মতামত ও বিশ্লেষণ

জাতীয় বাজেট হোক আদিবাসী বান্ধব: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রস্তাবনা ও সুপারিশ

প্রেক্ষাপট
জাতীয় বাজেট ২০১৮-১৯ দেশের সকল জনগোষ্ঠীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দলিল। অর্থায়নের জন্য করারোপ ও বাজেট ব্যায় বরাদ্দের ধারার ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকাকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের ৩০ লক্ষাধিক পিছিয়ে পড়া আদিবাসী জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিগত বাজেট গুলোর কোনটিতেই পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। এবং বরাদ্দকৃত বাজেট বরাবরই প্রকৃত আদিবাসী জনসংখ্যার তুলনায় ছিল অপ্রতুল।

জাতীয় নির্বাচনের এ বছরে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের মানদন্ডে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল- কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয় (বাংলাদেশে যা বর্তমান; ১৭৫২, টাকার মূল্য প্রায় ১,৪৫,৪১৬ টাকা) । ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগনের কয় জনের জাতীয় মাথাপিছু আয়ের সাথে সামঞ্জস্য আছে তা সত্যিই ভাবার বিষয়? একদিকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার স্বীকৃতি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এনে দিচ্ছে মর্যাদা অন্যদিকে তা উন্নয়ন সহযোগীদের বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করছে। ফলে নিজস্ব অর্থায়নে আদিবাসী সহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন সরকারের কাছে খুবই চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯ জুন ২০১৭ জাতীয় সংসদের মিডিয়া সেন্টারে ‘আদিবাসী ও বাজেট’ বিষয়ক মতবিনিময় সভায় আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের বক্তাদের কথায় বিষয়টি প্রতীয়মান, ‘জাতীয় বাজেটের আকার বড় হলেও আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ অনেক কম। বাজেটে পাহাড়ে বরাদ্দ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। পাহাড়ের বাঙালি ও পাহাড়ী উভয়ের জন্য এই বাজেট। সমতলের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৩০ কোটি টাকা। এখানে আদিবাসীদের সঙ্গে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের জন্য এই অর্থ রাখা হয়েছে, যা সত্যিই হতাশাজনক।’

মিলেনিয়াম ডেভেলেপমেন্ট গোলের (এমডিজি) লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ সফল হলেও আদিবাসী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বা ভিশন ২০৩০ নিয়ে বাংলাদেশের সাধারন জনগণের জীবনযাত্রা উন্নয়নের পাশাপাশি আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগনের ভাগ্যের পরিবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ। আসন্ন জাতীয় বাজেট তাই আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষের কথা বিবেচনা করে প্রণীত হবে এবং ২০২৪ সালে বাংলাদেশ স্থায়ীভাবে মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হবে এটাই আদিবাসীদের প্রত্যাশা।

আদিবাসী পরিচিতায়ন ও জনসংখ্যা

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের আদিবাসীদের বিভিন্নভাবে পরিচিত করেছেন, যেমন ‘উপজাতি’, ‘ট্রাইবাল’, ‘ইনডিজিনাস পিপল’ ও ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ইত্যাদি। রাষ্ট্র সবশেষে বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ২৩(ক) উপধারার মাধ্যমে এ জাতিসত্তাসমূহকে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ হিসেবে সংবিধানে উল্লেখ করেছেন । দেশের মূল জনস্রোতের আরোপিত সাম্প্রদায়িক এই প্রত্যয়গুলোর উর্দ্ধে থেকে রাষ্ট্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের চিরন্তন অভিব্যক্তিকে উপলব্ধি করে এদেরকে ‘আদিবাসী’ হিসেবেই পরিচয় দিবেন, এ দাবি আদিবাসী জনগণের।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৫ কোটি ৫৮ লাখ । উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৫,৮৬,২৩২ জন । ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগণ, এ হিসাবে দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১.১০ ভাগ। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের দাবি, বাংলাদেশে ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগণ বসবাস করেন । বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাথে সরকারি পরিসংখ্যানে জনসংখ্যা নিরূপনের বিস্তর এ ব্যবধান, সত্যি ভাবার বিষয়। সমতল এবং পাহাড়ের আদিবাসীদের নিয়ে কর্মরত মানবাধিকার সংগঠন ‘কাপেং ফাউন্ডেশন’ সহ বিভিন্ন আদিবাসী নেতৃবৃন্দ ও তাদের নেটওর্য়াক সমূহের মতে, বাংলাদেশে ৫৪ টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কমপক্ষে ৩০ লক্ষ জনগনের বসবাস রয়েছে । আদিবাসী জনসংখ্যার সঠিক তথ্যের সার্বজনীনতা না থাকায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা এখনও নির্দিষ্ট নয়। জাতীয় বাজেটে আদিবাসীদের বরাদ্দ এর ফলে সঠিক ভাবে প্রতিফলিত হয় না। সরকারি মতে ১৯৯১ সালের আদমশুমারীতে প্রায় ১২ লক্ষ, ২০০১ সালের আদমশুমারীতে ১৪ লক্ষ এবং ২০১১ সালের আদমশুমারীতে ১৫ লক্ষ ৮৬ হাজার আদিবাসী জনগনের বসবাস বাংলাদেশে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের মতে, এ সংখ্যা আরো বেশি হবে।
সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবে আদিবাসীরা উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দে বৈষম্যের শিকার
অনেক ক্ষেত্রে জনসংখ্যার ভিত্তিতে সরকার বাজেট প্রণয়ন করে থাকে। এ যাবত পাঁচবার আদমশুমারি হওয়া সত্ত্বেও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঠিক পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি। আদিবাসী সংখ্যার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় সঠিকভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাজেট প্রণয়ন ব্যাহত হচ্ছে। জাতীয় বাজেটে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দের চিত্র দেখলে বুঝা যায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী অনেক ক্ষেত্রে নাগরিক সুযোগ সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাজেট ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় সমতা এবং আদিবাসীদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা গেলেই আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব হবে।
প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের আকার বাড়ছে। বিগত ২০০৯-১০ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট সমূহে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে আদিবাসীদের জন্য উন্নয়ন বরাদ্দ রাখা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের উন্নয়ন বরাদ্দ এবং তা বাস্তবায়ন করে থাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু বরাদ্দকৃত এই অর্থ শুধুমাত্র পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এই অঞ্চলে বসবাসকারী সেটেলার বাঙালি ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর উন্নয়ন খাতেও খরচ হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রনালয়ের বরাদ্দকৃত এই অর্থ। দেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ সমতলের আদিবাসীরা যে বাজেট বরাদ্দে বৈষম্যের শিকার তা নিম্নের চিত্র গুলো হতে স্পষ্ট প্রতীয়মান;
পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেটের পরিমাণ (বিগত ৯ বছরে) নিম্নরূপঃ

বিগত বছরের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাজেট সারণীতে পর্যায়ক্রমে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, বাজেট বৃদ্ধির হার কত মন্থর। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ৭৩৫ কোটি টাকা, ২০১৫-২০১৬ সালের অর্থ বছরে ৭৭৯ কোটি টাকা এবং ২০১৬-২০১৭ সালের অর্থবছরে ৮৪০ কোটি অর্থ বাজেট বরাদ্দ ছিল। বিগত ২০১৭-২০১৮ সালে জাতীয় বাজেটের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১১৫০ কোটি টাকা। বাজেটের আকার বাড়ছে প্রতি বছর, যার ব্যয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও খাতওয়ারী হয়ে থাকে। এটি সহজবোধ্য যে, মূল বাজেট হতে আদিবাসীদের উন্নয়নে সরাসরি বরাদ্দ পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ এবং বাস্তবায়নের জন্য ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ রয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ের বাজেট অপ্রতুল। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা আদিবাসী ও বাঙালিদের জন্য উন্নয়নমূলক বরাদ্দ মূলত সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেওয়া হয়। সুতরাং, বরাদ্দকৃত সকল অর্থ শুধু আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্যে ব্যবহৃত হয় না।

সমতলের আদিবাসীদের জন্য সরকারী বরাদ্দঃ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উবাবষড়ঢ়সবহঃ অংংরংঃধহপব ভড়ৎ ঝঢ়বপরধষ অৎবধ (বীপবঢ়ঃ ঈঐঞ) বা “বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত)” শীর্ষক কর্মসূচি সংক্রান্ত তথ্যানুযায়ী উল্লেখকৃত যে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে বাস্তবায়নাধীন “বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত)” শীর্ষক কর্মসূচির কার্যক্রম ১৯৯৬-৯৭ সালে ৫ কোটি অর্থ বরাদ্দ দিয়ে শুরু করা হয়েছে যা চলতি অর্থ বছর পর্যন্ত চলমান আছে। দেশের বিভিন্ন জেলার সমতল ভূমিতে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীভুক্ত জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নই কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য। কর্মসূচিটি শুরু থেকে সম্পূর্ণ সরকারী অর্থে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কর্মসূচির অনুকূলে বিগত ২০০৯-১০ হতে ২০১৭-১৮ বিগত ৯টি অর্থ বছরে মোট ১৫৬.০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এই কর্মসূচীর উদ্দেশ্যে স্বাথ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন আয়বর্ধক কর্মসূচির মাধ্যমে সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন।

সমতলের আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেটের পরিমাণ (বিগত ৯ বছরে) নিম্নরূপঃ

বিগত ৯ বছরের সমতলের আদিবাসীদের জন্যে অর্থাৎ ৬১ টি জেলার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়ন বরাদ্দ মোটেই সঙ্গত নয়। সরকারি পরিসংখ্যানের মতে, হিসাব কষলে বিগত ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ১ জন সমতলের আদিবাসীর জন্য গড়ে বাজেট হয় ১০০ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে তা বেড়েছে ১৫০ টাকায়। জাতীয় বাজেটে গড়ে প্রতি জনের জন্য বরাদ্দ যেখানে ২৫,৬৯১ টাকা সেখানে পিছিয়ে পড়া বঞ্চিত একজন আদিবাসী প্রেষণামূলক বার্ষিক বরাদ্দ ১৫০ টাকায় কতটুকু অগ্রসর হয়ে উন্নয়নের মূল ধারায় আসতে পারবেন তা সত্যিই প্রশ্ন সাপেক্ষ?
একদিকে যেমন অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ আদিবাসী জনসংখ্যা অনুযায়ী খুবই কম আবার অন্যদিকে, প্রতি বছর সবগুলো উপজেলার আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে একসাথে নির্দিষ্ট পরিমাণ এ বরাদ্দ প্রদান করা হয় না। তাই কোনো কোনো উপজেলার আদিবাসীদের এ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। ২০১০-১৬ সালের মধ্যে ৪০০টি প্রকল্পে ৪,৫৬২.২৭ লক্ষ্য টাকা ২৭০ টি উপজেলায় ১,০৬,০৫০ জন উপকারভোগীর মধ্যে বন্টন করা হয়েছে । সমতলের প্রায় ২০ লক্ষাধিক আদিবাসীদের জন্য ১ লাখ উপকারভোগী যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত কম। আবার এর বন্টন প্রক্রিয়ার মধ্যেও রয়েছে নানা জটিলতা। আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দকৃত এই প্রকল্পের মধ্যে পিছিয়ে পড়া দলিত, চা শ্রমিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণকেও বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রকৃত আদিবাসী উপকারভোগী জনগণের সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্ঠনীতে আদিবাসীদের অর্ন্তভূক্তিকরণ

গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার জাতীয় বাজেটে প্রতিফলিত হবে। কিন্ত অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সংবিধানের ১৯ (১) অনুচ্ছেদকে পাশ কাটিয়ে ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’ বাজেট প্রণয়ন করা হয়। যার ফলে আদিবাসী পিছিয়ে পড়া মানুষ বাজেটের খাতভূক্ত বরাদ্দে বরাবরই অবহেলিত থাকেন। সমতলের আদিবাসীদের জন্য বিগত ৩ অর্থ বছরে ১৬০টি উপজেলায় ৪০০টি আয়বর্ধনমূলক প্রকল্পে ৯.৮০ কোটি টাকা খরচ হয়। সমতলের সহজ সরল আদিবাসীরা আমলাতন্ত্রের জটিলতার মধ্যে কতটুকু এই উপকার ভোগ করতে পেরেছে, তা সত্যিই ভাবার বিষয়। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী; ভিজিএফ, ভিজিডি, এফএফই, কাবিখা, কাবিটা ইত্যাদিতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্তি খুবই কম।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় আদিবাসীরা প্রান্তিকতার শীর্ষে অবস্থান করলেও সামাজিক নিরাপত্তা ঝুঁকির রাষ্ট্রীয় সুযোগ ভোগ করতে পারছে না। অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকত তাঁর গবেষণা ‘বাংলাদেশের কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ মধ্যে বলেছেন, ‘প্রান্তিকতার যত মাত্রা জানা আছে তার সবটাই আমাদের দেশের আদিবাসী মানুষের জন্য পূর্নমাত্রায় প্রযোজ্য। আদিবাসী মানুষের জমি ও বন দখলে বিভিন্ন রুপের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বেশ রীতিতে পরিণত হয়েছে। আর এসবে সরকার-রাষ্ট্র কখনও প্রভাবক কখনও নির্বিকার। আদিবাসী মানুষের আর্থিক উন্নয়নের জন্যে তাই প্রয়োজন সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে তাদের অর্ন্তভূক্তিকরণ।

বাংলাদেশ সরকার ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০১৫-১৬ হতে ২০১৯-২০, অনুচ্ছে ১৪; ‘সামাজিক সুরক্ষা, সামাজিক কল্যান ও সামাজিক অর্ন্তভূক্তি’ এর ‘সামাজিকভাবে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সেবা’র আওতায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সামাজিক মূলধারার সামাজিক বৈষ্ঠনীর মূল ধারায় নিয়ে আসতে একটি কার্যকর নালিশ ও অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা’ তৈরি করবেন । ২০১৭-১৮ বাজেটে এই প্রতিশ্রুতির প্রতিফল সরকার ঘটবে এটা আদিবাসী জনগণের আশা।

বাজেট বরাদ্দে সরকারের নীতি ও চুক্তির বাস্তব প্রতিফলন প্রয়োজন

পঞ্চবার্ষিক (৫ম ও ৬ষ্ঠ) পরিকল্পনায় সরকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়নের কর্মসূচী প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কথা উল্লেখ করলেও জাতীয় বাজেটে তার প্রতিফলন হয়নি। সরকার ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অনুচ্ছেদ ১৪ মধ্যে, নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠীর জন্যে কৌশল’ প্রণয়নে জাতিসংঘ ঘোষণা, পার্বত্য শান্তিচুক্তি, ভূমি অধিকার, নৃতাত্বিক জনগণের ক্ষমতায়ন, শিক্ষা-ভাষা-সংস্কৃতিতে অভিগম্যতা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিবে এ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছে। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য প্রণীত এ সমস্ত নীতি-চুক্তি প্রতিফলিত হবে যদি বাজেটে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ পর্যাপ্ত থাকে। উপরন্তু আদিবাসীদের মধ্যে নিরঙ্কুশ দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে ৬৫ শতাংশ ও ৪৪ শতাংশ। চরম দারিদ্র আদিবাসীদের কাজ খুঁজে পাবার সামর্থ্যও তাই কম, যা তাদের অবস্থাকে আরও করুণ করে তোলো। প্রস্তাবিত বাজেটে তাই আদিবাসী জনগণের জন্যে রাষ্ট্রের এবং সরকারের প্রতিশ্রুতি ও চুক্তিগুলোর আঙ্গিকে বাজেট প্রণয়ন করা উচিত।
বাংলাদেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কিত বেশকিছু রাষ্ট্রীয় নীতি বা আইন যেমন- পূর্ব বঙ্গীয় প্রজাসত্ব আইন- ১৯৫০, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০ ইত্যাদি রয়েছে। এ নীতিসমূহের প্রকৃত বাস্তবায়নের জন্য এ বাজেটে অপ্রতুল।

নির্বাচনী অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন জরুরি প্রয়োজন

‘আদিবাসী মানুষ-পাহাড়-সমতল নির্বিশেষে নিরন্তর বঞ্চিত। পার্বত্য হোক আর সমতল হোক-আদিবাসী মানুষের মানুষ হিসাবে উন্নয়নের কোন মানদন্ডেই ভাল নেই। জমি-জলা-জঙ্গল-এ আদিবাসী মানুষের মালিকানা বা অভিগম্যতা নেই (সামাজিক, প্রথাগত, ঐতিহ্যগত, গোষ্ঠীগত, ব্যক্তিগত)- এ মানদন্ডে আদিবাসী মানুষের হয়েছে আধোগতি। আর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থানীয় উদ্যেগ, স্থানীয়-শাসন-কোন কিছুতেই তাদের এখন মূল ধারায় অর্ন্তভূক্ত করা যায়নি। ১৯৯৭ সালে (০২ ডিসেম্বর) ‘শান্তিচুক্তি’ খ্যাত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার প্রায় ২০ বছর পরেও এখনও পর্যন্ত পার্বত্য আদিবাসী মানুষের মধ্যে বঞ্চণা-বৈষম্য হ্রাসকারী জনকল্যানকারী কোন স্থায়ী উন্নয়নের সুলক্ষণ প্রতিভাত হয়নি।’ আর্থিক বাজেটের মধ্যেও সরকারের প্রতিশ্রুতি শুধু প্রতিশ্রুতি হিসেবেই আছে।
আওয়ামীলীগ ৯ম জাতীয় সংসদ (২০০৮) নির্বাচনী ইশতেহারের ১৮.১ দফায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গেলে ‘আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকার সনাতনি অধিকারের সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশন গঠন করবে।’ ১৮.২ দফায় প্রতিশ্রুতি দেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।’ ৯ম সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর ১০ম সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন জোট পুনরায় সরকার গঠন করলেও এখনো সেসব প্রতিশ্রুতি শুধু কাগজে কলমেই রয়ে গেছে। দিন বদলের সনদে ১০ম জাতীয় সংসদ (২০১৪) নির্বাচনী ইশতেহারে ১৮.১ ও ১৮.২ সামান্য পরিবর্তত হয়ে ২২.১ ও ২২.২ হিসেবে ইশতেহার হিসেবেই থেকে যায়। দিন যায় আদিবাসীদের জন্য শুভ দিনের উদয় হয়না।

মন্ত্রণালয় ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিতকরণ

বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। মোট জনসংখ্যার মধ্যে আদিবাসীদের সংখ্যা ৩০ লক্ষাধিক। সে অনুযায়ী বলা যায়, আদিবাসী জনসংখ্যা এদেশের সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় ২%। সে হিসেবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৪ লক্ষ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেটে তাদের জন্য ৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশী বরাদ্দ হওয়ার কথা ছিল। এটি জনসংখ্যা অনুযায়ী অংকের হিসাব। যেহেতু আদিবাসীরা নানাকারণে শোষণ, বৈষম্য ও মানবসৃষ্ট দরিদ্র ও বঞ্চনার শিকার, তাই বরাদ্দ শতকরা হিসাবের বাইরে আরো বেশি হওয়া উচিত। কিন্তু প্রকৃত বাজেট বরাদ্দ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ে (যেখানে আদিবাসীদের জন্য একটি অংশ বরাদ্দ থাকে) ১১৫০ কোটি টাকা আর সমতলে মাত্র ৩০ কোটি টাকা। এ বাজেটে সমতলের একজন আদিবাসীর ভাগে পড়ে মাত্র ১৫০ টাকা।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন মূখ্য সচিবের অধীনে সংশ্লিষ্ট উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে উন্নয়ন মূলক প্রকল্পের অর্থ বন্টন করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে এবং উপজেলার বিভিন্ন সরকারী কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয় কয়েকজন আদিবাসী প্রতিনিধিসহ একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে এ অর্থ বন্টনের কাজ করা হয়। সমতলের আদিবাসী জনগণ এখনও ভালোভাবে এ অর্থ বরাদ্দের সুষ্ঠু বন্টন প্রক্রিয়ার সর্ম্পকে অবগত নয়। আবার কোনো কোনো জায়গায় এ অর্থ বন্টনে স্বচ্ছতা নিয়েও নানান প্রশ্ন ওঠেছে। অর্থ বন্টনের এই বিষয়টিতে স্বভাবতই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে তাই প্রশ্ন থেকেই যায়। সমতলের আদিবাসীদের বরাদ্দকৃত অথের্র সুষ্ঠ ব্যবহার এবং আদিবাসীদের উন্নয়নের মূল প্রকৃতভাবে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন তাই সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয়।

জাতীয় বাজেটে অধিকার সুনিশ্চিতকরণের প্রস্তাবনাসমূহ

আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনে উন্নয়নের বিকাশ ঘটাতে হলে প্রয়োজন জাতীয় বাজেটে আদিবাসীদের বরাদ্দ বৃদ্ধি। তখন খুব সহজে তারা দেশের মূল স্রোতের জনগণের সহিত সামনে অগ্রসর হবার সুযোগ পাবে এবং ক্রমান্বয়ে অনগ্রসরতা কাটিয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। বাংলাদেশে পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর, অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত-নির্যাতিত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য নিম্নে বর্ণিত খাতসমূহে বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন;
* আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য খাতভিত্তিক ও মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে;
* সকল মন্ত্রণালয়ের/বিভাগের বাজেটে আদিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা যায় এবং বরাদ্দের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে আদিবাসীদের কীভাবে সম্পৃত্ত করা যায়, সে বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে।
* জাতীয় বাজেটে আদিবাসী বাজেট পৃথক অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা নিরুপণ এবং বাজেট বরাদ্দে সংখ্যার ভিত্তিতে বাজেট বৃদ্ধি করা;
* পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদসমূহের বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর যথাযথ বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা শক্তিশালী করা;
* বাজেট বরাদ্দ সাধারণত হয় মন্ত্রণালয় ভিত্তিক। সমতলের আদিবাসীদের বিষয়টি দেখার জন্য যেহেতু কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ নেই, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই থোক বরাদ্দ পরিচালনার জন্য সমতলের আদিবাসীদের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি বা বোর্ড গঠন করা যেতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসীর বাস সমতলে। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয়ের দাবি অনেক দিনের। মন্ত্রণালয় হলে তার মাধ্যমেই বাজেট বরাদ্দ হবে;
* আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক একাডেমী গুলোতে আদিবাসী সংস্কৃতি উন্নয়নে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু নাচ-গান নয়, গবেষণার দিকে মনযোগী হতে হবে এবং এ খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক একাডেমী গুলোতে আদিবাসী সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা;
* সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও সামাজিক ক্ষমতায়নের বাজেট খাতে আদিবাসী উপকারভোগী যাতে নিশ্চিত হয়, তার জন্য এ বিষয়ে নির্দেশনা থাকতে হবে। উচ্চ শিক্ষা ও কারিগরী শিক্ষায় বৃত্তিসহ আদিবাসী নারী ও তরুণদের আত্ম-কর্ম সংস্থানের জন্য বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে।
————————-
*জাতীয় বাজেটে আদিবাসীদের জন্য ‘সুনির্দিষ্ট ও পর্যাপ্ত বরাদ্দ চাই’ এই বিষয়ক এক জন-বাজেট সংসদ ও প্রাক-বাজেট নাগরিক সভায় পঠিত মুল প্রবন্ধ।

সোহেল হাজং ও খোকন সুইটেন মুর্মু
কাপেং ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা

Back to top button