জাতীয়

ঢাকার আদিবাসী পাহাড়ি নবীন শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিলো পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ

শ্যাম সাগর মানকিন: ‘শেকলে বাঁধা জীবন আর কতকাল, ক্ষণ এসেছে নবীন শৃঙ্খল ভাঙার, ঘুচাও ক্রান্তিকাল’ স্লোগানে ঢাকার বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ি আদিবাসী নবীন শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিলো পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, ঢাকা মহানগর। এ উপলক্ষে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বিকেল চারটায় শুরু হয় আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাংসদ ঊষাতন তালুকদার, সন্মানিত অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, বিশেষ অতিথি বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগের সদস্য দীপায়ণ খীসা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক সুলভ চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মনিরা ত্রিপুরা। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর শাখা পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি নিপন ত্রিপুরা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাংসদ ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘আজকে নবীনদের বরণ করে নেয়া হচ্ছে, কারন আগামীতে এ নবীনরা যাতে তাদের অর্জিত জ্ঞান দিয়ে সমাজে তাদের অবদান রাখতে পারে সে আকাঙ্খা থেকে।’

তিনি নবীনদের উদ্দেশ্য করে আরো বলেন, ‘আমরা জীবন পেয়েছি, এর লক্ষ্য কী, উদ্দেশ্য কী তা আমাদের খুঁজে দেখতে হবে। লক্ষ্য ছাড়া কিছু হয়না। অনেক লোক ব্যাক্তিগত ভাবে সফল ও জ্ঞানী হতে পারেন কিন্তু সমাজে তার যদি অবদান না থাকে তবে তা ব্যর্থ। ফলে আমাদেরকেও একটা লক্ষ্য, একটা মূল্যবোধ আদর্শ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’

সরকারি চাকরিতে আদিবাসী কোটা বাতিল প্রসংগে তিনি জানান, ‘আমি মনে করি আদিবাসী ও অনগ্রসরদের জন্য কোটা রেখে দেয়া উচিত। এটা বাতিল করা ঠিক হবেনা। আদিবাসীরা সুযোগ পেলে তাদের মেধার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাতে পারে তার অনেক প্রমান রয়েছে।

‘আমাদের অস্তিত্ব আজ সংকটের মুখে। আজকে তাই ঐক্য ছাড়া বিকল্প নেই, সংগঠন ছাড়া বিকল্প নেই। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। আমাদের দায়িত্ব বাংলার ষোলকোটি মানুষকে এটা বোঝানো যে আমাদের অস্তিত্ব আজ সংকটে। পাহাড়িদের বিচ্ছিন্নতাবাদী করে দেখাতে চাওয়ার যে প্রচারণা রয়েছে তার বিপক্ষে আমরা যে নাগরিক মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চাই তা বোঝাতে হবে সবাইকে’ বলেও সাংসদ ঊষাতন তালুকদার মন্তব্য করেন।

নবীনদের উদ্দেশ্যে সন্মানিত অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘আদিবাসীদের বিভিন্ন দাবীর প্রতি আমি সবসময় সংহতি জানিয়েছি, এখনো জানাই। আমি আমার সাধ্যমত বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি, সামনেও করবো।’

‘সংগ্রাম ছাড়া আদিবাসী হোক বাঙালি হোক কেউ অধিকার পায়নি। সে কারনেই সংগ্রাম জরুরী। নবীন শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব হল পড়াশুনার পাশাপাশি আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত হওয়া। ঝিমিয়ে পড়লে হবেনা’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘নবীন বন্ধুরা আপনাদের পড়াশুনা আনন্দময় হতে হবে। জ্ঞান আহরন করে আদিবাসীদের, দেশের, গোটা পৃথিবীর সম্পদ হয়ে উঠতে হবে। আপনারা বুয়েটের শিক্ষক শৈলি চাকমাকে দেখেছেন। সে আপনাদের অনুপ্রেরণা হতে পারে, পাহাড়ি মানুষ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায়।

‘আপনারা সবাইকে ভালোবাসতে শিখবেন। পাহাড় ভালবাসবেন, প্রকৃতি ভালবাসবেন, বাঙালিদেরও ভালবাসবেন। এভাবে আপনারা বিশ্ব মানব হয়ে উঠবেন।’

‘মানুষ কখনো কখনো হেরে যায়, এটা স্বাভাবিক। ফলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আপনারা এগিয়ে যান’ বলে আদিবাসী নবীন শিক্ষার্থীদের আহবান করেন সঞ্জীব দ্রং।

‘ব্যানারে যে স্লোগান দেয়া আছে তাতে আহবান আছে, আকুতি আছে। সে আহবানের সুর ধরে বলতে হয় নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও পাহাড়ের আদিবাসীরা শিক্ষা ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে তা গুরুত্বপূর্ন। যারা পাহাড়ে থাকেন না তারা বুঝতে পারবেন না সেই প্রতিকূলতার মাত্রা। এই যে সাংসদ সাহেব বসে আছেন এখানে তারা জীবন যাপন করেছে মৃত্যুকে সাথে নিয়ে। মৃত্যুকে সাথে নিয়ে জীবন যাপন তা এখনো চলমান’ বলে মন্তব্য করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগের সদস্য দীপায়ন খীসা।

‘রাষ্ট্র পক্ষ হাজার নিষ্পেষণ করেও আদিবাসীদের যে বিকাশ তা নষ্ট করতে পারেনি। আদিবাসীরা এগিয়ে গেছে, সব পেরিয়ে। আমি আশা করবো আপনারা সেই বিকাশের ধারা অব্যাহত রাখবেন।’

‘আমার নিজেদের উৎকর্ষতা সাধন করবো। কিন্তু সাথে সাথে আমাদের শেকড় ভুলে যাওয়া যাবেনা। আমাদের শেকড় পাহাড়, আমাদের ভাষা, আমাদের গান, আমাদের সংস্কৃতি।’

‘আমাদের যতই খুন করুক, পিছিয়ে রাখুক, ধর্ষণ করুক বোমা মেরে উড়িয়ে দিক আমরা যদি আমাদের মধ্যে থেকে আদিবাসীদের মধ্যে এমন চিন্তাশীল মানুষ তৈরি করতে পারি যা দুনিয়া বদলে দেবে তা আমাদের জন্য সফলতা। সেখানে কেউ বোমা মারতে পারবেনা’ বলেও নবীনদের জ্ঞান আহরণে উৎসাহিত করেন দীপায়ন খীসা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সুলভ চাকমা বলেন, ‘পাহাড়ি আদিবাসী শিক্ষার্থীরা পাহাড়ে নানান প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে। সেখানে এখনো প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষায় পর্যাপ্ত সুবিধাদি নেই। সরকারের এদিকে মনোযোগ দেয়া দরকার।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের আদিবাসী শিক্ষার্থীরা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে চলেছে। আগামীতেও এই যাত্রা অব্যাহত থাকবে বলেই আমি মনে করি।’

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মনিরা ত্রিপুরা বলেন, ‘আমরা এমন এক সময়ে বাস করি যে সময়ে আমাদের মা-বাবা, ভাইবোন কেউ নিরাপদ নয়। এই যে অস্তিত্বের সংকট নবীন শিক্ষার্থীদের তা বুঝতে হবে। আমাদের সংগ্রাম করে বাঁচতে হবে। আপনাদের সেই সংগ্রামে শামিল হওয়ার আহবান জানাই।
আলোচনা সভার সভাপতি নিপন ত্রিপুরা বলেন, ‘আজকে আমরা যে শেকল বাঁধা জীবন যাপন করছি, সেই শেকল যাতে ভেঙে ফেলতে পারি সে জন্য নবীনদের আহবান জানাই।’

আলোচনা সভা শেষে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন অতিথিবৃন্দ। এর আগে আলোচনা সভার শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেঙ ইয়েং ম্রো, এবং নবীন শিক্ষার্থীদের পক্ষে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্মৃতি চাকমা। শিক্ষার্থীদের অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন সেজুতি চাকমা।

সব শেষে সন্ধ্যায় আদিবাসী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহনে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়। আদিবাসীদের প্রথম ও একমাত্র নারী গানের দল এফ মাইনরের পরিবেশনার মাধ্যমে নবীন বরণ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়।

Back to top button