জনকন্ঠে গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে মিথ্যাচারঃ বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটময় সময়
(১)
আমাদের এই অভাগা দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট যে কত তীব্র সেই অভিজ্ঞতা আমাদের সকলেরই কম বেশী আছে। সংকটটা দুই রকমের। প্রথমত পড়াশুনা করা লোকের বড়ই অভাব। দ্বিতীয় সংকটটি হচ্ছে সততার সংকট। কোন কিছু না জানা কোন অপরাধ না। আমরা সবাই কোন না কোন বিষয়ে অজ্ঞ। আমি নিজের কথা বলতে পারি- পৃথিবীতে হাজারটা বিষয় আছে যেগুলি সম্পর্কে আমার ন্যুনতম কোন ধারনা নাই। সব বিষয়ে না জানাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনার নিজের যে ক্ষেত্রটি, সেটিতে তো আপনার জানাশুনা থাকতে হবে। এবং যেই বিষয়ে আপনি একটা পাবলিক ডিসকাশনে অংশ নিতে চান, সেটা তো একটু জেনে নিতে হবে আরকি।
সততার সংকটটি অজ্ঞতার চেয়ে বড় সংকট। কেননা একজন মানুষ যদি অসৎ হয়, তাহলে সে নিজে অজ্ঞতা স্বীকার করেইনা উল্টো বিজ্ঞের ভান ধরে এবং জীবনের পদে পদে অসততার আশ্রয় নেয়। এরা বড়ই ভয়ংকর।
এইরকম এক অসৎ মূর্খের কথা জানতে পারলাম। তরুণ বন্ধু দীপন খবরটা দিয়েছিলেন। দৈনিক জনকণ্ঠে নাকি একটি প্রতিবেদনে গৌতম বুদ্ধকে সন্ত্রাসী দেবতা হিসাবে দেখানো হয়েছে। এর আগে আরেক তরুণ রিচি এই বিষয়ে আমাকে জানিয়েছিলেন। প্রথমে সেরকম গুরুত্ব দিইনি। কারণ ভেবেছিলাম- দুর, কি লিখতে কি লিখেছে আর ওরাই বা কি পড়তে কি পড়েছে কি জানি। বুদ্ধকে কেন কেউ সন্ত্রাসী বলবে। আর খবরের কাগজের রিপোর্টাররা বা যারা সেখানে লেখেন এদের তো একটা ন্যুনতম জ্ঞান বুদ্ধি আছে আরকি। এরা হয়তো একটু বেশীই রিএক্ট করছে। গুরুত্ব দিইনি।
দীপন পরে কাগজের লিঙ্কটা দিয়েছেন। রিচিও পাঠিয়েছেন প্রতিবেদনের লিঙ্কটি। দেখা যাচ্ছে রাঙ্গামাটি থেকে ফিরোজ মান্নান নামে জনকণ্ঠের প্রতিবেদক লিখেছেন ‘পার্বত্য এলাকায় নতুন অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টায় ভাবনা কেন্দ্র’ শিরোনামে রিপোর্টটি। রিপোর্টে এই ভদ্রলোক জানাচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় নাকি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা স্থানীয় আদিবাসীদেরকে অস্ত্র চালানো শিক্ষা দিচ্ছেন আর এদের সাথে নাকি বার্মার সন্ত্রাসী গ্রুপগুলির যোগসূত্র আছে ইত্যাদি।
(২)
এই খবরের সত্যতা কতটুকু আছে সেটা একটা প্রশ্ন। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর নাকের ডগায় বৌদ্ধবিহারগুলিতে এইসব কর্মকাণ্ড চলবে এটা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়না। তবু এটা তথ্য প্রমাণের ব্যাপার। ফিরোজ মান্নান এই খবর কোন সূত্র থেকে পেয়েছেন তিনিই জানেন। সাংবাদিককে তো আর আপনি সূত্র প্রকাশ করতে বলতে পারেন না।
ফিরোজ মান্নানের অসততা এবং মূর্খতা প্রকাশ হয়েছে গৌতম বুদ্ধ প্রসঙ্গে ওঁর মন্তব্যে। বৌদ্ধ ধর্মের তিনটি মুল স্তম্ভ বা ইংরেজিতে যাকে বলে থ্রি জুয়েলস অফ বুদ্ধিজম, সেগুলির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি গৌতম বলছেন “৯ দ্বারা তাদের দেবতা সন্ত্রাসী গৌতম বুদ্ধের গুণ, ৬ দ্বারা সন্ত্রাসী গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা, ৯ দ্বারা বুদ্ধিষ্ট সংঘ এর গুণ বুঝিয়েছে । ইহা নাকি বুদ্ধের ত্রিরত্ন।” এই কথাটির সূত্র হিসাবে তিনি ব্যাবহার করেছেন ৯৬৯ আন্দোলন প্রসঙ্গে উইকিপিডিয়ার বর্ণনা। প্রথমেই বলে নিই, উইকিপিডিয়া থেকে তথ্য ফিরোজ মান্নান নিয়েছেন সেটা বাংলা করার সময় তিনি অসততা করেছেন। উইকিপিডিয়ায় বুদ্ধকে বা বুদ্ধ প্রসঙ্গে সন্ত্রাসী বিশেষন ব্যাবহার করা হয়নি। এটা তিনি উদ্দেশ্যমুলকভাবে যোগ করেছেন। অসততা।
আর মূর্খতা? প্রথম মূর্খতা তো হচ্ছে তিনটি স্তম্ভ বর্ণনায়। এই থ্রি জুয়েলস কিন্তু খুব অভিনব বা অজানা কিছু না। আমাদের দেশের বেশীরভাগ শিক্ষিত লোকই জানেন এই তিনটি কথা- বুদ্ধ, সঙ্ঘ ও ধম্ম। আপনিও শুনেছেন কথাগুলি- বুদ্ধং শরনং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরনং গচ্ছামি ও ধম্মং শরনং গচ্ছামি। বাংলা করলে হয়- বুদ্ধের শরণ নিচ্ছি, সংঘের শরণ নিচ্ছি এবং ধর্মের শরণ নিচ্ছি। এর মধ্যে সন্ত্রাস কোথায়? রাঙ্গামাটি থেকে রিপোর্ট করছেন একজন রিপোর্টার আর তিনি এই তিনটি কথা জানবেন না, রিপোর্টার সাহেব নিতান্ত মূর্খ প্রকৃতির না হলে তো এরকম হওয়ার কথা না। আরে, রাস্তার পাশে একটা লোককে জিজ্ঞাসা করে নিলেই হতো।
আর গৌতম বুদ্ধকে ‘দেবতা সন্ত্রাসী গৌতম বুদ্ধ’ বা ‘সন্ত্রাসী গৌতম বুদ্ধ’ বলা যে একটি চরম মূর্খতা সে কি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বুঝাতে হবে? প্রথমত যে অর্থে দেবতা শব্দটি ব্যাবহার করা হয়ে থাকে তথাগত বুদ্ধ সেই অর্থে দেবতা নন। আর সন্ত্রাসী? গৌতম বুদ্ধ সন্ত্রাসী? রিয়ালি? গৌতম বুদ্ধকে কেউ সন্ত্রাসী বললে ওর খুলির ভিতরে মগজের অনুপস্থিতি নিয়ে আর কোন সংশয় থাকে? যে তরুণটি মানুষের জরা ব্যাধি কষ্ট দেখে গৃহত্যাগ করে আলোকপ্রাপ্ত হয়ে মানুষের কাছে মুক্তির পথ নিয়ে হাজির হয়েছিল সেই সিদ্ধার্থকে বলে কিনা সন্ত্রাসী?
(৩)
দেখেন, কোন ধর্ম সম্পর্কে আপনার মতামত প্রকাশ করবেন সে অধিকার তো আপনার আছেই। আপনি বৌদ্ধ ধর্মকে ভ্রান্ত বলতে পারেন। ইসলাম ধর্মকে মন্দ বলতে পারেন। সনাতন ধর্মকে ফালতু বলতে পারেন। সে আপনার মতামত। কিছু কিছু ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যুদ্ধও করেছেন। রাম যুদ্ধ করেছেন, সেই অর্থে যদি আপনি তাঁকে সন্ত্রাসী দেখাতে চান, সে আপনার মতামত, বলতে পারেন। প্রফেট মুহম্মদ অনেক যুদ্ধ করেছেন, তাঁকে যদি কেউ সন্ত্রাসী বলেন, সেও বুঝতে পারি, যে সেটা আপনার একটা মতামত। কিন্তু যীশু খৃস্ট বা গৌতম বুদ্ধ?
ভাইরে, সামান্য পড়াশুনা থাকলেও আপনি জানতেন যে গৌতম বুদ্ধ কোন যুদ্ধ করেননি, কাউকে মারেননি, কাউকে আঘাত করেননি, বা কোনপ্রকার কোন সন্ত্রাস বা যুদ্ধ বা হত্যা এইসব অনুমোদনও করেননি। বরং উল্টা, তিনি শুধু মানুষই নয়, সকল প্রাণীর বা সকল স্বত্বার সুখ কামনা করেছেন এবং সকল স্বত্বার মুক্তির পথ নির্দেশ করেছেন। আপনি কোন বিচারে গৌতম বুদ্ধকে সন্ত্রাসী বলবেন? উইকিপিডিয়ার যে সূত্রটি ফিরোজ মান্নান সাহেব ব্যাবহার করেছেন, সেটাতেও তো বুদ্ধকে সন্ত্রাসী বলা হয়নি।
হওয়ার কথাও না। বৌদ্ধ ধর্মের নানাপ্রকার সমালোচনা আছে, সেগুলি এক কথা। কিন্তু কোন পণ্ডিত বা কোন লেখক বা কোন গবেষক কি কোনদিন বলেছেন যে গৌতম বুদ্ধ সন্ত্রাসী? এটা তো কেবল যে মূর্খতা সেটাই তো কেবল নয়, এটা তো অসততা। আর দেখাই যাচ্ছে যে ফিরোজ মান্নান সাব এই প্রতিবেদনটি করেছেন নিতান্তই বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের খেপিয়ে দেওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে। কোন ভাবনা কেন্দ্রে অশান্তির চেষ্টা হয়েছে সেটা ফিরোজ মান্নানই দেখাক আমদেরকে। কিন্তু ফিরোজ মান্নান যে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াতে চাচ্ছেন আর তিনি যে পাহাড়ে সেটেলার মুসলিমদেরকে উষ্মকে দেওয়ার চেষ্টা করছেন সেটা তো স্পষ্টই দৃশ্যমান।
এই লোকটি নিজের কথাটি উকিপিডিয়ার কথা বলে চালিয়ে দিয়েছে। এটা তো মিথ্যাচার। উইকিপিডিয়াকে সূত্র হিসাবে ব্যাবহার করতে পারেন। করেন। কিন্তু সেখানে যেটা লেখা নাই সেটা যদি আপনি উইকির নামে চালিয়ে দেন তাইলে তো আপনাকে পরিষ্কার শব্দে মিথ্যাবাদীই বলতে হয়। এটা মিথ্যাচার ছাড়া আর কি? অসৎ উদ্দেশ্যেই তিনি এই মিথ্যাচারটি করেছেন।
(৪)
জনকণ্ঠ একটা বড় কাগজ। ওদের মতামত আমার সাথে মিলতে নাও পারে, কিন্তু এতো বড় একটা কাগজ এইরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন একটা প্রতিবেদন ছাপবে এটা তো একটা সাধারণ ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না।
ইমতিয়াজ মাহমুদঃ আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী