মতামত ও বিশ্লেষণ

চলেশ রিছিল: রাষ্ট্রের বিচারহীন সংস্কৃতির প্রতীক -উন্নয়ন ডি. শিরা

স্বাধীনতা-প্রসবিনী প্রকৃতির এই অগ্নিঝরা মার্চে
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মর্মবাণীকে পু্নর্বার প্রশ্নবিদ্ধ ক’রে
মধুপুর ছেড়ে মৃত্যুবিষপুরে চলে গেলেন চলেশ। (নির্মলেন্দু গুণ, চলেশ রিছিলের জন্য এলিজি)
———–
চলেশ রিছিলের চলে যাওয়ার এগারো বছর হতে চলেছে। তবে আপনারা যাঁরা বলেন চলেশ চলে গিয়েছে আমরা আদিবাসীরা বলি চলেশ চলে যায়নি, চলেশ আমাদের মাঝেই আছে। আমাদের মগজে মননে চিন্তায় চেতনায়। তাঁকে অসময়ে ক্ষমতার জোরে জোর করে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আসছে ১৮ই মার্চ চলেশ রিছিল হত্যা দিবস। ২০০৭ সালের মধুপুরের ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা চলেশ রিছিল কে যৌথবাহিনী নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করে। স্বাধীন দেশের হন্তকদের হত্যাযজ্ঞ পাকিস্তানি জান্তাদের বর্বরতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ঘটনার দিন, চলেশ রিছিল ময়মনসিংহের একটি বিয়ের অনুষ্ঠান হতে ভাড়া করা প্রাইভেটকার যোগে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে মুক্তাগাছা থানার কালীবাড়ি বাজার বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালে প্রাইভেটকারটিকে থামিয়ে যৌথবাহিনীর সদস্যরা রিছিলসহ সহযাত্রী প্রতাপ জাম্বিল,পীরেন সিমসাং ও তুহিন হাদিমাকে আটক করে। এদের মধ্যে পীরেন সিমসাং ও তুহিন হাদিমা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও প্রতাপ জাম্বিল ও চলেশ রিছিল কে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে চালানো হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন। জানা যায়, চলেশ রিছিল কে জানালার গ্রীলে ঝুলিয়ে ৯ জন প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য অমানবিকভাবে টর্চার করে। তার ডান হাতের তিন আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়। তাঁর সারা শরীরে প্রচন্ড আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। রাতে তার রক্তাক্ত জখমে জর্জরিত মৃতদেহ থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফেলে রাখা হয়। ঘটনার পর পুলিশ একটি গল্প বানিয়ে বলে, দৌড়ানোর সময় পড়ে গিয়ে চলেশ জ্ঞান হারায়। এ বানানো গল্প কেউ বিশ্বাস করেনি ( প্রথম আলো,২২শে মার্চ ২০০৭)। অন্যদিকে চলেশের মৃত্যুর কারণ ‘হার্ট অ্যাটাক’ বলে দাবি করেছিল যৌথবাহিনী। এমন অসংলগ্ন বক্তব্য ছিল পুলিশ যৌথবাহিনীর।

জাতিসংঘ, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ হত্যাকান্ড নিয়ে রিপোর্ট করেছে। তিনটি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এন্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) যৌথভাবে অনুসন্ধান করে। অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁরা জানিয়েছিলেন, “চলেশ রিছিলের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ও রক্তের দাগ ছিলো। দুই হাতের হাঁড় ও সব আঙ্গুল ভাঙা ছিলো। হাত পায়ের বেশ কয়েকটি নখ ওপরানো ছিলো।” দেশীয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত ঘটনার তালিকার টপ টেনে জায়গা নিয়েছিল ‘চলেশ হত্যাকান্ড’। নিঃসন্দেহে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শেষ সীমা অতিক্রম করার জলজ্যান্ত উদাহরন এটি।
———–
বিচারহীনতার ১০ বছর

সে সময় চলেশ রিছিল হত্যার বিচারের দাবিতে মধুপুরের সব শ্রেনী পেশার মানুষ রাজপথে ঐক্য গড়ে তুলেছিল। শহীদের লাশ বয়ে মিছিল বেড়িয়েছিল। এ বছর(২০১৮) চলেশ রিছিল হত্যার এগারো বছর পূর্ণ হতে চলল। কিন্তু বিচার এখনো হল না। এমন কি বিচারের প্রক্রিয়াও এগোয়নি। সামনের দিন গুলোতেও সুষ্ঠু বিচার পাওয়া যাবে কিনা, যথেষ্ঠ সংশয় সন্দেহ দেখা দিয়েছে। প্রশাসনের এরূপ ভূমিকাকে রাজার হাতির মতোই তুলনা করা চলে। হাতিকে পুষতে হয়,খাওয়াতে হয় অথচ হাতি জনসাধারনের কোন কাজে আসে না। এদিকে পুত্র হত্যার বিচার দেখে যেতে চেয়েছিলেন চলেশের বাবা বনেন্দ্র দালবৎ (দৈনিক সমকাল,১৫ই মার্চ ২০০৮), দেখে যেতে পারলেন না। আজ বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে শালবনে কাঁদে। কান থাকা সত্ত্বেও সে কান্না কেউ শুনতে পায় না। পায় কি? আদিবাসী অ-আদিবাসীদের সম্মিলিত গণআন্দোলনের তোপে মৃত্যুর বিষয়টি তদন্তের জন্য ২০০৭ সালের ৫ মে অবসরপ্রাপ্ত জেলা দায়রা জজ রফিক উদ্দিনের নেতৃত্বে এক সদস্য বিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। তদন্ত কমিটির দাবির প্রেক্ষিতে সে বছর জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে চলেশের লাশ উত্তোলন করে পুনরায় ময়না তদন্ত করা হয়। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ঘটনার ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। কিন্তুু আজো অপ্রকাশিত রয়ে গেছে সেই তদন্তের প্রতিবেদন।
————-
প্রতিশ্রুতি রাখেনি মন্ত্রীরা

ঘরোয়াভাবে হলেও চলেশ রিছিল হত্যা দিবস তাঁর নিজ গ্রাম মাগন্তিনগরে প্রতি বছরেই পালিত হচ্ছে। আদিবাসী অ-আদিবাসী সকলে মিলে এ দিবস গভীর তাৎপর্যের সাথে পালন করে। জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রিয় নেতার কবরে ফুল দিয়ে সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৮ মার্চ স্থানীয় আওয়ামীলীগ চলেশের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ সভার আয়োজন করে। মধুপুরের সাংসদ তৎকালীন খাদ্য মন্ত্রী মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী সে সভায় গিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন এ হত্যার বিচারের ব্যবস্থা করবেন। মামলাটি পুলিশ যাতে তালিকাভুক্ত করে বিচারের উদ্যোগ নেয় সে ব্যাপারে নির্দেশ দেবেন। আজ প্রতিশ্রুতি দেওয়ার দীর্ঘ ৮ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। তাদের প্রতিশ্রুত সেসব কথার বাস্তব কোন বাস্তবায়ন কিঞ্চিৎ পরিমানেও দেখা যাচ্ছে কি?
—————-

রাষ্ট্র হয়তো কাল আপনাকে আমাকেই বানিয়ে দিতে পারে চলেশ কিংবা কল্পনা চাকমা!

আদিবাসীদের নানা অমীমাংসীত অধ্যায়ের মধ্যে চলেশ রিছিল একটি নাম। অমীমাংসীত নামের তালিকা অনেক লম্বা। ক্রমেই এই নামের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। কল্পনা চাকমা থেকে শুরু করে লেবিনা হাউই, আলফ্রেড সরেন, পীরেন স্নাল, গিদিতা রেমা, সুজাতা চাকমা, শ্যামল হেমব্রম, রমেল চাকমা…। যেভাবে যে হারে নামের তালিকায় নতুন নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে এখান থেকে আমরাও যে নিজেকে বিযুক্ত বা বিমুক্ত রাখতে পারব তার কোন নিশ্চয়তা রাষ্ট্র দিচ্ছে না বা দিতে অক্ষম। বরং তার বিপরীতে রাষ্ট্র হয়তো কাল আপনাকে আমাকেই বানিয়ে দিতে পারে চলেশ কিংবা কল্পনা চাকমা!

———–
উন্নয়ন ডি. শিরা শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Back to top button