত্রণায় ঘুম হয় না। সংসারের ঘানি টানার দায়িত্ব এখন এই অলিভিয়া হেমব্রমের ঘাড়ে। কঠিন এক সংগ্রামের সাথে চলছে জীবন। সাথে দুই বাচ্চার পড়ালেখার খরচ যোগানো। এদিকে ফেরত পাওয়া হল না বাপ-দাদার সেই বাস্তুভিটা। তাই জীবন আজ নিরাপত্তাহীন।

আমার দৃষ্টি এবার সিলেট, মৌলভীবাজারের দিকে নিক্ষেপ করি। সেখানেও খাসি জীবন ক্রমশ দেশান্তরী হওয়ার পথে। বহু খাসি পরিবার পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। যারা আছে তারাও আজ নানা যন্ত্রণায় যাপন করছে জীবন। সেখানকার ব্যবসায় জড়িত চা কোম্পানির লোকজন কিছুক্ষণে খাসি পুঞ্জির রাস্তা বন্ধ করছে, আবার কোথাও কোথাও পান জুমে রোপিত পান গাছ কেটে খাসিদের ছন্নছাড়া করছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। নিদারুণ উৎপীড়নের মধ্যে কী স্বপ্ন দেখা যায়? নাহার খাসি পুঞ্জি, লাউয়াছড়া খাসি পুঞ্জি, মুড়ইছড়া পুঞ্জিসহ নানা পুঞ্জি তাই আজ প্রায়শই খবরের শিরোনাম হয়ে সংবাদ পত্রের পাতায় ফিরছে বারে বারে। নিরাপত্তাহীন ও বিচারহীন এইসব জীবনের যাপন যেন গন্তব্যহীন ভাবে ছুটছে। সমগ্র উত্তরবঙ্গ, পটুয়াখালীর রাখাইন জনপদ, কক্সবাজারের রাখাইন ও চাকমা পল্লী কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের সাজেক, নাইক্ষংছড়ি বা থানচির ম্রো জনপদ সমস্ত ক্ষেত্রেই নিরাপত্তাহীন অবরুদ্ধ জীবনকে সাথী করেই চলছে প্রান্তজনের যাপন।

৩)
তবুও নিতে হবে উজানে যাওয়ার দায়ভার:

আদিবাসীদের গানের দল ‘মাদল’ এর একটি গানের কলি সম্ভবত এরকম- “কত প্রহর পেরুলে তবে, এই জীবন রঙিন হবে? হাসবে খেলবে আদিবাসী মেয়ে দিধাহীন নির্ভয়ে”। এই গানটির মধ্যে যে দিধাহীন নির্ভয় জীবনের স্বপ্ন লালন করা হয়েছে তা যেন ক্রমশ আড়াল হচ্ছে নানা নিপীড়ন আর প্রতিদিনকার সম্মুখীন নিদারুণ যন্ত্রণার করুণ আধিপত্যে। একজন এ প্রজন্মের আদিবাসী তরুণ হিসেবে গভীর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে ভেবেছি, উপরোক্ত সকল বাস্তবিক ঘটনা প্রবাহ কী নতুন কিছু? বোধদয় হওয়ার পর থেকেই তো দেখে এসেছি এইসব নানা ঘটনা। হয়ত সেসব নানান রূপ নিয়ে বারংবার হাজির হয়ে আঘাত করেছে আদিবাসী জীবন ও জগৎকে। কিন্তু এইসবের বিপরীতে দাড়িয়ে প্রতিরোধ গড়বে কারা? যুগে যুগে দেখা গেছে প্রজন্মের তরুণরাই দাড়িয়েছে আর গড়েছে প্রতিরোধের বুহ্য। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে আদিবাসী যুবা’দের প্রতিরোধ ততই নুয়ে পড়ছে বলে আমার পর্যবেক্ষণ বলছে। আজ যেখানে প্রজন্মের আদিবাসী তরুণরা এই তাদের নিত্যদিনকার সমস্যা সংকুল জীবনকে বাতলে দেওয়ার জন্য স্বপ্ন দেখবে, লড়াইয়ে সামিল হবে সেখানে ভোগবাদী বিলাসীদের বৈভবে যেন হারিয়েই যাচ্ছে প্রজন্ম।

একটি বাস্তর উদাহরণকে সামনে নিয়ে আসতে চাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কিছু তথাকথিত ভিডিও ভøগার তৈরী হয়েছে। তাদের কাজ পাহাড়ের সৈন্দর্য্য তুলে ধরে, রঙিন বাহারী কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে কিছু কামাই করা। হ্যাঁ আমাদের জীবনটা আসলে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে সেরকমই হওয়ার কথা ছিল। প্রযুক্তির সাথে সুন্দর মেলবন্ধন ঘটিয়ে পাহাড়ের জীবনকে সেভাবে রঙিন করে উপস্থাপনের কথা ছিল আমাদের। কিন্তু তা কী হতে পারছে? আমাদের প্রজন্মের ভøগাররা যদি ভিডিও বানাতেন সাজেকের প্রত্যন্তে জীর্ণ পড়ে থাকা বিদ্যালয়টির করুণ বাস্তবতা নিয়ে, রোয়াংছড়ির গহীনে শঙ্খমনি পাড়া নামের তঞ্চঙ্গ্যা পাড়াটির সাম্প্রতিক উচ্ছেদের কাহিনী নিয়ে, তার পেছনে তৈরী হওয়া নতুন ডিসকোর্স যদি তাদের ভøগগুলোতে হাজির করা হতো তবে খুব সম্ভব আমাদের জীবন রঙিন হতে সময় নিত না। তবে আজ তারা যা করছে তা যেন আকন্ঠ কর্দমাক্ত থেকেও নিদারুণভাবে তা অস্বীকার করার শামিল বৈ কিছু নয়।

এইতো ক’দিন আগে রাঙ্গামাটিতে জুম্ম আন্ডার গ্রাউন্ড ব্যান্ডগুলোর একটি শো ছিল রাঙ্গামাটি’র সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউটে। প্রায় প্রতিবছর এই ব্যান্ডগুলো নিজেদের সুরে গাইবার আয়োজন করে এবং উদযাপনও করে থাকে। আমারও বেশ আগ্রহ তাঁদের আয়োজন এবং চর্চার অগ্রগতি নিয়ে। নানা মারফতে শুনেছি, তাঁরা এবছর সেটি করতে পারেনি। তাঁদের শো শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রথমে বিদ্যুৎ গেল, পরে বিদ্যুৎ এর সরবরাহ আসলেও তা ছিল খুব ক্ষীণ যা সাউন্ড সিস্টেম চালানোরও অনুপযোগী। পরে হাজির হল গোয়েন্দা বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিরা এবং রীতিমত আয়োজকদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হল যে, এই আয়োজনের পেছনে কোনো অনুমতি নেয়া হয়েছে কী না! খুব সম্ভব কিছু গাইতেও, সুর বাঁধতেও অনুমতি নিতে হচ্ছে পাহাড়ের জুমিয়াদেরকে। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তো দূরের কথা, আমরা কী কোনো মাধ্যমে এই খবর দেখেছি! দু:খজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের প্রতিবাদের ভাষা আজ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তার বদৌলতে প্রজন্মের তরুণদের মগজে স্থান করে নিয়েছে ভোগবাদী দুনিয়ার যত কিছু। যদিওবা আমি নিজেও এই প্রজন্মেরই একজন।

তবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, আলফ্রেড সরেন, গীদিতা রেমা, চলেশ রিছিল, পীরেন স্নাল, কল্পনা চাকমা’দের উত্তর প্রজন্ম হিসেবে এই প্রজন্মের আদিবাসী তরুণরা কিছুতেই পথ হারাতে পারে না। কারণ আমাদেরকে এই রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাই পাই করে বুঝে নেওয়ার এখনো অনেক কিছুই বাকী। আমাদেরকে বুঝে নিতে হবে কল্পনা চাকমা’র অপহরণের ঘটনায় করা মামলা’র শেষ রায়, আলফ্রেড সরেন হত্যার পরিপূর্ণ বিচার। বুঝে নিতে হবে ২০১৬ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর গুলিতে চোখ হারানো দিজেন টুডুর চোখে দেখা বাস্তুভিটা ফিরে পাওয়ার সেই স্বপ্ন। পটুয়াখালীর কলা ও খেপ উ নামের দুই রাখাইন ভাইয়ের হাত ধরে গড়ে ওঠা সেই রাখাইন জনপদের ধ্বংসাবশেষের মধ্যেও দেখতে হবে জীবন বদলের নতুন স্বপ্ন। চারিদিকে সমস্ত ক্ষেত্রেই জীবনের বিরুদ্ধে প্রবাহমান প্রতিকূল স্রোত। তরুণ প্রজন্মের একজন আদিবাসী হিসেবে তবুও আমাদের নিতে হবে উজানে যাওয়ার দায়ভার।


*তরুণ লেখক ও আদিবাসী অধিকার কর্মী।

*লেখাটি বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত ‘সংহতি-২০২৩’ সংখ্যায় প্রকাশিত।

Back to top button