জাতীয়

জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদের আয়োজনে ঢাবি’তে মাতৃভাষা উৎসব অনুষ্ঠিত

আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা): গতকাল ১৭ ফেব্রয়ারি, শনিবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ এর ৭ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। বিকাল: ০৩:০০ঘটিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সংসদের আয়োজনে “চর্চা আর রক্ষার শপথে ঋদ্ধ করি মায়ের ভাষার অধিকার” স্লোগানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হল ”মাতৃভাষা উৎসব-২০২৪।”

উক্ত অনুষ্ঠানে ”এক টুকরো পার্বত্য চট্টগ্রাম” নামে জুম পাহাড়ের ছবি প্রদর্শনী, আদিবাসী বর্ণমালা প্রদর্শনী, মাতৃভাষায় বক্তৃতা, কবিতা আবৃত্তি সহ জুম পরিবেশনার আয়োজন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ’এর সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা। সম্মানীত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মারমা ভাষার লেখক উ উইম মং জলি। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জুম ম্যাগাজিন প্রকাশনার সাবেক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি ও আইপিনিউজ এর উপ-সম্পাদক সতেজ চাকমা  এবং সংগঠনটির সদ্য সাবেক সভাপতি ঐতিহ্য চাকমা।

স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সুয়েসানু মারমা সংগঠনটির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা প্রথমে ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদদে স্মরণ করেন। তারপর তিনি বলেন, এখানে আমরা সবাই স্কলার। আমি সিনিয়র স্কলার, আর আপনারা জুনিয়র স্কলার। আপনাদের আর আমার সম্পর্কটা খুবই গভীর। আমরা চাই আলোকিত মানুষ হতে। আর এইজন্যই সাংস্কৃতিক চর্চা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি জুম সাহিত্য সংসদ’কে ধন্যবাদ জানাই ভাষার মাসে এত সুন্দর একটা উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। যে কর্মসূচিটি এখনও পর্যন্ত জগন্নাথ হলের কেউ নেয়নি।

জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদের শিল্পীদের পরিবেশনা।

তিনি আরও বলেন, আমি একজন বাঙালি সংস্কৃতির মানুষ হলেও আমি চাই আদিবাসীদের সংস্কৃতির কাছাকাছি যেতে এবং লালন করতে। মূল স্রোতধারার মানুষ হিসেবে আমারও উচিত আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বৈচিত্র্যতাকে গুরুত্ব দেওয়া। তরুণ প্রজন্মের যারা আছে তাদের সকলের উচিত নিজেদের ভাষার শিল্প ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার কাজে এগিয়ে আসা। কেননা, নিজের ভাষায় কথা বলা বা গাইতে পারার মতো আনন্দ নেই।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মারমা ভাষার লেখক উ উইন মং জলি জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদেরএই ধরনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, বান্দরবানে রেংমিৎচ্যা ভাষার জনগোষ্ঠীর লোক বর্তমানে বেঁচে আছে মাত্র ৫ জন। এ ভাষাটি আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে হাঁটছে। এভাবেই আদিবাসীদের মাতৃভাষাও নানা সমস্যার কারণে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। আদিবাসীদের পরিচয় নিজেরাই ঠিক করার বদলে সরকার তাদেরকে চাপিয়ে দিচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, উপজাতি, সম্প্রদায় ইত্যাদি নামে। সেই জায়গায় শেকড়ের টানে আদিবাসীদের ভাষা, ঐতিহ্য ও সাহিত্যের বৈচিত্র্যতাকে সকলের সামনে তুলে ধরছে। তিনি সংগঠনের সফলতা কামনা করে নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আহবান জানান।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সতেজ চাকমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদের প্রেক্ষাপট তুলে  ধরেন । তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর সংবিধান প্রণয়নকালে পাহাড়ের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জোর দাবি জানিয়েছিলেন দেশে বাঙালি ছাড়া অপরাপর সংস্কৃতির মানুষন যাতে সংবিধানে জায়গা পায়। কিন্তু তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীরা তার মর্ম বুঝেনি। যার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের পর পাহাড়ে এক ধরণের স্বস্তির বাতাবরণ তৈরী হয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত পাহাড়ের আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি নানা হুমকির মধ্যে পথ চলছে। এইসব ভাষা চর্চা ও প্রসারে অবশ্যই তরুণ প্রজন্মের এগিয়ে আসা জরুরী।

তিনি আরো বলেন, নিজেদের ভাষা ও সাহিত্য অন্য কেউ এসে সমৃদ্ধ করে দিবে না। এ কাজ আমাদের নিজেদেরকেই করতে হবে। কাজেই কেবল রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে না থেকে আমাদেরকেই এসব কাজকে এগিয়ে নিতে হবে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সকল জুম্ম শিক্ষার্থীদের নিজেদের শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি রক্ষা ও প্রসারে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঐতিহ্য চাকমা অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আক্ষেপ করে বলেন, কতগুলো শব্দের অর্থ আমরা নিজেরাই জানি না। এইভাবে সংস্কৃতির আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ভাষা। সেই জায়গায় এই সংগঠনটি নিজেদের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নিচ্ছে।

সংগঠনটির সাবেক সভাপতি হওয়ার দরুণ তিনি সংগঠনটির ইতিহাস বিষদভাবে তুলে ধরেন। শুধু চর্চার মাধ্যমেই নয়, চর্চা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমেও একটি বিপন্ন ভাষাকে ফিরিয়ে আনা যায়। সেই জায়গায় আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে বলেও গুরুত্বারোপ করেন।

সভাপতির বক্তব্যে অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আমরা এই সংগঠনটির মাধ্যমে পাহাড়ের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ভাষার বৈচিত্র্যতাকে তুলে ধরবার চেষ্টা করছি ঢাবি ক্যাম্পাসে। আদিবাসীদের জুম পাহাড়ের সাহিত্য খুবই সমৃদ্ধ যা অনেকেই জানে না। এই সমৃদ্ধ সাহিত্যকে এই ক্যাম্পাসে তুলে ধরায় আমাদের অন্যত কাজ।

তিনি আরও বলেন, আমরা ”এক টুকরো পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে” ছবি প্রদর্শনীর মাধ্যমে পাহাড়ের বাস্তব গল্পগুলো অর্থাৎ পাহাড়ের  আদিবাসী জাতি সমূহের লড়াই, সংগ্রাম, বঞ্চনা ও অত্যাচারে গল্পগুলো তুলে ধরবার চেষ্টা করছি। যেহেতু এই সংগঠনে নানা আদিবাসী জাতির শিক্ষার্থীদের সম্মিলন ঘটে তাই আমরা একে অপরের সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যতাকে ধারণ করেই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।সভাপতির বক্তব্যের মাধ্যমে আলোচনা সভা শেষ হয় ও তার পরবর্তীতে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করে সংগঠনটির সদস্যরা। সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ছিল আদিবাসীদের মাতৃভাষায় বক্তৃতা, কবিতা আবৃত্তি ও জুম পাহাড়ের গান।

Back to top button