মতামত ও বিশ্লেষণ

ঢাকাস্থ জুম্ম শিক্ষার্থীদের বার্ষিক শীতবস্ত্র বিতরণ প্রসঙ্গে!

মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া জুম্ম শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এবং ঢাকাস্থ জুম্ম শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অকুন্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতায় বিগত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্বলহীন জুম্ম পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য একটি মানবিক প্রচেষ্টা হিসেবে প্রতিবছর একটি বার্ষিক শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এবছরও এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। আমাদের বিনীত অনুরোধ আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী এই উদ্যোগের পাশে দাঁড়ান। এবছর ঢাকাস্থ জুম্ম শিক্ষার্থীদের একটি টিম আগামী ১৫/১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে থানচি পৌছে যাবে। আমরা থানচির বিভিন্ন ম্রো পাড়ায় স্কুলগামী শিশুদের জন্য শিক্ষা উপকরণ এবং সোয়েটার এবং আমাদের এই উদ্যোগের সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু পরিবারের জন্য পরিবারপতি ১পিস বা ২ পিস করে কম্বল নিয়ে যাবো। আমরা আশা করি ঢাকাস্থ জুম্ম শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক এবং আপামর মানবতাবাদী মানুষ আমাদের এই উদ্যোগের পাশে দাঁড়াবেন।

প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তখনকার জুম্ম শিক্ষার্থীরা প্রথম এধরনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই উদ্যোগের মূল স্পিরিট টা হলো “দিতে যাওয়া নয়, নিতে যাওয়া”। অর্থাৎ কেবলমাত্র শীতবস্ত বিতরণ করে মানবতাবাদী সাজার জন্য দুএকটি ছবি তুলে আসা এই উদ্যোগের টার্গেট নয়। এই উদ্যোগের পেছনে যে ভাবনা কাজ করে তা হচ্ছে- বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত জুম্ম শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা পারষ্পরিক যোগাযোগের সেতুবন্ধ রচনা করা এবং জুম্ম শিক্ষার্থীদের চেতনায় ও মননে ফেলে আসা শেকড়ের প্রতি দ্বায়বোধ বাড়ানোর জন্য জুম পাহাড়ের প্রকৃত “জুমিয়া সংস্কৃতি” থেকে শিক্ষা নিয়ে আসা, যা পরবর্তীতে জুম্ম শিক্ষার্থীদের পেশাগত জীবনেও জুম পাহাড়ের প্রতি, শেকড়ের প্রতি যে দ্বায় ও অঙ্গীকার সেটাকে নির্যাস দিয়ে যাবে।

২০০৭ সালের দিকে যখন এই উদ্যোগটি শুরু হয়, তখন উদ্যোগটির অগ্রভাগে ছিলেন সাবেক ঢাবি শিক্ষার্থী পল্লব চাকমা বর্তমানে কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক। পরবর্তীতে ২০০৮, ২০০৯, ২০১০, ২০১১ ধারাবাহিকভাবে এই উদ্যোগটিকে যারা চলমান রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে আজ অনেকেই স্ব-স্ব অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। এই উদ্যোগটিকে যারা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন- সাবেক ঢাবি শিক্ষার্থী রিগ্যান চাকমা- বর্তমানে ইউল্যাব এর শিক্ষক, সাবেক ঢাবি শিক্ষার্থী ও পিসিপির সাবেক সভাপতি- বাবলু চাকমা ও ত্রিজিনাদ চাকমা, তখনকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বর্তমানে বিসিএস কাস্টমস প্রণয় চাকমা, সাবেক ঢাবি শিক্ষার্থী সুবল চাকমা(বর্তমানে বিসিএস এডমিন), সাবেক ঢাবি শিক্ষার্থী সত্তম চাকমা, (বর্তমানে বিসিএস বেতার), সাবেক ঢাবি শিক্ষার্থী অম্লান চাকমা (বর্তমানে বিসিএস শিক্ষা), সাবেক ঢাবি শিক্ষার্থী এবং বর্তমান পিসিপির কেন্দ্রীয় সভাপতি জুয়েল চাকমা, সাবেক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুকুল ত্রিপুরা (বর্তমানে রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজের লেকচারার) প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

এই উদ্যোগটিকে বান্দরবানে স্থানীয়ভাবে সমন্বয় করতেন বা আজো অকৃত্রিমভাবে সহযোগিতা দিয়ে যান যিনি তাঁর কথা না বললেই নয়, মিউচিং মারমা বা আমাদের মিউচিং দিদি। তিনি হিল উইমেন ফেডারেশনের সাবেক সভানেত্রী।
(এখানে ববলাবাহুল্য যে, এই উদ্যোগটি মূলত ঢাকাস্থ বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত জুম্ম শিক্ষার্থীদের স্বেচ্চাশ্রমভিত্তিক একটি বার্ষিক উদ্যোগ, তাই প্রচেষ্টা থাকতো বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যযনরত জুম্ম শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব রাখতে। কিন্তু উদ্যোগটিকে সক্রিয় রাখতে মূল ভূমিকা পালন করতে হতো ঢাবি শিক্ষার্থীদের। আরো একটু স্পেসিপিকভাবে মেনশন করলে পাহাড়ী ছাত্র-পরিষদের কর্মীরা এই উদ্যোগটিকে বরাবরই নেতৃত্ব দিয়ে এসছেন স্বচ্চতার সাথে। কিন্তু এই উদ্যোগটিকে কখনোই রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক ব্যানারে উপস্থাপনের প্রয়াস চালানো হয় নি) / (একবার ব্যতিক্রম হয়েছিলো! ২০১৪ সালে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ সাংগঠনিকভাবে এই উদ্যোগটিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে বিধায় সেবছর মূল ব্যানারে পিসিপিকেও উদ্যোক্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।)

যাই হোক, আমি ঢাবিতে আসি ২০১২ সালে। প্রসঙ্গত, ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ঢাবিতে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জুম্ম শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। পাশাপাশি সমতল থেকেও রেকর্ডসংখ্যক আদিবাসী শিক্ষার্থী ভর্তি হয় সেবছর। পাহাড়-সমতল মিলে আমরা প্রায় ৬০/৬২ জন আদিবাসী শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলাম সেবছর। আমরা ক্যাম্পাসে আসার পরপরই অগ্রজদের দেখে দেখে যাবতীয় রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কাজগুলো রপ্ত করতে শিখি। কীভাবে স্লোগান মারতে হয়, কীভাবে প্রেস রিলিজ লিখতে হয়, কীভাবে ব্যানার লিখতে হয় এবং অবশ্যই কীভাবে চাঁন্দা চাইতে হয়

পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্রসমাজের বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে আমরা ঢাবি জুম্ম শিক্ষার্থী ব্যাচ ২০১১-১২ ক্যাম্পাসে আমাদের শুরু থেকেই চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি আমাদের দ্বায়িত্ববোধ যথাযথভাবে পালন করে যেতে। আমাদের ব্যাচ মূল্যবোধ ঢাবি জুম্ম শিক্ষার্থীদের ইতিহাসে কীভাবে মূল্যায়িত হবে তা বলা আপাতত কঠিন, তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার পর্যবেক্ষণে আমি যা দেখেছি, প্রথমত আমাদের প্রচেষ্টা ছিলো ব্যাচ ইউনিটি, দ্বিতীয়ত আমরা ব্যক্তিক সর্বোচ্চ বিকাশের পাশাপাশি সর্বদা সামাজিক দ্বায়বোধের কাছে নিজেদের সঁপে দিতে চেয়েছিলাম, তৃতীয়ত আমরা বরাবরই স্বপ্ন দেখেছি জীর্ণকে সংস্কার করার, অনুপস্থিতকে সৃষ্টি করার এবং সম্ভবনাকে বিকশিত করার!

ইতিমধ্যে ক্যাম্পাসে ৫ বছর পেরিয়ে গেছে। তাই ঢাবি শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর যেসমস্ত রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উদ্যোগগুলো নিয়ে থাকে সেগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা। যাবতীয় সকল কর্মকান্ডগুলোর মধ্য থেকে আমার কাছে যেটাকে বিশেষ শিক্ষণীয় মনে হয়েছে সেটা হচ্ছে এই বার্ষিক শীতবস্ত্র বিতরণ করার এই প্রোগ্রাম।

আমি দুবার শীতবস্ত্র বিতরণ প্রোগ্রামে যাই। ২০১২ সালে এবং ২০১৩ সালে। ২০১২ সালে অামরা যেবছর ফারুয়া যাই সেবছর আমাদের উদ্যোগের সাথে প্রথমবারের মতন সংহতি জানিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের জুম্ম শিক্ষার্থীরা। ফারুয়া ইউনিয়নের ৯ টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ২৫০ পরিবারের জন্য কম্বল নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা। টিম এ ছিলাম সুবল চাকমা, সায়ন দেওয়ান, সাবেক চবি শিক্ষার্থী জিদিত চাকমা, প্রকট চাকমা, শুভকর চাকমা প্রমূখ।

২০১৩ সালে আমরা গিয়েছিলাম লামা, আলীকদম এবং নাইক্ষংছড়ি। টিম এ ছিলাম সুবল চাকমা, প্রজ্ঞাতেজ চাকমা, প্রকট চাকমা, রুশো চাকমা, শুভকর চাকমা, মিউচিং মারমা, ইডেনের শিক্ষার্থী এসাইনু মারমা প্রমুখ।

কাউকে সহযোগিতা করতে যাওয়া নয় বরং নিজের জীবনের জন্য শিক্ষা অর্জন করতে যাওয়াই এই উদ্যোগটির প্রকৃত উদ্দেশ্য। একজন শিক্ষার্থীর জীবন পরিকল্পনার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে এধরনের উদ্যোগগুলো। অন্তত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি তাই মনে করি। সর্বোপরি জুম্ম জাতীয় জীবনের চলমান নানা সংকটগুলো কাছ থেকে দেখার, পর্যবেক্ষণ করার এবং ব্যক্তিকভাবে নিজের সর্বোচ্চ বিকাশের পাশাপাশি সমাজের মঙ্গলে ভূমিকা নেওয়ার শিক্ষা যেন জুম্ম তরুণরা নিতে পারে সেজন্য এধরনের উদ্যোগগুলো চলমান থাকা জরুরী।

কোন বস্তু বা কোন বিষয়কে সঠিকভাবে বুজতে হলে বা নির্ভুলভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হলে সেই বস্তু বা বিষয়ের সংস্পর্শে আসতে হয়। তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য যারা দেশের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে পড়ালেখা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমাজ-বাস্তবতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং চ্যালেঞ্জ-সম্ভাবনাকে জানতে হলে তাদেরকেও আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে ব্যাপক এবং স্বচ্ছ ধারণা অর্জন করতে হবে। তবেই একজন জুম্ম তরুণ স্বজাতির তরে নিজেকে উৎসর্গ করার প্রেরণা খুঁজে পাবে। এধরনের ছোট ছোট উদ্যোগগুলোতে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে তরুণদের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীরতর সমস্যার সংস্পর্শে যাওয়ার এবং তার স্বরুপ অণুসন্ধান করে নিজের অবস্থান থেকে প্রয়োজনীয় ভূমিকা গ্রহণ করার চেতনায় নিজেকে সমৃদ্ধ করা।

বিগত সময়ে আমাদের এই উদ্যোগে যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন বর্তমানে যারা এই উদ্যোগকে উৎসাহিত করছেন এবং এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সবার প্রতি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এবং আহবান জানাই, সময়ের আহবান মর্মে নিয়ে নতুন দিনের হিল চাদিগাঙ বিনির্মাণে আমাদের সম্মিলিত যাত্রায় সামিল হতে…

সুলভ চাকমা; ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Back to top button