মতামত ও বিশ্লেষণ

চুক্তির দুই দশক পূর্তি; শাসকশ্রেণির আনন্দ-উল্লাস; বৈপরীত্য বিক্ষুদ্ধ জুম্ম জনতাঃ বাচ্চু চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম জনগণের সাথে শাসকগোষ্ঠীর রঙ্গ-তামাশা, জুম্ম জনগণের উপর বারে বারে আঘাত, রক্তপাত, গুম, হত্যা, লুন্ঠন, সাম্প্রদায়িক হামলা, ঘরবাড়ি জ্বালাও-পোড়াও আর রাষ্ট্রযন্ত্রের অমানবিক আচরণ এসব বাস্তব ঘটনাগুলো দেখে দেখে আমরা পাহাড়ের বুকে বড় হয়েছি। হায়রে পাহাড়ের অসহায় জনগোষ্ঠীর মধ্যকার দালালীপনার দল; কবে বুঝবে তোরা? কবে ছাড়বে সেই ঘর শত্রু বিভিষনের সহজাত প্রবৃত্তি; কবে ছাড়বে সেই বন্ধামী আর গোলামীর মতো ঘৃণিত জীবন? পাহাড়কে ভালবাসার জন্য এক ফোঁটা শিশির বিন্দু কি অন্তরে অঙ্কুরিত করতে পারোনি? এই প্রশ্নগুলো অন্তরের অন্ত:স্থলে ঘুরপাক খেতে-খেতে; বাস্তবতাকে প্রতিদিন-প্রতিমুর্হুতে প্রত্যক্ষ করে করে হ্নদয়ের জমানো পুঞ্জিভুত ক্ষোভ নিজের অন্তরালে পুষে রাখতে বদ্ধ বেশি কষ্ট হয়। পুঞ্জিভুত ক্ষোভ আর যন্ত্রণা যখন মানুষের অন্তরে জমা হয়; তখন উচ্চস্বরে আর শ্লোগাণের গগণবিদারী কন্ঠে ধীক্কার জানাতে রাজপথে নেমে আসে হাজারো জনতার ঢল। হাজারো জুম্ম জনতার অধিকারের মিছিলে আর শ্লোগাণে প্রকম্পিত হয়ে উঠে যখন রাজপথ; তখনি শ্লোগান চলতে থাকে-দালালদের বিরুদ্ধে, প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী ও জুম্মস্বার্থ বিরোধীদের বিরুদ্ধে শ্লোগান উঠে। মনটা তখন কিছুটা হলেও হালকা হয়ে ঘরে ফিরে আসে মানুষ; তবুও বাস্তব সমস্যার আশু যথাযথ সমাধান হয় না, হয়ে উঠে না। পাহাড়ের মানুষের এখন বুঝতে বাকী নেই, দালালদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র প্রতিবাদ করে আর হবে না। তাদের কানে এখন আর প্রতিবাদের ভাষা পৌঁছে না। দালালীপনার চরম পর্যায়ে এখন তারা বধির হয়ে গেছে। এখন জুম্ম জনতাকে প্রতিরোধের ভাষায় জবাব দিতে হবে।

উল্লেখ্য, গত ৩ ডিসেম্বর ২০১৭, প্রকাশিত অনলাইন বার্তায় ফেসবুকে “ছবি প্রসঙ্গ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির প্রেক্ষাপটে বিগত দুই দশকে আ লিক দলগুলোর জাতিসত্তা আন্দোলন” শিরোনামে রাঙ্গামাটির জুম্ম ছাত্রলীগের একজন সদস্য প্রকাশ চাকমার লেখাটা আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। লেখাটা পড়ে আমি সত্যিই অবাক হলাম। দেখলাম চুক্তি দুই দশক উদযাপন আর চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে তার সাধারণ বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নে বেশির ভাগ দোষ চাপালেন আ লিক পরিষদ ও জনসংহতি সমিতিকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি একটা জাতীয় অর্জন পাহাড়ের মানুষ কখনও সেটা অস্বীকার করেনা; চুক্তি জুম্ম জনগণের জাতীয় অর্জন মানে তাদের একমাত্র মুক্তির সনদ বলে আখ্যা দেই কিন্তু আজ চুক্তি বর্ষপূর্তির উদযাপন দুই বৈপরীত্য কেন? হাজারো জুম্ম জনগনের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনও যথাযথ বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে আজ চুক্তির দুই দশক পূর্তি পালনে বৈপরীত্যতা রয়েছে। আ লিক পরিষদ ও জেএসএস এর পক্ষ থেকে বারবার বলার পর এবং দাবী জানানোর পরেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে সরকার দীর্ঘ ২০ বছরেও আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেনি। চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ কি কি জানেন না, নাকি বুঝেন না? জানার পরও অজানার মতন ভান করা; বুঝার পর অবুঝের মতন কথা বলা; বিরোধীতার ক্ষেত্রে বিরোধীতা করা, এটাই তো চুক্তি বিরোধী জুম্ম দালালদের সহজাত প্রবৃত্তি হয়ে গেছে। শিক্ষিত হয়ে অশিক্ষিত লোকের মতো কাজ করা মানেই হলো জুম্ম জাতিকে অধমের চেয়ে বেশি ক্ষতি করার সামিল। চুক্তির দুই দশক অতিক্রান্ত হলেও আ লিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলী হস্তান্তর ও কার্যকরকরণ এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিক প্রণয়ন পূর্বক পার্বত্যবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এসব পরিষদসমূহের নির্বাচন; পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অ লের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ; অপারেশন উত্তরণসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার; ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি পূর্বক জুম্মদের বেহাত হওয়া জায়াগ-জমি ফেরত পাওয়া; প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন; পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও আ লিক পরিষদ আইন তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরীতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ; সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে যথাযথ ও সম্মানজনক পুনর্বাসন ইত্যাদি চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ এখনও অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। এসব মৌলিক বিষয়সমূহ যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে জুম্ম জনগণের জাতীয় অর্জন দিবসে আনন্দ, উদ্দীপনায় চুক্তির দুই দশক পূর্তি পালন করতে জুম্ম জনগন সদা-সর্বদাই অনাগ্রহ দেখিয়েছে। তার বিপরীতে চুক্তির বর্ষপূর্তি উৎযাপিত হয়েছে তীব্র ক্ষোভ আর হতাশার মধ্য দিয়ে। শাসকশ্রেণির উপর ক্ষোভ ও সমালোচনার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই দশক পূর্তি উদযাপন করতে হাজারো জুম্ম নারী-পুরুষের যথাযথ অংশগ্রহণে গণসমাবেশ জাতীয় পর্যায়ে এবং জেলা ও প্রতিটি উপজেলায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জনগোষ্ঠীকে জনসংহতি সমিতি সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। আজ কতিপয় জুম্মদের ভেতর লুকিয়ে থাকা শাসকশ্রেণির গোলামী আর দালালীপনার কারণে দিনদিন পাহাড়ী মানুষের চুক্তির বিশেষ অর্জনকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। সেই লেখার সূত্রধরে বলতে চাই, চুক্তির বিশেষ দিনে আনন্দ-উল্লাসে বর্ষপূতি পালনে শাসকশ্রেণি জুম্ম জনগনকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি; কিন্তু পার্বত্যা লে সাজসজ্জা আর আতজবাজি ফুটিয়ে আনন্দ-উল্লাসে শাসকশ্রেণির দুই দশক পূর্তিতে দুর্নীতিবাজ, গুজখোর আর জুম্ম দালালদের নিঃসন্দেহে সম্পৃক্ত করতে পেরেছে। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে এতই দালালচক্র বৃদ্ধি পেয়েছে যার দরুণ উদাহারণে পরিনত হয়েছে যে; দালালদের কোন জাত-পাত নেই! দালালী করাই তাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেকারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের কাছে প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী ও চুক্তিবিরোধী দালালদের সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
পার্বত্য মন্ত্রণালয় চুক্তির ফলে সৃষ্ট একটা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু পার্বত্য মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের বিষয়ে আপনার লেখায় উল্লেখ রয়েছে। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানগণ কিভাবে নির্বাচিত হয়েছে জানেন না? চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী কল্পরজ্ঞন চাকমা প্রথমে নিজেই তিনি চুক্তি লংগন করেছেন। কিভাবে; চুক্তির (খ) খন্ডের ৪নং ধারার (৫) উপ-ধারা মোতাবেক সার্কেল চীফ কর্তৃক স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের বিধান পার্বত্য জেলা পরিষদের আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও কেবলমাত্র তিন সার্কেল চীফ কর্তৃক স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের ব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে না। চুক্তিকে লংগন করে তিন সার্কেল চীফের পাশাপাশি তিন পার্বত্য জেলা ডেপুটি কমিশনারগণও পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদান করতে পারবেন বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে বিগত ২১ ডিসেম্বর ২০০০ সালে জারীকৃত এক প্রশাসনিক আদেশের পর ডেপুটি কমিশনার কর্তৃকও স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদান করা হচ্ছে; যা চুক্তি পরিপন্থী অথবা বিধিসম্মত নহে। এরপর পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের একজন পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে উপজাতীয় থেকে নিয়োগ দিতে হবে চুক্তিতে বলা হলেও কখনও উপমন্ত্রী আবার কখনও প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সরকার প্রতি পদে পদে চুক্তি লংগন করে চলেছেন। চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দার নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন দিতে হবে বলা হলেও দলীয় লোকদের পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য নিয়োগ দিয়ে অগনতান্ত্রিভাবে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোকে পরিচালনা করা হচ্ছে। অপরদিকে চুক্তিতে অন্তবর্তীকালীন জেলা পরিষদের সদস্য সংখ্যা হবে ৫ জন বলা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আ লিক পরিষদকে উপেক্ষা করে সরকার গত ২৩ নভেম্বর ২০১৪ সালে অন্তবর্তী তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আকার চেয়ারম্যানসহ ৫ সদস্য থেকে ১৫ সদস্যে বাড়িয়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন ২০১৪ বিল জাতীয় সংসদে পাশ করে নিয়েছে যা চুক্তির স্পর্শ লংগন। আরও শুনবেন কি সরকারের চুক্তি পরিপন্থী ও লংগনের অসংখ্য ফিরিস্তী। আপনার লেখায় উল্লেখ করেছেন, আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদমর্যাদা প্রতিমন্ত্রী হলেও দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যর্থতা আ লিক পরিষদের পিঠের ঘাঁড়ে চাপানোর চেষ্টা করেছেন বারবার। অথচ ২০ বছরের মাতায় এখনও পর্যন্ত আঞ্চলিক পরিষদকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল প্রকার উন্নয়ন, সাধারণ প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধনের প্রকৃত ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি। তাই আ লিক পরিষদ এখনও পর্যন্ত দাঁড় নেই-তলোয়ার নেই, নিধিরাম সদ্দার।

আরও যে বিষয়টা আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে; সরকার আর জেএসএস এর মধ্যকার আস্থা ও বিশ্বাসের সুসম্পর্কের কারণে ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। হ্যাঁ, সেটা পাহাড়ের মানুষ অস্বীকার করবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৎ ইচ্ছা থাকার কারণে দীর্ঘ সংলাপের পর উভয় দল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের চুড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়। দীর্ঘ দুই দশক ধরে পাহাড়ের অধিকারহারা মানুষ ধৈর্য্য ধরেছে-অপেক্ষা করেছে; কিন্তু জুম্ম জনগন আজ সরকারের প্রতি আস্থা-বিশ্বাস হারাতে বসেছে। জুম্ম জনগণের বিশ্বাসের উপর বারবার আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে, যার ক্ষত সহজেই শুকাবে না। একটা পশ্চাদপদ জাতির জাতীয় জীবন থেকে দীর্ঘ ২০ বছর কোন অর্জন ছাড়া হারিয়ে যাওয়া সহজ কথা নয়। সেজন্য আজ জুম্ম জনগন সফলতার পাল্লা হতে ব্যর্থতার পাল্লাটাকে ভারী করে দেখে হিসাব কষতে শুরু করে দিয়েছে। পাহাড়ের মানুষ সংঘাত চায় না, যুদ্ধ চায় না, রক্তপাত চায় না; পাহাড়ের মানুষ শান্তি চায়। কিন্তু শাসকশ্রেণির আচরণ জুম্ম জনগনকে সংঘাত, যুদ্ধ আর রক্তপাত অবস্থার দিকে নিয়ে যেতে বাধ্য করছে। উন্নয়নের কথা উল্লেখ করেছেন; মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও ভিডিও কনফারেন্সে চুক্তির দুই যুগ পূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগনকে উন্নয়নের ঘুম পাড়ানির গান শুনিয়েছেন। পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, রাস্তাঘাট, শিক্ষা সবক্ষেত্রে মনে হয় যেন উন্নয়নের বন্যায় মহাসড়কে ভেসে যাচ্ছে। আমার প্রশ্ন হলো, উন্নয়ন আগে নাকি অধিকার বা অস্তিত্ব রক্ষা করা আগে? কোনটা আগে জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ! নিঃসন্দেহে সাদাসিধে ভাষায় উত্তর হবে অস্তিত্ব রক্ষা করা আগেই গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড়ের বুকে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত নাহলে উন্নয়ন স্থায়ীত্ব লাভ করতে পারেনা। তাহলে চুক্তি বাস্তবায়নের মিথ্যার বলি আওড়ানো আর উন্নয়নের মিথ্যার বেসাতি করে জুম্ম জনগনকে আর কতবার ধোকা দেবেন। আওয়ামীলীগের নৌকা আর জুম্ম জনগনকে বারেবারে দিয়েছে ধোকা; পাহাড়ের মানুষ এখন আর বোকা নয়। একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিগত অগ্রগতির যুগে আমরা পাহাড়ের মানুষ আর পেছনে থাকতে চায় না। আমরাও পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে চায়; The survival of the fittest.. যোগ্যরাই পৃথিবীতে টিকে থাকে। দুনিয়ার পরিস্থিতি ও বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে না পেরে পৃথিবী থেকে অনেক জাতি হারিয়ে গেছে। জুম্ম জনগন যোগ্যতার সহিত সংগ্রাম করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায়।

চুক্তির আগে হোক আর চুক্তির পরবর্তী সময়ে হোক পার্বত্য চট্টগ্রামে দলীয় অন্তকোন্দল ও দ্বন্ধ-সংঘাতের কথা উল্লেখ করেছেন; জনসংহতি সমিতির আদর্শিক নেতৃত্ব বরাবরই এসব হীন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বদাই অগ্রভাগে থেকেই সচেতনভাবে মোকাবেলা করে এসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে জনসংহতি সমিতির নামে যে রাজনৈতিক সংগঠন আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের লক্ষে যে যাত্রা শুরু করেছিল; সেটাকে বানচাল করতে শাসকশ্রেণি সেই সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দিয়ে হীন রাজনৈতিক কাজ চালিয়ে এসেছে। জন্মলগ্ন হতে আজও পর্যন্ত এদেশের শাসকশ্রেণি ভাগ করো-শাসন করো নীতির ভিত্তিতে জনসংহতি সমিতিকে আঘাতের পর আঘাত করার চেষ্টা করেছে; চিরতরে নির্মূল করার ঘৃণ্য রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির চর্চা ঢুকিয়ে দিতে সর্বদাই ষড়যন্ত্র চালিয়েছে। পার্টির অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা কতিপয় সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল ও বিভেদপন্থীদের দিয়ে জনসংহতি সমিতিকে এভাবে আঘাত করতে চেয়েছিল। ভ্রাতৃঘাটি সংঘাতের কথা উল্লেখ করেছেন; তার মানেই আপনি জনসংহতি সমিতির আন্দোলনের বিষয়ে ওয়াকিবহাল নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দলগুলোদের মধ্যকার দ্বন্ধকে পুঁজি করে সরকার নিজের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বারবার। সেখানে আপনাদের মতো তরুণ কতিপয় জুম্ম ছাত্র নিজের স্বার্থকে চরিতার্থ করতে শাসকশ্রেণির দলে লেজুরবৃত্তি করতে গা কাঁপে না। এভাবে জাতির স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে আজ স্বজাতিকে ভুলে গিয়ে, নিজের সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে, নিজস্বকে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে গলাটিপে হত্যা করতে হস্ত কাঁপে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের সামগ্রিক স্বাতন্ত্র্যতাকে সম্পন্নভাবে পায়ের তলে রেখে দেয়; ব্যক্তিস্বার্থ সেখানে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়-এটাই দালালদের স্বভাব। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে আজ সংঘাত, খুন, গুম, অপহরন, চাঁদাবাজি, সাম্প্রদায়িক হামলা ও স্বশস্ত্র সংঘাতের দিকে জুম্মদের ঠেলে দেওয়া; এগুলোর জন্মদাতা কে জানেন? কেমনেবা মনে থাকবে গোলামী আর দালালীপনা; ব্যক্তিস্বার্থ আর লেজুরবৃত্তি করতে করতে জীবনটাই অন্ধকারময় হয়ে পড়ে আছে। নিজের বন্ধামী আর হীন রাজনৈতিক কার্যকলাপ অপরের পিঠের উপর চাপিয়ে দেওয়ায় স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যতে পরিনত হয়েছে। অন্যায় করতে করতে, অন্যায় করাটাই দালালদের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে; যার কারণে জুম্ম জাতির পিতাকে নিয়ে অপলাপ করতে গায়ের লোম কাড়া হয় না। জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র আশা-আকাংখার প্রতীক। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে জুম্ম জনগণের কন্ঠরোধ-বাকস্বাধীনতা খর্ব করা আর জিম্মি করে রাখার যে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কারা কায়েম করছে? যুগ যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়ন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রাজত্বকালে ঔপনিবেশিক নিপীড়ন ও শোষণ, পাকিস্তান শাসনামলে মৌলবাদ ও সম্প্রসারণবাদের শোষণ ও ষড়যন্ত্র এবং বাংলাদেশের সময়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ, মৌলবাদ ও সম্প্রসারণবাদের প্রতারণা, নিপীড়ন ও শোষণে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগন সর্বস্বহারা, ক্ষতবিক্ষত ও বিলুপ্তপ্রায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের এহেন পরিস্থিতি ও বাস্তবতা কখনও উপলদ্ধি করেছেন কি? আজ ব্যক্তি স্বার্থের কারণে জুম্ম জাতীয় অস্তিত্বকে চিরতরে বিলিন করে দিতে শাসকশ্রেণির গুনগান আর মিথ্যাচার করেই চলেছেন। যার নুন খেয়ে চলেছেন, তার গুন গাওয়া তো বন্ধামী আর গোলামীদের সাজে।

সবশেষ কথা; ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা তরুণ ছাত্র-যুব সমাজ জুম্ম জাতির আগামী দিনের কান্ডারী ভূমিকায় অবত্তীর্ন হবে। জুম্ম জাতির সেই সোনালীর ভবিষ্যৎ গড়বে যারা; আদর্শিক চেতনায় নিজেকে গড়ে তুলতে যারা অক্লান্ত শ্রম ও মেধা ব্যয় করে ইস্পাত কঠিন আন্দোলনে সামিল হতে চায়; তাদেরকে নিয়ে যে মিথ্যাচার করা সেটা শিক্ষিত লোকের কাজ নয় বরং অধমেরই কাজ। একদিকে সরকার নিজেই চুক্তি বাস্তবায়নে স্ববিরোধী আচরণ করে চলেছে; কিন্তু জনসংহতি সমিতির উপর সেই দায়ভার চাপানো মিথ্যার বেসাতি ছাড়া কিছুই হতে পারেনা। জুম্ম জনগনকে জনসংহতি সমিতি নিজেদের স্বার্থেই নাকি রাজপথে ব্যবহার করে থাকে-একথাগুলো আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়, সত্যের অপলাপ ছাড়া কিছুই নয়। জুম্ম জনগন রাজপথে চলে আসতে বাধ্য হয়; কারণ তাদের অধিকার আদায় করতে, তাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই রাজপথে নেমে আসে। শাসকশ্রেণির হীন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে; জুম্ম জাতির দালালচক্রদের নির্মূলের জন্য রাজপথে সচেতনভাবে চলে আসে; অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামিল হয়। নির্বাচনে দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে জয়ী করার জন্য জনসংহতি সমিতি মিথ্যাচার করেনা; মানুষকে জিম্মি করে না; বরং শাসকশ্রেণির দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করার জন্য ফ্যাসিবাদী কায়দায়-পেশি শক্তির জোরে; ভোট ডাকাতি, ব্যালট বক্স চুরি, অনিয়মের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়; মিথ্যাচার করে জনগনকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগের নৌকা এখন বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে; কর্ণফুলী নদীর গভীর জলে ডুবে গেছে। ভেঙে ছাড়কার হয়ে সাগরের গভীরে পড়ে আসে, যেখানে মাছ, ঝিনুক, বেঙ্গাসিরা বাসা বেঁধেছে। সেই ডুবন্ত নৌকাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ মেরামত করতে জানেনা, মেরামত করতে সমতল অ লের মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের নৌকায় চড়তে অভ্যস্ত নয়; পার্বত্যাঞ্চল অরণ্যে ভরপুর, এখানে হাতিরাই বসবাস করে-এ অঞ্চল হাতি চাষের জন্য উর্ভর জায়গা। পাহাড়ের মানুষ হাতির পিঠে চড়তে অভ্যস্ত এবং নিজেদেরকে হাতির পিঠে চড়তে অত্যন্ত রাজকীয় মনে করে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আন্দালন, সংগ্রাম লোক দেখানো নয়; পার্টির সংগ্রাম করছে নিপীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত জুম্ম জাতি ও মানুষের মুক্তির জন্য, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। পার্বত্য চট্টগ্রামে একদিকে আনন্দ-উল্লাস, গান-বাজনায় আর আতজবাজি ফুটিয়ে সরকারের চুক্তির দুই দশক পূর্তি পালিত হয়েছে; অপরদিকে সরকারের প্রতি সমালোচনা, তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা এবং প্রতিরোধের ভাষায় জেএসএস এর নেতৃত্বে হাজারো বিক্ষুদ্ধ জুম্ম জনতা গণসমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের মধ্য দিয়ে উদযাপন করেছে ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির দুই দশক পূর্তি। এটায় হলো এবারের চুক্তির দুই দশক পূর্তির বৈপরীত্য।

বাচ্চু চাকমাঃ সাবেক সভাপতি; কেন্দ্রীয় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ

Back to top button