জাতীয়

জাতীয় সংলাপঃ সংখ্যালঘু ও আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সকল রাজনৈতিক দলকে দ্রুত এগিয়ে আসার আহ্বান

আইপিনিউজ ডেস্কঃ শনিবার ১৪ মে ২০১৬ সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ আয়োজিত জাতীয় সংলাপে জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনজীবনে বিরাজিত সংকটজনক পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং তাদের উত্থাপিত ৭-দফা দাবীর প্রতি সুগভীর সংহতি ও একাত্মতা প্রকাশ করে বলেছেন, সংখ্যালঘু সমস্যা কেবল সংখ্যালঘুদেরই নয়। এ সমস্যা জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যার সমাধানে জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দেশে সকল রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় দেশের শান্তি, উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
সাংসদ ঊষাতন তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংলাপে অন্যান্যের মধ্যে অংশগ্রহণ করেন আওয়ামী লীগের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি ও মোহাম্মদ নাসিম এমপি, বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য লেঃ জেঃ মাহবুবুর রহমান ও চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহ্‌মুদ চৌধুরী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য, কম্যুনিষ্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা), সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ, নারী নেত্রী খুশী কবির, সাংবাদিক শাহ্‌রিয়ার কবির, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, ডা. জাফরউল্লাহ্‌ চৌধুরী, মাহ্‌বুবউদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম (এসপি মাহবুব), সাংবাদিক কামাল লোহানী, অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মেসবাহ্‌ কামাল, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি, সাম্যবাদী দলের সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া প্রমূখ। জাতীয় পার্টির সম্মেলন থাকায় নেতৃবৃন্দের কেউ উপস্থিত থাকতে না পারলেও সংগঠনের কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের সংলাপের সফলতা কামনা করে এক বার্তা প্রেরণ করেন। সংলাপে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন এ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, আমাদের সমাজ শ্রেণি বিভক্ত সমাজ। তাই এ সমাজে জাতিগত, বর্ণগত, অর্থনৈতিক, লিঙ্গগত বৈষম্য বিরাজ করে। ফলে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসীরা মানবতাবিরোধী নানা নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। সারা দেশেই সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ওপর শোষণ-নিপীড়ন চলছে। দেশে যেভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চলছে, যেভাবে দেশছাড়া করা হচ্ছে, তাতে এই দেশ একদিন আদিবাসী ও সংখ্যালঘুশূন্য হয়ে যাবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এই সমস্যা সমাধানে আমাদেরই লড়াই করতে হবে। লড়াই ছাড়া এর সমাধান আসবে না বলে তিনি দৃঢ় মত ব্যক্ত করেন।
শ্রী লারমা আরো বলেন, ঐকমত্যের ৭-দফা দাবী পূরণের দায়িত্ব সরকারের। শুধু সমর্থন দিলেই হবে না, করণীয়ও তাদের নির্ধারণ করতে হবে। তিনি ৭-দফা দাবীকে আদিবাসী-সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ‘প্রাণের দাবী’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, দাবী আদায়ে আন্দোলন অপরিহার্য। এ আন্দোলনে সবাইকে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। সন্তু লারমা আরো বলেন, এ আলোচনায় যারা অংশ নিয়েছেন আমি মনে করি সবাই একমত হবেন যে শুধু সমর্থন ও সহানুভূতি দিয়ে এ দাবি অর্জন সম্ভব নয়। বাম হোক, জাতীয়তাবাদী হোক- কোন দলই তাদের নিজস্ব কর্মসূচী নিয়ে আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে এগিয়ে আসেনি। আমরা যারা সংখ্যালঘু ও আদিবাসী তাদের পক্ষে কি জাতীয় পর্যায়ে আন্দোলন করার ক্ষমতা আছে? তাই প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে আজকে যারা ভুক্তভোগী তাদেরই এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হবে বলে জানান তিনি। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় থেকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের মধ্যে অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তি ও জাতীয় ব্যক্তিত্ব রয়েছেন তাদের মধ্য থেকে এই আন্দোলনের নেতৃত্বে এগিয়ে আসতে হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, হিন্দুদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তি ক্ষমতাসীনদের কাছে নিবেদিত থাকেন। ক্ষমতাসীনদের সাথে থেকে তারা কেবল তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে থাকেন। এভাবে পরমুখী মানসিকতা নিয়ে কোন জনগোষ্ঠী অধিকার পেতে পারে না বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
শ্রী লারমা উল্লেখ করেন যে, ক্ষমতাসীনদের বক্তব্য থেকে বুঝা যায় তারা সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের বিষয়ে গভীরভাবে ভাবে না। তারা ভাসাভাসা বক্তব্য দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলেন বলে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন। এদেশের শাসকগোষ্ঠী অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে গণমুখী শাসন ব্যবস্থা নেই বলে উল্লেখ করে দুঃখের সাথে সন্তু লারমা বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে আজ ৪৪ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও সেখানে সেনাশাসন বলবৎ রাখা হয়েছে। আদিবাসীরা সেখানে চরম নিপীড়নের শিকার। পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় দ্রুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে সন্তু লারমা বলেন, দুই দশকেও এ চুক্তির বাস্তবায়ন হয়নি। চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারে না বলে তিনি জানান।
ঐক্যন্যপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের সমস্যা কেবল সংখ্যালঘুতার নিরিখে দেখলে হবে না, এটা মুক্তিযুদ্ধ চেতনার আলোকে দেখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছি ঠিকই, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সেভাবে বিকশিত করতে পারেনি। তাই দেশে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদ ইত্যাদি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ, দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। একটা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্নকরণের ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বাংলাদেশ, সমতার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ন্যায়-সঙ্গত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংখ্যালঘু-আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানান শ্রী ভট্টাচার্য।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি সংলাপে অংশ নিয়ে ক্ষোভের সাথে বলেন, আমরা সংখ্যালঘুরা পাকিস্তানী আমলের মতো আমানত হিসেবে থাকতে চাই না। অসাম্প্রদায়িক সরকার ক্ষমতায় থাকার পরেও এ দেশের ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর যথাযথ অংশীদারিত্ব ও ক্ষমতায়নের অধিকার নিশ্চিত করা হবে না তা হবে না। শুধুমাত্র আশ্বাসে আর চিড়ে ভিজবে না। সংখ্যালঘুরা তাদের ন্যায় সংগত অধিকারের জন্যে লড়াই করবে, এটি-ই আজ বাস্তবতা। দেশে সকল রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সংলাপের আয়োজনকে এক অভূতপূর্ব সাফল্য বলে বর্ণনা করেন।
মোহাম্মদ নাসিম এমপি বলেন, জনগণের সমস্যা মোচনে সরকার আন্তরিক। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদক্ষেপও গ্রহণ করছে। তবে সব কিছুই মসৃণভাবে করতে পারছে না বিভিন্নমুখী বাধার কারণে। প্রশাসনের মধ্যে গণবিরোধী শক্তির অবস্থান আছে। সংখ্যালঘুদের জমি-জমা যারা দখল করছে, হামলা করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অবশ্যই একদিন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৭২-র সংবিধানে পৌছুতে পারবেন। সংখ্যালঘু-আদিবাসীদের সকল বিষয়ে সরকার সচেতন রয়েছে। কোন অন্যায়কে ছাড় দেয়া হবে না। পার্বত্য চট্টগ্রা চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সেকথাই ব্যক্ত করেছেন। তিনি সংখ্যালঘু-আদিবাসীদের দাবী পূরণে সরকারকে সময় দেয়ার জন্যেও আহ্বান জানান।
আমির খসরু মাহ্‌মুদ চৌধুরী বলেন, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, আইনের শাসন, মানবাধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ইত্যাদি যথাস্থানে না থাকলে সমাজের অনেক চাহিদা পূরণ সহজ হয় না। তিনি ৭-দফা দাবীর প্রতি তাঁর দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে বলেন, এর অনেকগুলোই বাস্তবায়নযোগ্য। কিছু দাবী আলোচনার দাবী রাখে। ২০০১ সালের পূর্বাপর সময়ে সংঘটিত শাহাবউদ্দিন কমিশনের মতো বর্তমানেও সংখ্যালঘুদের জায়গা-জমি, বাড়ী-ঘর দখল ও তাদের উপর হামলার সাথে যারা জড়িত তাদের সুচিহ্নিত করার জন্যেও তদন্ত কমিশন গঠনের দাবী জানান।
লেঃ জেঃ মাহবুবুর রহমান তার বক্তব্যে সংবিধানে সমতা ও সম-মর্যাদা বিরোধী যা কিছু আছে তা সংশোধনের উপর জোর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, দেশত্যাগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বাধ্য হচ্ছে, দু’দশক পেরিয়ে গেলেও পার্বত্য শান্তিচুক্তি আজো বাস্তবায়িত হয়নি- এটি দুঃখের বিষয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি ৭দফা দাবি সমর্থন জানিয়ে বলেন, এই দাবি বাস্তবায়নে তাদের দল কাজ করবে।

রাশেদ খান মেনন এমপি সংবিধানের সাংঘর্ষিক বিধানসমূহ বিলুপ্ত করতে না পারা ‘দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনক’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধনকালে যতটুকু চাপ রাজনৈতিক দলগুলোর করা উচিত ছিল তা করে নি। পাকিস্তান আমলের মতো সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে তারা এগিয়ে আসছে না। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন সে দল সংখ্যালঘুদের জায়গা-জমি দখলে এগিয়ে থাকে। এটি অস্বীকারের আজ আর কোন উপায় নেই। তা-ই সংখ্যালঘু-আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষায় দল-মত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার সময় হয়েছে। প্রাক্তন সেনাপ্রধান হিসেবে লে: জে: মাহবুবুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন সংশোধনে যে বাধাগুলো রয়েছে সেগুলো অপসারন করতে হবে বলে তিনি জানান।
এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল প্রশ্ন তোলে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল উল্টো দিকে চলছে কি না, আপোষকামীতার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তিসমূহের এজেন্ডা পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে কি না। আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে অংগীকারাবদ্ধ। সংখ্যালঘু সমস্যা কেবল তাদের নয়, এটি জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যা পূরণে সকল রাজনৈতিক, সামাজিক শক্তিকে দৃঢ় অংগীকার নিয়ে এগিয়ে আসার এখনই সময়।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের দপ্তর সম্পাদক দীপংকর ঘোষ কর্তৃক স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে, ‘২০ মে দাবী দিবস’ হিসেবে জাতীয় ঐকমত্যের ৭-দফা দাবীতে এবং সংখ্যালঘু-আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর হামলার প্রতিবাদে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ আগামী ২০ মে সারা দেশে সমাবেশ, মিছিল ও প্রধানমন্ত্রী সকাশে স্মারকলিপি পেশের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে ঐদিন বিকেল ৩:০০ টায় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।

Back to top button