জুম্ম তরুন সমাজের চেতনায় এম এন লারমাঃ বাচ্চু চাকমা
১০ নভেম্বর। এই দিনে মহান বিপ্লবী, জুম্ম জাতির পথ প্রদর্শক, মানবজাতির মুক্তির দিশারী, জুম্ম জাতির অগ্রদূত মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা (এম এন লারমা) মারা যান। বিভেদপন্থী গিরি- প্রকাশ- দেবেন-পলাশ চার কুচক্রী মহান নেতা এম এন লারমাকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। আজ এমন একটি দিন, যে দিনটি জুম্ম জাতীয় জীবনে শোকের দিন। তবে এই শোককে শক্তিতে পরিণত করে ইস্পাত-কঠিন আন্দোলন সংগঠিত করে এগিয়ে যাওয়ার একটি অন্যতম দিন। এই দিনে জুম্ম জাতির তরুণরা কি ভাবছে, এগুলো জানার ইচ্ছে জাগে-আমার মত করে ভাবনাগুলো সাজিয়ে তারুণ্যের শক্তিকে জাগ্রত করার চেষ্টা করি বারবার। প্রিয়নেতার আদর্শকে তরুনদের প্রাণে-প্রাণে ছড়িয়ে দিতে স্বপ্ন দেখি আর স্বপ্ন বুনেই চলেছি প্রতিনিয়ত। জুম্ম জাতির মুক্তির জন্য যিনি জীবন দিলেন, পাকিস্তান+বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে যিনি আজীবন লড়েছিলেন অথচ তাঁর জীবন ও সংগ্রাম বিষয়ে তরুণরা কতটুকু মনের গভীরে গিয়ে উপলদ্ধি করতে পারে তা জানি না। তারুণ্যের অন্তরের ভেতর এম এন লারমার শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন, রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রামের প্রতিটি মুর্হুতে বিশেষ ঘটনাগুলো জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয় কিনা। মহাননেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার চিন্তাধারার অনুসারী হয়ে জুম্ম জাতির ক্রান্তিকালে তরুণ সমাজ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম কতটুকু গড়ে তুলতে পারবে তা এখন দেখার বিষয়। হে তরুণ, সময় চলিয়া যায় নদীর ¯্রােতের প্রায়! এই চিরন্তন সত্যকে মেনে নিয়ে জুম্ম জাতিকে মহাবিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে হবে এখনই। আজ আমাদের চোখের সামনে জুম্ম জাতিকে বিলিন হতে দেখেও কেন তরুণ সমাজ অন্ধ, বধির ও নীরব-নিস্তব্দ! মহান নেতা এম এন লারমার আদর্শ যদি জুম্ম তরুণের রক্তের শিরায়-উপশিরায় প্রবাহিত হতে পারে; তাহলে সেখানে কোনদিন আপোষ হতে পারে না, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অধিকার ছিনিয়ে আনাই তার উপযুক্ত জবাব। তরুণেরা পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন এক সময় রাশিয়ায় জার শাসনামলে অরুশীয় জাতিসমূহকে বলপূর্বক রুশীকরণের নীতি তারা অনুসরণ করেছিল। ঠিক একইভাবে শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগতদের অবাধ অনুপ্রবেশ, বিভিন্ন স্থানের জুম্ম নাম মুছে দিয়ে ইসলামী নামকরণ, মসজিদ-মাদ্রাসা ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে তুলে ইসলামী সম্প্রসারণবাদ কায়েম করে জুম্ম জাতির নাম নিশানা মুছে দেওয়ার সুগভীর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জুম্ম তরুণ সমাজকে প্রতিরোধের দেয়াল নির্মাণ করতে হবে।
মহান পার্টির বীর সেনানীরা প্রমাণ করে দিয়েছেন ক্ষুদ্র শক্তি নিয়েও শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে অধিকার ছিনিয়ে আনা সম্ভব। বৃহৎ শক্তির সাথে লড়াই করার জন্য আমাদের প্রয়োজন সাহস, মেধা, যোগ্যতা ও আদর্শ। নীতি ও আদর্শগত সুসংগঠিত কোন জাতিকে কোন শাসকগোষ্ঠী পরাজিত করতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস মানেই হলো নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের ইতিহাস। জুম্ম জাতির ইতিহাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস। রক্তের বন্যা বয়ে গেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে, আজো তা প্রবাহমান। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি ও প্রকৃতির সাথে আমাদের বেড়ে উঠা। আমাদের অগ্রজরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে, প্রকৃতিকে জয় করেছিলেন। প্রকৃতিকে জয় করা মানেই হলো প্রকৃতিকে স্পর্শভাবে চিনতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে। তার মানে হলো প্রকৃতির নিয়মকে চেনা আর অপরদিকে সেই নিয়মকে মেনে চলা। সেই নিয়মকে জেনেই তরুণ সমাজকে অগ্রসর হতে হবে, বাস্তবে কাজ করার মাধ্যমেই পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতিকে পরিবর্তন করতে হবে। রক্তাক্ত লাশ এবং নৃশংস গণহত্যা ও সাম্প্রদায়িক হামলার নীরব সাক্ষী আমরা। পাহাড়ের এই নাজুক পরিস্থিতি আমাদের তরুণ সমাজকে আরো প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী করে তুলতে হবে। পাহাড়ের বুকে যখন আমাদের তরুণ সমাজ মুক্তির বাণী নিয়ে জনগণের কাছে হাজির হবেন, তখন জনগণের ভাষায় আমাদের কথা বলতে হবে। আমাদের ব্যবহার, চলাফেরা, কথার্বাতা এবং আদর্শ দেখে জুম্ম জনগণ আমাদের আপন করে নেবে। জুম্ম জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং সংগঠিত করার দায়িত্ব আমাদের তরুণদের নিতে হবে। আমি তারুণ্যের জয়গান করি, তরুণদের মহাশক্তিধর মনে করি। অমিত সম্ভাবনা রয়েছে এই তারুণ্যের হৃদয়ে। আদর্শিক চেতনাকে ধারণ করে তারা বিশ্বের বুকে অজেয় হিসেবে স্থান দখল করে নিতে পারে। এই তরুণেরা পুরাতন সমাজের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংষ্কার থেকে নিজেকে মুক্ত করে নতুনত্বকে সৃষ্টি করার মহান আদর্শের নির্ভীক সৈনিক হতে পারে। তরুণেরা আমূল পরিবর্তনের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগনের দূত হিসেবে পৃথিবী নামক গ্রহের মানব সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করবে।
মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার শিক্ষা লাভ ছিল অতীতের অন্য সবার চাইতে ব্যতিক্রম, তাঁর কর্মজীবন, জীবন-দর্শন, অন্য সবার চাইতে আলাদা। তিনি শিক্ষা অর্জন করে কোন চাকরী নিয়ে ব্যক্তি জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বেছে নেননি। কেননা তিনি ভাবতেন জুম্ম জাতির মুক্তি কথা এবং জুম্ম জাতির দুঃখ-বেদনা ও যন্ত্রণা তিনি অন্তর দিয়ে অনুভব করতেন। তিনি জানতেন মানব সভ্যতার অগ্রগতির কথা, তিনি জানতেন বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষ ও নিপীড়িত জাতির সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ের কথা। তিনি বুঝতেন আধুনিক সব রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাস ও সংস্কৃতির কথা। তিনি ভাবতেন পার্বত্য চট্টগ্রামের পশ্চাদপদ ও নিপীড়িত-নির্যাতিত জুম্ম জনগোষ্ঠীর কথা, তাদের জাগরিত করবার ও সংগঠিত করবার কথা, তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের কথা। এভাবে তিনি তাঁর চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য জুম্ম জনগণ তথা দেশে ও বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষের কাছে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর জন্মদিবস আর মৃত্যুদিবস শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা কি শুধু জনসংহতি সমিতির দায়িত্ব? প্রশ্ন জাগে তিনি কাদের জন্য তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন? তিনি সরকারের মন্ত্রীত্ব না নিয়ে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করেছিলেন কি কারণে? তিনি সরকারি শিক্ষকতা, ওকালতি পেশায় যুক্ত থেকে প্রশান্তময় জীবন কাটাতে পারতেন, তাহলে কিসের তাড়নায় এসকল বৈষয়িক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, চাকচিক্যময় জীবন-সংসার ত্যাগ করেছিলেন? জুম্ম তরুণেরা এর মর্মার্থ কি গভীরভাবে কখনো উপলদ্ধি করেছেন? নিজের জাতির যে করুণ অবস্থা সেটা কোনদিন, কোন সময় কিংবা কোন মুর্হুতে তাদের বিবেকের খোলসে করাঘাত করেছে কি?
ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে আমরা দেখতে পেয়েছি, সমাজ বিকাশের ধারায় তারুণ্যের শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তরুণদের উদ্দেশ্যে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, “ঐ নতুনের কেবল দেখো কাল বৈশাখীর ঝড়, তোরা সব জয়োধ্বনি কর”। তাহলে আজকে তরুণেরা কাল বৈশাখী ঝড়ের মত ঝঞ্জ¦া বেগে উত্তাল তরঙ্গের মত তারা এগিয়ে যেতে পারে, তারা সবকিছুই করতে পারে। অন্যায়কে প্রতিহত করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে কেবলমাত্র এই তরুণেরা। তরুণেরাই আমাদের সমাজকে বদলাবে, তারাই আমাদের সমাজে অবদান রাখবে। তরুনেরা সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামকে মানুষের মূল আধার হিসেবে গ্রহণ করেছে! সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অন্ধকারকে দূরীভুত করে পূর্বদিকের উদীয়মান সূর্যের মত তেজস্বী রূপে আর্বিভুত হয়েছে। পৃথিবীকে আলোয় আলোকিত করাই তরুণদের অন্যতম প্রধান কাজ। আমার অবাক লাগে, যে মানুষটি জুম্ম জাতির সামগ্রিক মুক্তি চেয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, জেলে, মাঝি-মাল্লা, পতিতা, তাঁতী, কর্মচারী কারাবন্দী তথা আপামর শ্রমজীবী ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তি চেয়েছিলেন, সেই মানুষটির মৃত্যু বার্ষিকী সবখানেই পালিত হওয়ার কথা থাকলেও সেটা যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মৃতিস্মরণ করা হয় না। মহাননেতা এম এন লারমাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি না, তাহলে আমরা কতটুকু সচেতন। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা বলতেন, জ্ঞানী, গুণীজনকে কদর না করলে, শ্রদ্ধা ও সম্মান না করলে সে দেশে, সে জাতিতে জ্ঞানী-গুণীজনের জন্ম হয় না। আমাদের ভাবনা আর স্বপ্নগুলো ভাবাবেগে নয়, হুত করে আকাশ থেকেও পড়েনি। বাস্তবে এই স্বপ্ন ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটাতে হবে; সেকারণে এম এন লারমাকে সত্যিকার অর্থে তারুণ্যের চেতনায় প্রজ্জ্বলিত করতে হবে। তরুন সমাজের মনের গভীরে তাঁর আদর্শকে স্থান দিতে হবে। উদ্বেগের মাঝেও আমাদের তরুন সমাজের কিছু কিছু ইতিবাচক প্রত্যাশার দিক পরিলক্ষিত হয়; বর্তমানে প্রিয়নেতার আদর্শের ভিত্তিতে তরুন সমাজের অগ্রণী একটা অংশ অধ্যয়ন-অনুশীলন-বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত হয়েছে। আজকাল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত জুম্ম তরুনেরা এম এন লারমার জীবন ও সংগ্রাম, তাঁর আদর্শ ও দর্শনকে জানার গভীর উপলদ্ধি, অনুভূতি আগের চাইতে অধিকতর বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তিকে নিপীড়িত জুম্ম জনগনের অধিকার আদায়ের পক্ষে ব্যবহার করার জন্য তরুণদের যেমনি ভূমিকা রাখতে হবে, তেমনি মহাননেতার আদর্শকেও বাস্তবে গ্রহণ করে অনুশীলনের মাধ্যমে চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে তরুণ সমাজকে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে।
১৯৮৩ সালে ১০ নভেম্বর সেদিনে জুম্ম জাতিকে কলংকিত করা হয়েছে। জুম্ম জাতীয় জীবনে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয় যা কখনও পূরণ হবার নয়। সেদিন জুম্ম জাতির পিতাকে হত্যা করে প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী ও বিভেদপন্থীরা জাতির ইতিহাসে এক কাল অধ্যায়ের জন্ম দেয়। অথচ প্রিয়নেতা “ক্ষমা করা ও ভুলে যাওয়া” নীতির ভিত্তিতে গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রদের মূল সংগঠনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন বারবার। তাহলে তাদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে প্রিয়নেতা কি ভুল করেছিলেন? মহাননেতা এম এন লারমা বলেছিলেন-“ক্ষমাগুন, শিক্ষা গ্রহণের গুন, পরিবর্তন হওয়ার গুন-এই তিন গুণের অধিকারী না হলে প্রকৃত বিপ্লবী হওয়া যায় না”। তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে, ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে, পরিবর্তনের বিশাল সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অথচ এই মহান তিনটি গুণের প্রতিটি গুণ বাস্তবে প্রয়োগ করতে গিয়ে বিভেদপন্থী চক্রদের হাতে জীবন দিতে হয়েছে প্রিয়নেতা এম এন লারমাকে। প্রিয়নেতাকে হত্যা করে পৃথিবীর ইতিহাসে আরেক বার পুনরাবৃত্তি ঘটালো, প্রতিক্রিয়াশীল যারা-তারা কখনও আমাদের আপন হয় না। যা দিবালোকের মত পরিষ্কার মহাননেতা এম এন লারমা জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকে আপন করতে গিয়ে জাতি হারালো তাঁর যোগ্যতম পিতা, জুম্ম জাতির অগ্রদূত ও মহান আদর্শের অধিকারী একজন বীর সেনানীকে। দেশ হারালো একজন সফল সাংসদ, সফল আইনজীবী, সফল শিক্ষক ও মহান দেশপ্রেমিক একজন নেতাকে। বিশ্ববাসী হারালো আরেকজন মহান মানবতাবাদী, মাকর্স-এঙ্গেল-লেলিন-স্টালিন ও মাওসেতুং এর চিন্তাধারার সফল ব্যক্তিত্ব মহান আন্তর্জাতিকতাবাদী ও চির বিপ্লবীকে।
জুম্ম জাতির দুঃখ মোচন করতে গিয়ে অস্ত্র কাঁধে তুলে নিতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। অপরদিকে একজন শত্রুর মৃত্যুতে তিনি হা-হুতাশ করেছেন, অন্তর কেঁদেছে বারবার। বিশাল মানবতাবাদী মানুষ নাহলে শত্রুদের জন্য অন্তর এমন করেনা। স্বশস্ত্র সংগ্রামের সময় একজন সেনাবাহিনী মৃত্যু হলে তিনি বলতেন, তার ও তো মা-বাবা আছে, সন্তান আছে, স্ত্রী আছে-তার পরিবারের কি হবে! একদিকে মানবতাকে রক্ষা করার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠীর নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তিনি আজীবন লড়াই করেছেন। তিনি অন্তর দিয়ে উপলদ্ধি করেছেন, অধিকার কেউ কাউকে দেয় না। অধিকার আদায় করে নিতে হয়, অধিকার কেড়ে নিতে হয়। তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন, “যে জাতি সংগ্রাম করতে জানেনা-সে জাতি পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন অধিকার থাকতে পারে না”। অধিকার অর্জন করতে গেলে ব্যক্তি একার পক্ষে সম্ভব নয়। সেজন্য সংঘবদ্ধ একদল প্রগতিশীল শক্তি দরকার। পৃথিবীতে প্রগতিশীল আদর্শের নীতিগত বন্ধুর অভাব-বন্ধু পাওয়া যায় না। এই বাস্তব সত্যকে অন্তরের গভীরে গিয়ে বুঝতে পারার পর সংঘবদ্ধ মানুষের শক্তিকে সংগঠনের রুপ দিলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন জুম্ম জনগনের প্রাণপ্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। এই সংগঠনের একজন হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম জনগনের ঘরে-ঘরে, দর টু দর গিয়ে পার্টির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতি-আদর্শ তুলে ধরেছেন তিনি। যেখানে অন্যায় ঘটেছে সেখানে দ্বিধাহীনভাবে, সাহসের সাথে র্নিভয়ে প্রতিবাদ করেছেন। জুম্ম জনগনের মুক্তির বানী পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
এই লড়াই বাঁচার লড়াই, এই লড়াই অস্তিত্ব রক্ষার, এই লড়াই অধিকারের-এই মর্মার্থ মনের গভীরে জন্ম হওয়ার পর ৭০ দশকে হাজারো তরুণ ছাত্র ও যুব শক্তি জুম্ম জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্ভুত হয়ে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। হয় মৃত্যু, না হয় বিজয়-এই দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে একদল তারুণ্যে শক্তি পার্বত্যা লে পাহাড়ের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। মহাননেতার আদর্শের সৈনিক হয়ে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে সফলভাবে চালিয়ে গেছেন। শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলনের জোয়ারের এক পর্যায়ে ব্রিটিশদের ভারতবর্ষে রেখে যাওয়া “ভাগ করো, শাসন করো” এই নীতির ভিত্তিতে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে বিভেদপন্থী চক্র মহাননেতা এম এন লারমাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। মহাননেতাকে হত্যা করলেও তাঁর চিন্তা চেতনা ও সুমহান আদর্শকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মেহনতি মানুষের অন্তর থেকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। বরং আজকে এটাই বলতে ইচ্ছে করে “ইতিহাস তুমি কেঁদো না পরিবর্তন আসে, চির ক্লান্তি ভাবনা তোমাকেই ভালোবাসে”। এটাই বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইতিহাস বড়ই নিষ্ঠুর! ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে প্রমাণ মেলেছে ইতিহাস কখনও কাউকে ক্ষমা করে না। জুম্ম জাতির পিতার সাথে বেঈমান, বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম যে কত ভয়াবহ হতে পারে তা বাস্তব সত্যেই প্রমাণিত হয়েছে। সেই ইতিহাসের পথপরিক্রমায় বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চার কুচক্রী আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বর্তমানে জুম্ম জাতির জীবন্ত কিংবদন্তী প্রিয়নেতা সন্তু লারমা জুম্ম তরুণ ছাত্র সমাজের উদ্দেশ্যে বলেছেনÑ“ জুম্ম ছাত্র সমাজকে দোদুল্যমানতা, সুবিধাবাদিতা ও সংকীর্ণতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে”। এটি প্রিয়নেতা সন্তু লারমা তারুণ্যের শক্তিকে পরিষ্কার করে বস্তুগতভাবে, দ্বান্ধিক ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন। জুম্ম ছাত্র সমাজ এই নির্মম বাস্তবতাকে কতটুকু উপলদ্ধিতে নিয়ে আসতে পারে তা এখন অনাগত দিনে দেখার বিষয়। আমাদের জুম পাহাড় আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে, পাহাড়ে নিরাপত্তা নেই, পাহাড়ে হাসি নেই, আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমি অস্তিত্ব বিলুপ্তির সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে, পাহাড়ী মানুষের আশা-আকাংখাগুলো শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে চলেছে। জুম্ম জনগনের বেঁচে থাকার একমাত্র ভিত্তি ভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি আজ ২০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। চুক্তি বাস্তবায়নের কোন লক্ষণ আজ আমরা দেখি না, বরং সরকারের নানা গরিমসী, কালক্ষেপণ, প্রতারণা আর মিথ্যার বলি আওড়ানো ছাড়া জুম্ম জনগন কিছুই লাভ করতে পারেনি। আজকে এই বাস্তবতার সামনে পাহাড়ের জুম্ম তরুণ সমাজ দাঁড়িয়ে আছে। এমতাবস্থায় চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হলে অসহযোগ আন্দোলনের দশদফা থেকে আরো অধিকতর সংগ্রামের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেই অধিকতর আন্দোলনে যেতে হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তরুণ ছাত্র সমাজ কি এখনও দোদুল্যমান? তরুণ ছাত্র সমাজ যদি সত্যিকারভাবে দোদুল্যমানতা, সুবিধাবাদিতা ও সংকীর্ণতা থেকে বেড়িয়ে আসতে না পারে; তাহলে জুম্ম জাতি বিজাতীয় শোষণ, নিপীড়ন থেকে মুক্তি অজর্ন করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তারপরেও প্রয়াতনেতা এম এন লারমার আদর্শই সেখানে তরুণ সমাজকে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই-সংগ্রামের বানী দৃঢ় কন্ঠে শুনিয়েছিলেন। তরুণ জুম্ম ছাত্র সমাজকে প্রিয়নেতার আদর্শ ও চিন্তাধারা থেকে বাস্তব শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
প্রিয়নেতার আদর্শ থেকে বাস্তবে শিক্ষা নিতে হলে কি ধরণের কাজ করা দরকার? প্রথমে রাজনৈতিকগতভাবে নিজে তৈরি করে গ্রামে চলো নীতি অনুসরণ করা দরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি মোন-মুরো, ছড়াছড়ি, গ্রামা লের জুম্ম জনগনের কাছে তরুণ ছাত্র সমাজকে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোন গদ্যন্তর নেই। এম এন লারমা একজন সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী হয়েছিলেন। সামন্তীয় সমাজের আকন্ঠে নিমজ্জিত নির্মম বাস্তবতা তিনি অন্তর দিয়ে উপলদ্ধি করেছিলেন। সেই সামন্তীয় জুম্ম সমাজের প্রতিটি গ্রামে গ্রামে, ঘরে ঘরে এবং এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। জুম্ম জনগনের বেঁচে থাকার আশা, আকাংখা ও স্বপ্ন বাস্তবে প্রত্যক্ষ করেছেন। পার্বত্যা লে জুম্ম জনগনের নির্মম-নিষ্ঠুর বাস্তবচিত্র, ইসলামী সম্প্রসারণের শোষণ, নিপীড়ন তাঁর অন্তরে আঘাতের পর আঘাত করেছে বারবার। প্রিয়নেতা তাঁর মৃত্যুর আগ মুহুর্তেও দ্বিধাহীন কন্ঠে উচ্চারণ করেছেনÑ“আমার রক্ত বিন্দু দিয়ে যদি জুম্ম জাতির ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে থাকে, তাহলে আমাকে মেরে ফেলো; আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত”! ভোগবাদী সমাজের দালালীপনা, দোদুল্যমানতা, সুবিধাবাদিতা ও সংকীর্ণতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছেন তিনি। বর্তমান চাকচিক্যময় ও রঙিন জগৎটাকে অন্তরে স্থান দিয়ে তরুণ ছাত্র সমাজ কিভাবে প্রিয়নেতার আদর্শকে গ্রহণ করবে? আমি উদ্বেগ প্রকাশ করলেও হতাশ নয়! আমি তারুণ্যের গান গেয়ে যাই, তারুণ্যের ভরপুর জুম্ম জাতির অগ্রগামী অংশকে নিয়ে এখনও স্বপ্ন দেখি-স্বপ্ন বুনে চলেছি। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি এই তরুণেরা জুম্ম জাতির সত্যিকার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সফলতার লক্ষ্যভেদ করে ছাড়বেই। শাসকগোষ্ঠীর কাছে মহাননেতার আদর্শ কখনও হার মানেনি, আপোষ করেনি, পরাজয় স্বীকার করেনি! মহাননেতার আদর্শেই প্রতিষ্ঠিত প্রিয় সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কৌশলগতভাবে কখনও নমনীয় সংগ্রামের রুপে আর্বিভুত হয়েছে; আবার কখনও অধিকতর সংগ্রামের রুপান্তর ঘটেছে। জুম্ম জনগনের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর আচরণ যেমনি হয়েছে, তেমনি জনসংহতি সমিতির আন্দোলনও সেভাবে আর্বিভুত হয়েছে। প্রিয়নেতার আদর্শের ভাষায় বাস্তবমুখী বাস্তবতা, আত্মমুখী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে জুম্ম জনগনের প্রাণের সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। যখন যে বাস্তবতা দেখা দেবে সেই বাস্তবতা অনুযায়ী জুম্ম ছাত্র সমাজকেও সেভাবে প্রস্তুত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
মহাননেতার আদর্শকে চিনতে, জানতে হবে এবং বুঝতে হবে। প্রথমে এই আদর্শকে চেনা ও চেনার পরে তা মেনে চলা। এটি জানার পর নিজের মধ্যে বাস্তবে প্রয়োগ করে নিরন্তর সংগ্রামের মাধ্যমে তরুণ সমাজকে অগ্রসর হতে হবে। আমরা স্বপ্ন দেখি পাহাড়ের শিশু, কিশোর, আবাল, বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই নিরাপদে বিচরণ করতে পারবো। স্বপ্ন দেখি আলুটিলা, ফুরমোন, কেওক্রডং পাহাড়গুলো পার্বত্য চট্টগ্রামে যুগের পর যুগ, সংগ্রামের প্রতীকরুপে বাস্তব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে অনন্তকাল ধরে। স্বপ্ন দেখি চেঙ্গী, মাইনী, কাচালং, কর্ণফুলী, মাতামুহুরী নদীগুলো বহমান ¯্রােতধারা স্তব্ধ হয়ে যাবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের বন-বনানী, গাছ-গাছালীতে ঘেরা-অরণ্যে ভরা সবুজ পাহাড়গুলো এম এন লারমার আপোষহীন লড়াই সংগ্রামের মহাকালের মহান সাক্ষী হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকবে। পাহাড়ের তরুন প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দেবে এই মাটি, পাহাড়ের গাছ-গাছালী, অরণ্যভূমি, পাহাড়-পর্বত, নদীনালা, ছড়া, ঝিরি-ঝরনা সবক্ষেত্রেই এম এন লারমার জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্বকে বাঁচাতে, পাহাড়ের জীবনকে সাজাতে প্রিয়নেতা আজীবন লড়াই করেছেন। তাঁর স্বপ্নের জুম্মল্যান্ড প্রিয় পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৪টি জুম্ম জনগোষ্ঠীকে আপন করে নিয়ে ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগোষ্ঠীর উপর অন্যায় হতে দেখলে তাঁর মন অশান্তিতে ভরে যেতো। প্রতিবাদের ভাষা নিজেই খুঁজে নিতেন। তিনি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসী সৈনিক ছিলেন। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সেই সময়ের সামন্তীয় নেতৃত্ব প্রতিরোধ তো দূরের কথা প্রতিবাদ করতে পর্যন্ত এগিয়ে আসেনি। সেই সময়ে ছাত্র থাকা অবস্থায় কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে লিপলেট বিলি করেছিলেন; কাপ্তাই বাঁধ এর বিপর্যয় সম্বন্ধে ছাত্র সমাজ ও জুম্ম জনগনকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে জুম্ম জনগনের অবিসংবাদিত নেতা এম এন লারমাকে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৩ সালে নিবর্তনমূলক আইনে গ্রেফতার করেছিলেন। শাসকশ্রেণির অন্যায়ের কাছে কখনো কোনদিনই মাথানত করেনি। সেই তারুণ্যেভরা এম এন লারমাকে দীর্ঘ ২ বছর কারাগারে অন্তরিন রাখার পরেও শাসকগোষ্ঠী দমিয়ে রাখতে পারেনি। একাই লড়ে গেলেন পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
মহাননেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার রাজনৈতিক জীবন যদি ফিরে দেখি তাহলে নিপীড়িত, শোষিত মানুষের কাছে তা অত্যন্ত গৌরবের। ১৯৫৬ সালে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনে পদার্পণ ঘটেছিল। রাজনৈতিক জীবনে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম ছাত্র সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে প্রিয়নেতা সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান, ১৯৬০ সালে গনতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং একই বছরে পাহাড়ী ছাত্র সমাজে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৬১ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিতকরণ, ১৯৬২ সালে পাহাড়ী ছাত্র সম্মেলনের প্রধান দায়িত্ব পালন করার পর চট্টগ্রামের পাথরঘাটাস্থ পাহাড়ী ছাত্রাবাস হতে ১৯৬৩ সালে ১০ ফেব্রুয়ারী নিবর্তনমূলক আইনে পাকিস্তান সরকার গ্রেফতার করেছিলেন। দীর্ঘ ২ বছর জেলে অন্তরিনের পর ১৯৬৫ সালে ৮ মার্চ চট্টগ্রাম কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সবচেয়ে কম বয়সে, তারুণ্যেভরা টগবগে যৌবনের সময়টাতে প্রথম জুম্ম জনগনের পক্ষ থেকে ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দুই বছরের মাথায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ১৯৭২ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারী ৪ দফা সম্বলিত আ লিক স্বায়ত্বশাসনের দাবীনামা পেশ করেছিলেন। একই বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগনের সংঘবদ্ধ শক্তি সমাবেশ করে প্রতিষ্ঠা করলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ এর নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলেন এবং একই সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। সবচেয়ে প্রনিধানযোগ্য এবং স্মরণীয় একটি দিন ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে জুম্মদেরকে বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রতিবাদে গণপরিষদ অধিবেশন বর্জন করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি হিসেবে কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে লন্ডন সফর করেন। জুম্ম জনগনের স্বার্থে কৌশলগতভাবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর বাকশালে যোগদান করেছিলেন, পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে ১৬ আগষ্ট থেকে আত্মগোপন করেছিলেন। ১৯৭৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ১ম জাতীয় সম্মেলন এবং সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮২ সালে ২০ সেপ্টেম্বর প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী ও বিভেদপন্থী চক্রদের ষড়যন্ত্রকে দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ২য় সম্মেলন শুরু এবং সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হয়েছিলেন। অবশেষে ১৯৮৩ সালে ১০ নভেম্বর ভোর রাতে বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের বিশ্বাসঘাতকতামূলক অতর্কিত হামলায় নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। মহাননেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাকে কুচক্রীরা আর বাঁচতে দিলো না; সুদীর্ঘকাল ধরে বর্ণাদ্য রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলো।
জন্ম হলেই মানুষের মৃত্যু অবধারিত। একজন মানুষকে হত্যা করা যায়, কিন্তু একটি মানুষ যখন একটি আদর্শ বা একটি জাতির আশা আঙ্খাকার প্রতীক হয়ে উঠে তখন তাকে হত্যা করা গেলেও তাঁর আদর্শকে হত্যা করা যায় না। জুম্ম জাতির মুক্তির পথ প্রদর্শক মহান নেতা এম এন লারমাকে হত্যা করা গেলেও তাঁর আদর্শ ও চিন্তা চেতনা আজো জুম্ম জনগণের কাছ থেকে মুছে দিতে পারেনি। তাঁর আদর্শকে বহন করে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য পাহাড়ের বুকে আমাদের বীর সেনানীরা লড়াই করে চলেছে। নতুন সমাজ বির্নিমাণের জন্য যখন আমরা স্বপ্ন দেখবো, আমাদের এমন একটি আদর্শকে লালন করতে হবে- যে আদর্শের মৃত্যু নেই। যে আদর্শ পৃথিবীর বুকে অজেয় এবং সবচেয়ে প্রগতিশীল। যে আদর্শ মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেবে। যে আদর্শ ধনী, গরীব, উচু-নিচু, নারী-পুরুষ ভেদাভেদ সৃষ্টি করে না। অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে নিরন্তর, জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হবে। মহৎ আদর্শের জন্য যারা লড়াই করে সমাজে তারা মরেও অমর। এই মর্মার্থ ও সারবস্তু জুম্ম তরুন সমাজের চেতনায় এম এন লারমা যেন হয়ে উঠে এক মুক্তি দিশারী।
বাচ্চু চাকমাঃ সাবেক সভাপতি; পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি