মতামত ও বিশ্লেষণ

জুম্মজাতির মুক্তির সংগ্রামে সামিল হতে নারী সমাজের প্রতি আহ্বান – বাচ্চু চাকমা

নারী প্রসঙ্গে এক সময়ের ফরাসীর সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপাট এর একটি প্রসিদ্ধ উক্তি দিয়ে আমার এই প্রবন্ধটি শুরু করতে চাই। নেপোলিয়ন বলেছিলেন, “তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দিবো”। উক্তিটি সারা বিশ্বে মানুষের নিকট অত্যন্ত সমাদৃত, অর্থবোধক ও প্রসিদ্ধ। নারীকে শিক্ষিত হতে হবে। কারণ, শিক্ষা একটা জাতির মেরুদন্ড। নারী শিক্ষিত হলে সে সমাজের চলমান বাস্তবতার নিরিখে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা বুঝার জ্ঞান হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস হবে। মানুষে, মানুষে ভেদাভেদ, শোষণ-বৈষম্য, নিপীড়ন, নারী-পুরুষের লিঙ্গভেদ, সমাজের মানুষের মধ্যেকার অত্যাচার, অবিচার কেন, এসবের যথাযথ উত্তর খুঁজে নিয়ে সমাধানের জন্যে তখন নারী সমাজ নিজেরাই এগিয়ে আসতে সক্ষম হবে। পৃথিবীর বুকে দাস সমাজ, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজ এই তিনটি সমাজ হাজার-হাজার বছর ধরে দুর্দান্ত প্রতাপে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছিল এবং এখনও পর্যন্ত সামন্ত সমাজের অবশেষ ও পুঁজিবাদী সমাজের জয়জয়কার প্রত্যক্ষ করছি। এই তিনটি সমাজের শ্রেণিচরিত্র বা বৈশিষ্ট্যসমূহ নারীদের মুক্তির জন্যে কখনো এগিয়ে আসেনি এবং আসবেও না। তাহলে নারী সমাজের পশ্চাৎপদতা ও নারী সমাজের জীর্ণদশার জন্য দায়ী কে? নারীর এই অবস্থার জন্য দায়ী কি পুরুষ, না অন্য কেউ?

এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পেতে হলে প্রয়োজন মানবসমাজ সম্পর্কে পরিষ্কার ধ্যান-ধারণা। আমি বরাবরই মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের স্তরগুলোতে নিয়ে যেতে চাই। আমরা যেই সমাজে জন্ম নিয়েছি, সেই সমাজের শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণ করে সমাজকে জানা খুবই জরুরি। আমাদের জুম্ম সমাজ হল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। পরিবারের প্রধান ও পরিচালক হলেন পুরুষেরা। আমাদের যে প্রথাগত শাসনব্যবস্থায় সাধারণত পুরুষেরাই প্রধান ভূমিকা পালন করে। তিন সার্কেলের প্রধান রাজা, বেশির ভাগ হেডম্যান ও কার্বারীই হল পুরুষ। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংগঠন, নাগরিক সংগঠনের প্রধানগণসহ জমিজমা ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার ক্ষেত্রেও পুরুষেরা প্রধান ভূমিকা পালন করে চলেছে। আমাদের সমাজব্যবস্থা এমনই যে, নারীর পারিবারিক কাজকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ স্বীকৃতি প্রদান করে না। সন্তান লালন-পালন, রান্না-বান্নাসহ সংসারের অন্যান্য কাজকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। যেসব কাজের মাধ্যমে অর্থ-সম্পত্তি আয় হয়, সেসব কাজকে কেবল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাজ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এটায় আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র। তবে ইদানিংকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছু কিছু লক্ষনীয় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।

জুম্ম সমাজের মধ্যে নারী হেডম্যান, কার্বারী, সংগঠন, উৎপাদন প্রক্রিয়া ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত, রাজনীতি, ব্যবসা, চাকরীসহ বিভিন্ন পেশায় নারী সম্পৃক্ততায় সমাজের পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। পার্বত্য নারী সমাজ লক্ষ্য পথে এগিয়ে যাবার প্রধান বাধা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, আমলা পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ ও উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক-বাহক দেশের শাসকগোষ্ঠী। মনে রাখবেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামী সম্প্রসারণবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের শাসকগোষ্ঠী সব সময় তৎপর রয়েছে। তাহলে আমাদের সমাজে নারী সমাজ কোন না কোনভাবেই শোষিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। নারীর পশ্চাৎপদতা ও শোষিত, নিপীড়িত অবস্থান হতে মুক্তি পেতে হলে সংগ্রাম ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। নারী সমাজের সবচেয়ে বড় শত্রু যেমনি শাসকশ্রেণি বিপরীতে সবচেয়ে প্রিয়জন ও বন্ধু হবে পাহাড়ের শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, মেহনতি গরীব জুম্ম জনগণ। যারা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন, আমাদের বীর সেনানীদেরকে শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে রক্ষা করেছেন বারবার। নারী মুক্তির আন্দোলনের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারী সমাজের ভূমিকা অপরিহার্য ও উল্লেখযোগ্য মনে করি। ১৯৭৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি এবং ১৯৮৮ সালে ৮ মার্চ হিল উইমেন্স ফেডারেশনগঠিত হয়। এই দুটি নারী সংগঠনের পতাকাতলে আদিবাসী জুম্ম নারীরা নারী মুক্তির আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের কর্মসূচীর সাথে সমন্বিতভাবে সংগঠনের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশন পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম নারীদের প্রতিনিধিত্ব করছে।

আমাদের পাহাড়ের জীবনধারা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে শোষণ আর বঞ্চনার কালোথাবায় গ্রাস করে ফেলছে জুম্ম সমাজকে। চতুর্মুখী অপসংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে। অত্যাচারী স্বৈরশাসকের ন্যায় আজ বাংলাদেশ সরকার আমাদের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি চলমান রেখেছে। আমাদের পাহাড়ের জীবনধারা আজ একটা সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন। সেই সংকট হতে উত্তরণের পথ দেখিয়েছিল আপোষহীন নারী নেত্রী, আজীবন সংগ্রামী নারী নেত্রী জ্যোতিপ্রভা লারমা, মাধবীলতা চাকমা, কল্পনা চাকমা ও জড়িতা চাকমারা। সেই সাথে আরও জুম্মজাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলো ৯০ দশকের আপোষহীন সংগ্রামী নারী নেত্রী, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা। জুম পাহাড়ের জুমিয়া নারী, কল্পনার তেজোদৃপ্ত বজ্রকণ্ঠস্বর কি কোনদিন শুনেছিলে, অসমশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা আদর্শের সুদৃঢ় চেতনা কি কোনদিন গভীরভাবে উপলদ্ধি করেছিলে এবং “একটি স্ফুলিঙ্গ দাবানল সৃষ্টি করে” যার বাস্তব প্রমাণ তো কল্পনা চাকমা স্বয়ং নিজেই।

আজ পাহাড়ের বুকে কল্পনা চাকমা অপহরণ হয়েছে ঠিক, কিন্তু তাঁর চেতনার তো কোনদিন মৃত্যু হয়নি। পাহাড়ের চূড়ায় ও পার্বত্য চট্টগ্রামের চারিদিকে শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে তাঁর চেতনা লালনকারী অসংখ্য জুম্ম নর-নারী আজ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা যায়, কিন্তু তাঁর আদর্শ ও চেতনাকে অপহরণ করা যায় না। যার ফলে কল্পনা চাকমার মত প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক নারীদের অপহরণ করে গুম করা হয়, দীর্ঘ ২৩ বছরেও কল্পনা চাকমার হদিস মিলে না! জুম্ম সমাজের সম্ভাবনাময়ী ও আপোষহীন সংগ্রামী নারী কল্পনা চাকমাদের অপহরণ করে শাসকগোষ্ঠী খায়েস মেটানোর এবং ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বাস্তবায়নের
বাস্তবায়নের ব্যর্থ চেষ্টা করে যেতে থাকে। আমরা আরও স্মরণ করতে পারি, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর সংগ্রামী জীবনকে। যিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গে জন্ম নেয়া বিপ্লবী সূর্যসেনের নেতৃত্বে তখনকার ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং জীবন বিসর্জন দেন এই মহীয়সী নারী। পশ্চাদপদ, ঘুণেধরা সামন্তীয় সমাজের জোয়াল থেকে বেরিয়ে এসে আরও অনেক সংগ্রামী নারী বিপ্লবী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছেন। তাদের জীবন দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য উৎসর্গিত করেছেন। এই প্রবন্ধে তাদের ত্যাগ ও অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী ও পূর্ণ সফলতা কামনা করে সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্যে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বাস্তব সত্যটুকু উপলদ্ধি করার পর এই সিদ্ধান্তে চলে আসতে হবে, সংগ্রামের ময়দানে নারীদের আজ খুবই প্রয়োজন। সুন্দরের প্রতি মানুষ মোহিত হয় সেটাই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু যে সুন্দর মানুষকে অমানুষ করে সেই সুন্দর আমাদের প্রয়োজন আছে কি? পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যে যে সুন্দর, চাকচিক্যময় জীবনকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, সেটা সম্পূর্ণ কৃত্রিম লেবাস দিয়ে তৈরি সুন্দর-সুন্দর জিনিসপত্র। সেই কৃত্রিম উপায়ে তৈরি সৌন্দর্য্যের প্রতি মানুষ মোহিত হয়ে সেখানে আমরা সবাই গা ভাসিয়ে দিই। সেই পুঁজিবাদী সমাজের লোভনীয় রঙিন ও চাকচিক্যময় জগতের প্রতি লোলুপতা এতো বেড়েছে যার কারণে নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যেতে দ্বিধাবোধ করছি না। নোংরামী, ভন্ডামী, প্রতারণা ও শাসন-শোষণের জর্জরিত সমাজ ব্যবস্থাকে ঘৃণার চেয়ে বরং জীবনের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়ে আনন্দ পূর্তির মহাযজ্ঞে নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছি। পুঁজিবাদী সমাজে টাকার বিনিময়ে আজ নোংরামী, ভন্ডামী মানুষগুলোকে সমাজের মধ্যে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে দিয়েকালো সাপ পুঁচেছি আর সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্নের কবর তৈরি করছি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আরও কঠিন থেকে কঠিনতর অবস্থায় ধাবিত হচ্ছে। এমনিতর পরিস্থিতিতে বিশেষ করে তরুণ নর-নারী সমাজের দায়িত্ব কি হবে? এই প্রশ্নের মীমাংসা নিজেকেই বের করতে হবে। অতীতের দিনগুলোতে আবেগ তাড়িত হয়ে অনেক অবাস্তব কল্পনা করে করে সময় ব্যয় করেছেন, আমিও এক সময় নাবুঝে, নাজেনে অযথা সময় করেছিলাম-সেটা আমি অস্বীকার করছি না। আজ সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে একটি সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হয়েছিলাম, নারীদের আমাদের মুক্তির সংগ্রামে সাথী হিসেবে আরো অধিকতরভাবে সম্পৃক্ততা হওয়ার জন্যে পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় দাবি করছে। জুম্ম জাতির করুণ অবস্থার মধ্যে আপনি জুম্ম জাতির মুক্তির আন্দোলনের সাথে আজীবন থাকবেন এটাই প্রত্যাশা করি। অনেকেই পড়ালেখা করেছিলেন একটা ভাল চাকরি করে মা বাবার স্বপ্ন বাস্তবে রূপদান করবো বলে। কিন্তু তার চেয়েও শতগুণ দায়িত্ব আজ আমার-আপনার মাতার উপর চেপে বসে আছে মনে করি। সেই দায়িত্ব আপনাকে আজ যথাযথ পালন করা দরকার। সেকারণে নারী সমাজই আমাদের সংগ্রামী জীবনে অধিকতর অনুপ্রেরণা যোগাবে এবং সাহস ও মনোবল দিতে পারবে। লোগাং-লংগদু-নানিয়াচর-ভূষণছড়া-কাচালং ও কলমপতি গণহত্যার নির্মম ইতিহাস আপনি ভুলে থাকতে পারেন না, যে গণহত্যাগুলোতে আপনার মা বোন লাঞ্ছিত হয়েছে, ছোট্ট শিশুদের অমানবিকভাবে হিং¯্রতার সাথে হত্যা করা হয়েছে, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাদের বসতভিটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সুন্দর জীবনকে চিরতরে অসুন্দরে পরিণত করে জুম্ম জাতিকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চিরতরে বিলুপ্ত করার হীন ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, সেখানে আপনি কোনদিন চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। আপনাকে লড়তে হবে! বাঁচতে হলে মানুষের অধিকার নিয়ে বাঁচবো, কারোর গোলামী হয়ে নই। আমাদের রক্ত গোলামী করে না, অন্যায়-অবিচার মানেনা, মুক্তির আকাঙ্খা আমাদের সব সময় তাড়িত করে।

আপনি নিশ্চয়ই জানেন, অধিকার কেউ কাউকে দেয় না। অধিকার আদায় করে নিতে হয়, অধিকার কেড়ে নিতে হয়। আমাদের জুম্ম জাতি এখনো বিজাতীয় শাসক-শোষকগোষ্ঠীর অনাচার-অবিচার থেকে মুক্ত হতে পারেনি। জুম্ম সমাজে অর্থনৈতিক সমস্যা প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মরা এখনো অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য আমাদের হাতে আসেনি। বিজাতীয় শাসকের হাতে এখনও কলকাঠি রয়ে গেছে! এই সকল বিষয়গুলো আমাদের অনুকূলে নিয়ে আসতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক অধিকার। রাজনৈতিক অধিকার ছাড়া জুম্ম জনগণের সামগ্রিক মুক্তি সম্ভব নয়। বর্তমান বাস্তবতা দাবি করে যে, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে ৭০ দশকের ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় আমাদের ফিরে যেতে হবে। সেই সময়ের প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে আমাদের সকলকে জ্ঞাত থাকা দরকার মনে করি। দীর্ঘ ২ যুগের অধিক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রাম কিভাবে হয়েছিল? প্রথমত, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মহান সংবিধানে পার্বত্যাঞ্চলের জুম্ম জনগণের জাতিগত আত্মপরিচয়কে কেড়ে নেওয়া হল। সমগ্র জুম্ম জনগণকে কলমের কসায় সংবিধাণে বাঙ্গালি বলিয়া পরিচয় করে দেওয়া হল। জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় প্রতিনিধি তখনকার সাংসদ প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংবিধাণ বিলে স্বাক্ষর না করে সরাসরি সংসদ ওর্য়াকআউট করলেন। এছাড়া আরও অনেক গনতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল বাঙ্গালি সাংসদ আদিবাসীদের বাঙ্গালি বানানোকে মেনে নিতে পারেননি। তারাও সংবিধাণ বিলে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত ছিলেন। তারপর কর্মস্থলে ফিরে এসে সহকর্মীদের সামনে রাগে-ক্ষোভে বলেছিলেন, এভাবে আর হবে না। অন্য পথ ধরতে হবে। তারপরও স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে পুনরায় ডেপুটেশন দিয়েছিলেন স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট। প্রয়াতনেতা সেখানে দাবী করেছিলেন জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থা ও অধিকার। শেখ মুজিবুর রহমান এই ডেপুটেশনের দাবীকে গ্রহণ না করে বরং উল্টো হুমকি দিলেন। এভাবে গনতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে ১৯৭৩ সালে ৭ জানুয়ারী গড়ে তুলেছিলেন জুম্ম জনগণের প্রাণের সংগঠন জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে স্বশস্ত্র শান্তিবাহিনী।

১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করার পর পরই দেশের সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়। অগনতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা পালাবদল হওয়ার পর প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আত্মগোপনে চলে গেলেন। তারপর প্রয়াতনেতা এম এন লারমার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে গ্রাম পঞ্চায়েত, মহিলা সমিতি, যুব সমিতি ও মিলিশিয়া বাহিনী। শুরু করেছিলেন সরকারের অত্যাচার ও নিপীড়ণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম। তাঁর নেতৃত্বে পুরো জুম্ম জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে এবং সামরিক বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ প্রয়াতনেতার শক্ত পরিচালনায় ও শিক্ষায় শান্তিবাহিনীকে ক্রমান্বয়ে এক শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল মুক্তিবাহিনী হিসেবে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জনসংহতি সমিতির এই নেতৃত্ব ও সামরিক দক্ষতা সরকারের মনে ত্রাসের সঞ্চার হয়েছিল। দেশে-বিদেশে জুম্ম জাতির সংগ্রামের কথা, শান্তিবাহিনীর বীরত্বের কথা প্রচার হয়েছিল। জুম্ম জনগণের অন্তরে জনসংহতি সমিতি এভাবে জায়গা করে নিয়েছিলেন। এভাবে চলেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে দীর্ঘ ২ যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রাম। অগণিত জুম্ম জনগণের রক্তের বিনিময়ে অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে শতশত জুম্মদের বসতভিটা হারানোর বিনিময়ে ১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জুম্ম জনগণের মুক্তির সনদ হিসেবে আমরা যে চুক্তিকে আখ্যায়িত করি, সেই চুক্তি এখনো উগ্র বাঙালির জ্যাত্যভিমান, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদের করালগ্রাসে জর্জরিত এবং প্রতিক্রিয়াশীল সুবিধাবাদীদের অমানবিক আচরণে ক্ষতবিক্ষত ও বিলুপ্ত প্রায় আমাদের জুম্ম জাতীয় সংস্কৃতি।

জুম্ম জনগণকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চিরতরে নিচিহ্ন করার ষড়যন্ত্র শাসকগোষ্ঠী আজও অব্যাহত রেখেছে। অনেক তরুণ-তরুণীকে আজ মুক্তির তাড়নায় তাড়া করে বেড়ায়। সকল প্রকার নির্যাতন নিপীড়ন থেকে মুক্ত হওয়ার বাসনা অধিকতরভাবে তাড়িত করে। আজ নারী সমাজকে মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণ ছাড়া এই মহৎ কাজে আমরা সফল হতে পারবো না। বিপ্লবের জয়গান আপনাদেরই গাইতে হবে। এই সুন্দর পৃথিবীতে আমাদের যদি কেউ আপনজন থেকে থাকে তাহলো একমাত্র লড়াইয়ে সহযোগী হিসেবে পার্বত্য নারী সমাজ ও সমগ্র জুম্ম জনগণ। আমাদের জীবন আমাদের মতো থাকবে। আমরা আমাদের মতো করে চলবো-ফিরবো-সবকিছু আমাদের মত করে সাজাবো। স্বপ্ন পূরণের একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিতে হবে প্রগতিশীল আদর্শকে। যাকে মানবতাবাদী প্রগতিশীল আদর্শ হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। এই আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার আশায় আমরা সংগ্রামে সামিল হয়েছি। এখনো আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অনাচার-অবিচার দেখা যায়। এখনো হিংসা-বিদ্বেষ পরস্পরকে অবজ্ঞা করা, হেয় প্রতিপন্ন করা সেটা প্রবাহমান। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থাকে আমাদের বদলাতে হবে। সমাজ পরিবর্তন করার দায়িত্ববোধ থেকে বলছি, আমরা আজীবন এই কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই। সেখানে সংগ্রামে সামিল হতে আপনাদের খুবই প্রয়োজন।

কথা আছে, “বিশ্বের যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’’। আপনি শ্রমিক, কৃষক, রিকশাওয়ালা, জেলেসহ সকল মেহনতি মানুষের কথা বলবেন। সকল নিপীড়িত-শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলবেন। নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা বলবেন, মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলবেন, জুম্ম জনগণের সামগ্রিক মুক্তির কথা বলে যাবেন। আমরাও স্বপ্ন দেখি, আমাদের জুম্মল্যান্ড বিজাতীয় শাসন-শোষণ থেকে একদিন মুক্ত হবে। আমাদের পাহাড়ের করুণ আর্তনাদ আর কান্নার আহাজারি থেমে যাবে। এই জুম পাহাড়ে জুম্মরা নিরাপদে-নিচিন্তে ঘুরে বেড়াবে, আমাদের জীবন আমাদের মতো হবে। সুন্দর সমাজ এখানে প্রতিষ্ঠিত হবে। আপনি একটু গভীরভাবে উপলদ্ধি করেন কি করা যায়! শত হাজারো শিক্ষিত যুবককে বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মহান চেতনা ও মহান স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের কাছে ফিরে যেতে হবে, তাদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটির সঙ্গে গভীরভাবে মিশে গ্রামাঞ্চলের অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে থাকা নিপীড়িত-বঞ্চিত, গরীব-দুঃখী মানুষের কাছে ফিরে যেতে হবে। তরুণ-তরুণীদের নবলদ্ধ জ্ঞান প্রকাশের জন্য যেতে হবে, অপেক্ষাকৃত প্রাচূর্যময় জীবন গড়ে তোলার জন্য জুম্ম জনগণের কাছে সংগ্রামের মশাল জ্বালাতে হবে। আমরা যেন হতে পারি আজ সেই পথের পথিক, তরুণ নারীদেরও থাকতে হবে আমাদের সাথে লড়াইয়ের ময়দানে। যাতে সুন্দরতর পৃথিবী গড়ে তোলা যায়-এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের একমাত্র সূত্র হলো এম এন লারমার নীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এই আদর্শকে বয়ে নিতে হবে তরুণ যুব সমাজ ও পার্বত্য নারী সমাজকে যাতে করে জুম্ম জনগণের সম্মতি ও সমর্থন লাভ করা যায়।

অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমরা পেয়েছি আদর্শ প্রচারের একটি শক্তিশালীধারা, কাজের মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ জুম্ম জনগণের সামনে হাজির করতে হবে-রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি সম্পর্কের নতুন নতুন ধারণা। আমাদের সব সময় যেন মনে হয় এবং এক অদ্ভূত অনুভূতি কাজ করতে হবে, আমি যেন তীব্র জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত একদল তরুণ ছাত্র সমাজের মধ্যে বাস করছি। “ইতিহাসের বিচিত্র ছকের ফলে আজ ক্রিকেট খেলা ও ফুটবল খেলা, প্রেম-ভালবাসা, অপ্রয়োজনীয় আড্ডার আসরপ্রভৃতি যা অন্য দেশের যুবক-যুবতী তরুণ-তরুণীদের কাছে প্রধান আকর্ষণ হলেও তার চেয়ে এই সংগ্রামী জীবনই যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের তরুণ সমাজ ও নারী সমাজের কাছে বেশি জরুরি বলে মনে করি”। পরিস্থিতি ও বাস্তবতা তাই দাবি রাখে। কখনো কখনো আমার নিজেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে যে, সংকল্পে অটল এই তরুণদল এম এন লারমার প্রদর্শিত আদর্শকে আত্মস্থ করে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী গণসংগ্রাম পরিচালনা করতে পারবে কিনা! আমরা যে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাব তার শক্তির উৎস কোথায়? এধরনের প্রশ্ন এসে হাজির হয়েছে এবং এরই উত্তর আপনাদের নিজেকে খুঁজে বের করতে হবে। প্রধানত তরুণ সমাজ বিপুল সমাবেশ ছাড়া এই আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। পারবে কি আমাদের তরুণ সমাজের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশাল জুম্ম নারী সমাজকে আত্মবলিদানে পথ বেছে নিতে? আমি আশাবাদী পার্বত্য চট্টগ্রামে তরুণ ছাত্র ও যুব সমাজ এম এন লারমার প্রদর্শিত আদর্শের উদ্বুদ্ধ হয়ে শত শত তরুণ-তরুণীর মনে আনুগত্য ও সমর্থন লাভ করতে পারবেন। আপনিও সেই তরুণ-তরুণীদেরই একজন অন্যতম!

এ কথা আমি সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই যে, এ সংগ্রামে কাজ করতে গিয়ে আনন্দ ও বেদনা দুটোই বাস্তবে আমি গভীরভাবে অনুভব করছি। আনন্দ হল আমি গোটা নিপীড়িত জুম্ম জনগণের হয়ে কাজ করছি, বেদনা আর যন্ত্রণা তো সংগ্রামী জীবনের নিত্য দিনেরই সঙ্গী। কারণ হল, নিপীড়িত সমগ্র জুম্ম জনগণ যখন ব্যতীত, পীড়িত তখন আমরাও সেই একই ব্যথা-বেদনা অনুভব করি। সমগ্র জুম্ম জনগণের ব্যথা-বেদনাকে নিজের মধ্যে সঙ্গী করে সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। আজ এই রাঙ্গা-বান্দর-খাগড়া শহরে আপনার হয়তো ফেলে আসতে হবে পবিত্রতম আকাক্সক্ষাগুলো এবং আপনার একান্ত ভালবাসার মানুষগুলোকেও। আর জুম্ম জনগণকে ফেলে আসতে হবে,যারা হয়তো আপনাকে একদিন আপন সন্তান হিসেবে গ্রহণ করবে। এখানে আমাদের সবচেয়ে প্রেরণার একটি দিক আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। যুদ্ধের নতুনতর প্রাঙ্গণে আমরা পর্দাপন করছি জেনে প্রয়াতনেতা এম এন লারমা থেকে পাওয়া বিশ্বাসবোধকে আপনি প্রতিটি মুর্হুতে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন এবং সব সময় তা বহন করে নিয়ে যাবেন। জুম্ম জনগণের বিপ্লবী চেতনাকে সঙ্গী করবেন-এ মনোভাব আমাদের সবাইয়ের কাছে অটুট থাকবে যে, আমরা কর্তব্যের পবিত্রতর অংশটুকু সম্পন্ন করতে যাচ্ছি। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে বিজাতীয় শাসক-শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরুদ্ধে আমাদের এ লড়াই। এই লড়াই হলো জুম্ম জনগণের মুক্তির লড়াই! এই লড়াইয়ে জুম্ম নারী সমাজকে থাকতে হবে আমাদের সংগ্রামী সাথী হিসেবে। বেশি কিছু বলার দরকার মনে করি না, কারণ বিষয়টা হলো গভীর উপলদ্ধির এবং অনুভব করার বিষয়! চেষ্টা করে যেতে হবে আমরা সকলেই জুম্ম জাতির শেষ পরিণতি পর্যন্ত মুক্তির সংগ্রামের প্রতি বিশ্বাস রাখতে। এই পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় কি করবেন সেটা আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম। স্বস্ব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সংগ্রামের জন্য আমাদের সকলকেই প্রস্তুত থাকতে হবে হয়তো বা মৃত্যুর জন্যও।

পৃথিবীর মানচিত্রে একটি ছোট অংশে আমরা যদি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে না পারি এবং সংগ্রামের প্রয়োজনে আমাদের সামান্য যা আছে সবটুকুই নিঃশেষে অর্পণ করি, আমাদের জীবন, আমাদের ত্যাগ যদি জুম্ম জাতির মুক্তির জন্য হয়ে থাকে তাহলে সেখানে নারীদেরও থাকতে হবে সংগ্রামের সাথে। সারা পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আহব্বান আমাদের কানে বাজতে হবে। আমরা ডাক দিতে চাই নির্যাতিত নিপীড়িত অগণিত মানুষকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ হলো সারা বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র। অনেক জুম্ম জনগণ এখনও ভূমিহীন, শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসন্তোষ তাদের মধ্যে দিন দিন দানা বেঁধে উঠছে। এম এন লারমার ডাক পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছছে, পৌঁছেছে সারা পৃথিবীর সংগ্রামী মানুষের প্রাণের গভীরে। নারীর সমাজ সংগ্রামের সাথে থাকলে অসংখ্য মানুষের অন্তরের একান্ত ভালবাসা আমরা খুবই সহজেই অর্জন করতে পারবো-এই বিশ্বাস আমাদের রয়েছে। অনেক কিছু না পাওয়ার মধ্যেও জীবনে অপূর্ণতা থাকলেও আপনারা সংগ্রামের সাথী হলে সেটাই তো আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া।

আমাদের জীবন সংগ্রামে পরিপূর্ণ রূপ করতে হলে জুম্ম নারীকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়া অধিকতর প্রয়োজন। আমি আজ স্বপ্ন দেখছি-একা নই, আমরা কয়েকজনও নই, আমরা লক্ষ লক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ একই স্বপ্ন দেখছি। আমি বরাবরই নারী সমাজকে খুবই সংগ্রামী মনে করি। নিজের নির্ধারিত পথে আমরা এখনও বলিষ্ঠভাবে এগিয়ে যাচ্ছি এবং আমি ভাবি কোন কোন সময়ে তরুণ-তরুণী সকলেই পরিস্থিতি ও বাস্তবতাকে ঠিকমত বুঝতে পারেন না। কিন্তু আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও বাস্তবতাকে বুঝতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে। নিজের ইচ্ছাশক্তি শিল্পীর সাধনা দিয়ে গোটা দুনিয়াকে পরিপূর্ণ করা সহজ নয়, সেখানে নারী-পুরুষের সাথী হিসেবে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রয়োজন খুব বেশি। একবিংশ শতাব্দীর এই যুগ সন্ধিক্ষণে একটু ভাববেন-কি করা যায়!

এই নিষ্ঠুর যুদ্ধের ময়দানে জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের জীবন মানে অভ্যস্ত মানুষগুলোকে একটি শত্রু অঞ্চলে দিনের পর দিন কাটাতে হচ্ছে, নড়াচড়া করার সহজ সাধ্য নেই, তারপরও শত্রু অধ্যুষিত অঞ্চলেই আমাদের পা দিতে হবে। এটায় বাস্তব সত্য ঘটনা! শাসকগোষ্ঠীর সমস্ত প্রাণশক্তি দিয়েও নিপীড়িত মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে কেমন করে তাকাবো যদি সেখানে নারী সমাজের প্রাণের স্পন্দন না থাকে। যেই মানুষটি মানবতার উপর অবিচার দেখে পাগল প্রায় তাকে আপনাদের অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে, অবহেলা করা কখনও ঠিক হবে না। আমাদের সংগ্রামী জীবনে সাথী হয়ে বিপ্লবের ময়দানে অনুপ্রেরণা দিয়ে যেতে হবে, সহযোগিতা করতে হবে ও মনোবল দিতে হবে। আন্দোলন ছাড়া আমরা কিছুই ভাবতে পারি না-সেটা এখনো পার্বত্য নারী সমাজ অন্তরের গভীরে গিয়ে যথাযথভাবে উপলদ্ধি করে এগিয়ে আসতে পারেনি। আপনাদের বুঝতে হবে, আমাদের যে যুদ্ধ চলছে তা চিরদিন থাকবে না। কারণ যুদ্ধ রূপান্তরিত হয় শান্তিতে। পার্বত্য চট্টগ্রামে একদিন শান্তি আসবে-কিন্তু তার বিপরীতে যুদ্ধ অনিবার্য। পার্বত্য চট্টগ্রামে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে নারীকে আমাদের সাথে থাকতে হবে, আবারও বলছি আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাবেন, সাহস দেবেন-মনোবল দেবেন এটায় আমার বিশ্বাস। সেকারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে চিরকাল আমাদেরকে মানুষ স্মরণ করবেন অথবা মনে রাখবেন।

সত্যিকার অর্থে মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রামের ময়দানে আমাদের সাথে আজীবন থাকতে হবে। অনেক স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করি। নারীসমাজকেও বাস্তবে আন্দোলনের সঙ্গী হিসেবে পেতে চাইছি। শাসকগোষ্ঠীর নিষ্ঠুর আচরণে আজ মানবতা ক্ষতবিক্ষত। বিলুপ্ত প্রায় আমাদের জন্মভূমির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অধিকার। এম এন লারমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে তো? দুনিয়া জুড়ে সা¤্রাজ্যবাদের ত্রাসের রাজত্ব চলছে। নয়া সা¤্রাজ্যবাদের নীতি ও কৌশল দুনিয়ার মানুষকে বোকা বানিয়েছে। গরীবকে আরো গরীবে পরিণত করছে, ধনীকে আরো ধনীতে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষের প্রতি মানুষের বৈষম্য প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। কেননা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতার সাথে নারী সমাজ ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের শরণার্থীর জীবনে যেতে হয়েছে। যদিও সেই কঠিন জীবনে যাওয়া অনেকেরই সুযোগ হয়নি। তারপরও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু জীবন অনেকের কাটাতে হয়েছে, নিজ দেশে আজ আদিবাসী জুম্মরা পরবাসী!

সেই ৮০ দশকের সময়ের প্রেক্ষাপটের কথা যদি তুলে ধরি তাহলে স্মরণে আসবে, হরিণার পাহাড়গুলো আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতো, কারণ পাহাড়গুলো আমাদের পাড়ি দিতে হবে-সীমান্তের কাছাকাছি আমাদের বসবাস করতে হবে। গভীর রাতে-অন্ধকারে মা-বাবার হাত ধরে জীবন বাঁচানোর তাগিদে নৌকায় চড়ে হরিণার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার মুর্হুতগুলো আমাকে বিষণভাবে আহত করছে। অথচ হেসে-খেলে কাটানো শৈশবকাল আর নিরাপত্তাহীন কৈশোরকাল কেটেছিল লুকিয়ে লুকিয়ে, ভয় ও আতংকের মধ্য দিয়ে। যেই সময়ের মধ্যে উজ্জল ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন বুনতাম, স্বপ্ন দেখতাম সেই সময়ে আমাকে ভয় আর আতংক তাড়া করতো। বহিরাগত সেটেলার বাঙালিদের নির্যাতনের ফলে হারিয়েছিলাম নিজের বসতভিটা ও ধান্যজমি, আর সেই সাথে হারিয়েছিলাম সম্ভাবনাময় শৈশবকাল ও কৈশোরের বেড়ে উঠার সঠিক সময়। জুম্ম জাতির লক্ষাধিক মানুষের করুণ ও বেদনার শরণার্থী জীবনের কথা লিখতে গিয়ে সেই সুযোগে আমাদের পালিয়ে যাওয়ার কষ্টগুলো সামান্য পরিসরে তুলে ধরেছি। কাজটি কঠিন, আঁকা-বাঁকা ও পিচ্ছিল হলেও লড়াই আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। জুম্ম জাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে, আন্দোলনের স্বার্থে সংগ্রামের সাথে আজীবন থাকতে হবে। নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মুক্তির সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হোক!!!

বাচ্চু চাকমা : সাবেক সভাপতি, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ।

Back to top button