শিল্প ও সংস্কৃতি

জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিলঃ এক ক্লান্তিহীন পথিকের কথকতা- অম্লান চাকমা

কালের পরিক্রমায় ‘পঁয়ত্রিশ বছর’ অনেক দীর্ঘ একটা সময়। অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে তো বটেই দেশের সার্বিক বাস্তবতার আলোকে একটি সংগঠনের জন্য এটি যেন অন্তহীন পথচলার মত। আর সে সংগঠনটি যদি বাস্তবিক অর্থেই হয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাহলে তাকে নিয়ে দু’চার কথা বলতে গেলে যথাযথ পর্যবেক্ষণ থাকতেই হবে। তাই জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল (জাক) নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে তার জন্ম ইতিহাস জানতে ক’জনের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে। সেই সাথে আরো গভীরে গিয়ে জানার জন্য পুরনো কিছু বই পত্রও ঘাটাঘাটি করেছি।
শুরুর গল্প : জাক প্রতিষ্ঠার সময় উপসি’ত ছিলেন এমন দু’জনের ভিন্ন ভিন্ন স্মৃতিচারণমুলক দু’টি প্রবন্ধ থেকে এই সংগঠনটির জন্ম দিবস সম্পর্কে সঠিক তথ্যটি বেরিয়ে এসেছে। শ্রী কৃঞ্চ চন্দ্র চাকমা এবং শ্রী প্রশান্ত ত্রিপুরা দু’জনেই বর্তমানে সুখ্যাত। ২০০৫ সালে জাক প্রয়াত সুহৃদ চাকমার স্মরণে ‘সুহৃদ চাকমা স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করে। শ্রী চাকমা ‘স্মৃতির মনিকোঠায় সুহৃদ চাকমা এবং তাঁর কয়েকটি চিঠি’ শিরোনামের প্রবন্ধটিতে ১৯৮১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার এর কথা উল্লেখ করেছেন। সভার সময়টি ছিল বিকাল ৪ ঘটিকা। স্থান তৎকালীন ঢাকার সৈয়দ রোডস’ ট্রাইবাল স্টুডেন্টস হোস্টেল। এ সম্পর্কে অভিন্ন মতামত পাওয়া যায় জাক এর ২০১৪ সালের বাৎসরিক লিটল ম্যাগাজিনে শ্রী ত্রিপুরার লেখা ‘এক তেত্রিশ বছর বয়সীকে নিয়ে কিছু কথা’ নামক প্রবন্ধে। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে সেদিন আরো উপস্থিত ছিলেন সর্বশ্রী রনজ্যোতি চাকমা, পুলক জীবন খীসা, দীপেন দেওয়ান প্রমুখ। রাঙ্গামাটি ঈসথেটিকস কাউন্সিল (রাক) বা রাঙ্গামাটি নান্দনিক পর্ষদ (রানাপ) হিসেবে এই সংগঠনটির পদযাত্রা শুরু হয়। তবে রাঙ্গামাটি ঈসথেটিকস কাউন্সিল (রাক) নাম পাল্টে কবে এটি জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল (জাক) নাম ধারণ করে সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্যে জগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র অকাল প্রয়াত সুহৃদ চাকমা এটির প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
যেভাবে পথচলা হল শুরু: জাক গঠনের পটভূমিও একটি সাদামাঠা গল্পের প্লটের মতই। সে সময় দেশের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করবে এমন একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হত ঘরোয়া আলোচনায়। রাঙ্গামাটি শহরে লম্বা ছুটির দিনগুলিতে এ নিয়ে জমজমাট আড্ডা চলত। পাহাড়, ঝর্ণা আর অরণ্যকে ঘিরে গড়ে উঠা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় কৃষ্টি, মূল্যবোধ সর্বোপরি সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন করার তাগিদ অনুভব করতেন সবাই। সেই সাথে নিয়মিত সাহিত্য চর্চার জন্যএকটি প্লাটফর্ম। এক সময় বাড়তে থাকে এর সদস্য সংখ্যা। যোগ দেন সর্বশ্রী সুসসময় চাকমা, প্রয়াত চিরজ্যোতি চাকমা্, শৈ অং প্রু চৌধুরী, কুবলেশ্বর ত্রিপুরা, মৃত্তিকা চাকমা, শিশির চাকমা, মঙ্গল কুমার চাকমা, মানস মুকুর চাকমা, প্রয়াত লালন চাকমা, ঝিমিত ঝিমিত চাকমা, বীর কুমার চাকমা, চন্দন চাকমা, শান্তিময় চাকমাসহ আরো অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিভিন্ন সামাজিক উৎসব বা দিবসকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হতে শুরু করে লিটল ম্যাগাজিন। বর্তমান পর্যন্ত নানান কলেবরে জাক থেকে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্য ঊনষট্টি টি। ২০১৬ সালে এপ্রিলে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনের নাম খয় সা। একটা সময় পর শিশু কিশোরদের জন্য চালু করে কজমা শাখা। দেয়ালিকা প্রকাশ, ছবি আঁকা আর আবৃতি চর্চা চালু হয় তখন থেকে। সংগঠনের পরবর্তী প্রজন্ম পূর্ণ রঞ্জন চাকমা, সন্তোষ চাকমা, তরুণ চাকমা, চিরজ্যোতি চাকমা, মিহির বরণ চাকমা, হেমল দেওয়ান, প্রবীন খীসা তাতু, শরৎ চাকমা, সীমা দেওয়ান, সুখেশ্বর চাকমা, মহতী দেওয়ান, সুস্মিতা চাকমা, তন্দ্রা চাকমা, সুখময় চাকমারা, আশীষ চাকমা, সুব্রত চাকমা, অশোক চাকমা, অম্লান চাকমা, সিদ্ধার্থ তঞ্চঙ্গ্যা, সঞ্চনা চাকমারা গড়ে উঠেন এভাবেই। নতুন শতাব্দীতে জাকে এসে আলো ছড়ালেন সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ এক ঝাঁক তেজোদীপ্ত কিশোর-কিশোরী রিপরিপ চাকমা, জয়জিৎ ত্রিপুরা, করুণাশীষ চাকমা, নিকোলাই চাকমা, অংক্য সেন মারমা, লিপিকা ত্রিপুরা, মুক্তা চাকমা, দ্যানিশ চাকমা, প্লীনা চাকমা, রণেল চাকমা, রিপন চাকমা, পহেল চাকমা, সুনির্মল চাকমা (চুংকু), ব্রাইট চাকমা, উ রাখাইন কায়েস, প্রয়াত সতীর্থ দেওয়ান আর প্রয়াত সুরতি রঞ্জন চাকমার মত আরো অনেকে।
DSC06149
নাটক ও নাট্য চর্চা : নাটক রচনা আর মঞ্চায়ন সেই থেকে যেন জাক এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এখনো বিজু কেন্দ্রিক নানান উৎসব, আদিবাসী সংস্কৃতি মেলা কিংবা সাংস্কৃতিক আয়োজনে জাক’র নাটকই থাকে মূল আকর্ষণ। জাক কর্তৃক নির্দেশিত এবং মঞ্চায়িত প্রথম নাটক তৎকালীন সভাপতি অকাল প্রয়াত চিরজ্যোতি চাকমার ‘আনাত ভাজি উধে কার মু’। পরের বছর শান্তিময় চাকমা একটি বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে লিখে ফেলেন ‘‘যে দিনত যে কাল”। উভয় নাটকই মঞ্চস্থ হয় তৎকালীন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে (উসাই)। পরবর্তী সময়ে জাক এর আলোচিত নাটকের মধ্যে শান্তিময় চাকমার বিজু রামর স্বর্গত যানা, ঝরা পাদার জিংকানী, মৃত্তিকার চাকমার দেবংসি আহদর কালা ছাবা, মহেন্দর্র বনভাঝ, হক্কানীর ধনপানা ও এগাত্তোরোর তরনী, ঝিমিত ঝিমিত চাকমার অদত্, আন্দালত পহ্র এবং কাত্তোন উল্লেখযোগ্য। কবি মৃত্তিকা চাকমার ‘হক্কানীর ধনপানা’ সর্বাধিক প্রশংসিত নাটক। প্রখ্যাত নাট্যজন ফয়েজ জহির এবং শান্তিময় চাকমার নির্দেশনায় বিদ্রুপধর্মী নাটক হক্কানীর ধনপানা সমসাময়িক কালের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাটক। বিদ্রুপধর্মী সংলাপের মাধ্যমে এই নাটকে মানব চরিত্র এবং সমাজের ক্লেদাক্ত দিকসমূহ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ নাটকের চারটি শো অনুষ্ঠিত হয় ঢাকাস’ মিরপুর আউটার স্টেডিয়াম, মহিলা সমিতি মঞ্চ, কেন্দ্রীয শহীদ মিনারে। সাধারণ দর্শক এবং নাট্যবোদ্ধাদের কাছে এই নাটক প্রশংসিত হয়।
আদিবাসী সংস্কৃতি মেলা (আসমে): পার্বত্য জনপদের আদিবাসীদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারের অভিপ্রায় নিয়েই জাক ১৯৯৮ সাল থেকে আয়োজন শুরু করে আদিবাসী সংস্কৃতি মেলা। ৯-১১ এপ্রিল প্রথমবার আয়োজিত এই মেলার উদ্ধোধন করেন দেশবরেণ্য কবি প্রয়াত শামসুর রাহমান। সেই থেকে এ পর্যন্ত মোট ১৪ বার এই মেলার সফল আয়োজন হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৮ সাল পর্যন্ত একটানা দশবার। প্রতিবারই পার্বত্য চট্টগ্রামের সব আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এতে স্বতষ্ফূর্ত ও সক্রিয় অংশ গ্রহণ ছিল। মাঝে মাঝে যোগ দিয়েছেন সমতলের আদিবাসীরা। তারাও পরিবেশন করেছেন তাদের গান, নাচ, নাটক আর বস্তুগত সংস্কৃতির নানান উপাদান। প্রসিদ্ধ নাট্যদল ‘আরণ্যক’ প্রদর্শন করেছে সাঁওতাল বিদ্রোহের পটভূমির উপর বিশিষ্ট নাট্যজন মামুনুর রশীদ অনবদ্য সৃষ্টি ‘রাঢ়াং’। বলার অপেক্ষা রাখেনা এর ফলে বিশেষ করে অবহেলিত পার্বত্য আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে এবং বৃহত্তর পরিসরে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা গেছে। এছাড়াও জাক এর এই উদ্যোগ পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ এবং আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে বললে অসঙ্গত হবে না।
IMG_8234 - Copy - Copy
গতানুগতিক এসব কর্মসূচির বাইরেও জাক ব্যতিক্রমী এবং সৃষ্টিশীল কিছু কাজ করার চেষ্টা করে থাকে। যারমধ্যে স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর, গুণীজন সংবর্ধনা, পথ নাটক, স্মরণ সভা, পাপেট শো, সেমিনার- সিম্পোজিয়াম, বাৎসরিক বনভোজন উল্লেখ করার মত। এছাড়াও প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার রাঙ্গামাটি শহরের বনরূপাস্থ সংগঠনের কার্যালয়ে শিশু শিল্পীদের নাচ ও গানের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন জাকের সিনিয়র শিল্পীরা। স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন গুরুত্ববহ অনুষ্ঠানে এসব শিশুশিল্পীরা অংগ্রহণ করে থাকেন।
শেষ কথা: জুম পাহাড়ের সবচেয়ে অসি’র সময়ে জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল (জাক) এর আবির্ভাব। কারণ সে সময় আদিবাসী সংস্কৃতি, ঐতিহ্য শুধু নয়; তাদের জাতীয় অস্তিত্বও ছিল বিলুপ্তির আশংকায়। সেই অস্থিতিশীল সময় থেকে এত বছরের দীর্ঘ পথচলা কতটা বন্ধুর ছিল সেটা অনুমেয়। সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি নিখাদ প্রেম, দৃঢ় সংকল্প আর নিরলস সাধনা ছিল বলেই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হয়েও জাক এখনো টিকে আছে। দেশের বাইরেও রয়েছে অনেক সদস্য আর শুভাকাঙ্খী। পরামর্শ, কারিগরি আর অর্থ সহায়তা দিয়ে তারাও জড়িয়ে আছেন জাক এর সাথে। জাক ২০০৫ সালের ২৪- ২৮ ফেব্রুয়ারি বর্ণিল আয়োজনে ‘রজত জয়ন্তী’ পালন করেছে। মিডিয়া পার্টনার ছিল ‘প্রথম আলো’ ছিল। সম্পাদক মতিউর রহমান নিজে উপস্থিত থেকে আলোচনা সভাগুলোতে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পার্বত্য শহর রাঙ্গামাটির একটি সংগঠন হিসেবে জাক’র নিজস্ব সীমাবদ্ধতা এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা আছে সেটা অনস্বীকার্য। তারপরও সব বাঁধা ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে জাক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। জাক এর একজন নগণ্য কর্মী হিসেবে তাই আমিও সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের স্বপ্ন দেখি।

Back to top button