মতামত ও বিশ্লেষণ

গোয়েবলসের থিওরি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম – পলাশ চাকমা জুম্মো

(১)
১৯৩০ সালের ইউরোপ, জার্মানে তখন এডলফ হিটলারের উত্থান হয়ে গেছে। তার নেতৃত্বে নাত্সী পার্টি তখন ক্ষমতায়। ধীরে ধীরে জার্মান বহির্বিশ্বে প্রভাব খাটাতে শুরু করেছে। ঠিক এমন সময়ে ১৯৩৩ সালে প্রচার মন্ত্রী হিসেবে হিটলারের মন্ত্রীসভায় যোগ দেন যোসেফ গোয়েবলস। এই প্রোপাগান্ডা মন্ত্রীর দায়িত্ব ছিল দুইটা; এক. দেশের ভেতরে হিটলারের কট্টর নাৎসীবাদ প্রতিষ্ঠা করা এবং দুই. দেশের বাইরে এই নাৎসীবাদকে খুব মহান আদর্শের মোড়কে মুড়িয়ে তা প্রচার করা। দুইটাই দায়িত্ব তিনি খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। দেশের ভেতর নাৎসীবাদের প্রচার করতে গিয়ে তিনি যে কৌশল অবলম্বন করেছিলেন সেটা তাকে এতটাই (কু)খ্যাতি এনে দিয়েছিল যে হিটলার কে, জার্মানি কোথায়, এসব না জানলেও প্রোপাগান্ডা চালানোর সময় এখন সবাই গুরু মানে গোয়েবলসকে।
তিনি হলেন একজন সত্য হন্তারক। সত্যকে হত্যা করার বিগ লাই থিওরি বা প্রোপাগান্ডা থিওরির উদ্ভাবক। যার সারমর্ম হচ্ছে একটা মিথ্যাকে যদি বার বার ব্যাপকভাবে সরকারি সকল প্রশাসন যন্ত্রকে বা এককথায় মিডিয়া উইং দিয়ে প্রচার করা হয় তখন সেটি সত্যর মত শোনায় এবং মানুষ আর আসল সত্যকে খুঁজে পায় না। সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়া অথবা সত্যর সাথে মিথ্যাকে কিংবা মিথ্যার সাথে সত্যকে মিশ্রিত করে ফেলে সত্যকে আর সত্য না রাখা। এই থিওরিতে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী, কবি, সাংবাদিকরা টাকার বিনিময়ে হিটলারের পক্ষে প্রচার চালাতেন। তারপরও প্রচার যেন জমছিল না। গোয়েবলস সস্তায় রেডিও বানিয়ে বিক্রি করলেন। তার একটাই চ্যানেল আর সেখানে চলে হিটলারের গুণগান । পত্রিকা, সাহিত্য, কবিতা অর্থাৎ সমস্ত প্রচারযন্ত্রে একই রকম প্রচারের ফলে হিটলার জার্মানে মহামানব হয়ে উঠলেন। গোয়েবলস বলতেন- মিথ্যা যখন বলবে বড় মিথ্যায় বলবে। সত্যকে বদলে দেওয়ার এমন নজির ইতিহাসে খুব কমই আছে। এই থিওরিটা বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর কতটা জনপ্রিয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
(২)
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সেনাবাহিনীর গোয়েবলসীয় অপপ্রচারের ইতিহাস অনেক পুরোনো। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা ও সঠিক ইতিহাসকে না জেনে একতরফা, খন্ডিত, বিকৃত, সাজানো ও কল্পিত মনগড়া তথ্য পরিবেশন ও প্রচার করা সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের অনেক বুদ্ধিজীবী ও প্রথম শ্রেণির গণমাধ্যম কেউই বিরত থাকেননি। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনের আগে স্বনামধন্য লেখক হুমায়ুন আজাদ “সবুজ পাহাড়ের বুকে হিংসার ঝর্ণাধারা” বইয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সে সময়ে চলমান সংঘাতের বিষয়ে একতরফা তথ্য পরিবেশন করেছিলেন। চুক্তির আগে পাহাড়ে সেনা নেতৃত্বে সেটেলার দ্বারা সংঘটিত ১৩টি গণহত্যা ও পাহাড়ে সেনাবাহিনীর নিয়মিত মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে কথা না বলে তিনি উল্টো সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন। “পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নেতৃত্ব পার্বত্য চট্টগ্রামকে লুকিয়ে রাখতে চান, তারা আসলে ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে আগ্রহী” হুমায়ুন আজাদের মত প্রগতিশীল (?) লেখকের এমন কুরুচিপূর্ণ অপপ্রচারে পাহাড়ের জনগণ বিস্মিত হয়েছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনের পর জল অনেক দুর গড়িয়ে গেছে, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চুক্তি নিয়ে অপপ্রচারও একই জায়গায় থেমে থাকেনি। সেই অপপ্রচারের গতি আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক মেজরের ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে অনলাইন মিডিয়া সরগরম হয়ে ওঠে। তিনি তার পোস্টে জুম্মদেরকে রীতিমতো খাপ্পা-উপজাতি সম্বোধন করে যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন সরকারের একটা আদেশ পেলেই উপজাতিদের “অ্যানিহিলেট” করতে একমাসও সময় লাগবে না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেই মেজর রেজাউর রহমান নামের ফেসবুক আইডিটি পরে আর ফেসবুকে দেখা যায়নি। না বুঝার কোন কারণ নেই এসব কিছু কার সৃষ্টি! সুতরাং এ ধরনের বক্তব্যর দায় কে নেবে??
২৯ জুলাই ২০১৫ দৈনিক পুর্বকোণ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, নয়াদিগন্ত, ইত্তেফাক এবং পার্বত্য নিউজ এর অনলাইন সংস্করণে “সম্ভাবনার পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়নের স্বপ্ন ও বাস্তবতা” শীর্ষক শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। লেখাটি লিখেছেন গুইমারা রিজিয়নের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল আহমেদ পিএসসি। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসকে নিয়ে সত্য-মিথ্যাকে মিশিয়ে এমন একটি বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন যা পড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন এমন যে কোনো মানুষের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জন্মাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসকে বিকৃতকরণ, বাঙালিরাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে ঢালাওভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী এবং রাজাকার হিসেবে আখ্যায়িতকরণ, পাহাড়ে ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর ধরে চলা ইন্সার্জেন্সির সময়ে নিহতের সংখ্যা দিয়ে জগাখিচুড়ি তথ্য উপস্থাপন, পাহাড়ে চলমান চাঁদাবাজির বিষয়ে একতরফা আলোচনা, রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্যুকে এলাকার মানুষকে পশ্চাদপদ করে রাখার চেষ্টা ইত্যাদি মিথ্যা, বিতর্কিত, উস্কানিমূলক ও সাম্প্রদায়িক তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন যা পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে জলপাইওয়ালাদের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব ও নিকৃষ্ট মনমানসিকতাকে পরিস্কার করে তোলে।
(৩)
২০১৫ সালে স্বঘোষিত নারীবাদী লেখিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা রোকেয়া লিটা “ডুমুরের ফুল” নামক উপন্যাস লেখে অখ্যাত থেকে কুখ্যাত হয়েছিলেন এবং এখনো তার ফেসবুক আইডিতে সাম্প্রদায়িক ও পাহাড়ি-বিদ্বেষী লেখা দেখা যায়। দুই মাস মাস বান্দরবানের হোটেল লবিতে অবস্থান করে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা রীতি-নীতি-প্রথাকে না জেনে, না বুঝে পাহাড়ি জনপদের সমাজব্যবস্থাকে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন। এই স্বল্প সময়ে বান্দরবানের একটি কোণায় অবস্থান করে পাহাড়ে হাজার বছর ধরে পাহাড়িদের লালন-পালন করা রীতি-নীতি-প্রথা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে কি উপন্যাস লিখবেন এবং সে উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় কি হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়!!
“সিএইচটি কমিশন গো হোম, ইউ আর ড্রাঙ্ক” শিরোনামে পাহাড়২৪.কম এবং মানবজমিন পত্রিকায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে রীতিমতো মিথ্যাচার করেছিলেন সাংবাদিক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট নাজমুল আহসান। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতিকারী সেটেলারদের “বাঙালি” হিসেবে অভিহিত করে পুরো বাঙালি জাতিকে একাত্ম করার মাধ্যমে সারাদেশের বাঙালিদের কাছ থেকে কৃত্রিমভাবে স্যামপ্যাথি আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন। সেটেলার উপর ২টি গণহত্যা কোথায় সংঘটিত হয়েছিল সেটা আমাদের জানা নেই। তিনি সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে পাহাড়িদের উপর সংঘটিত ১৩টি গণহত্যা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন তথাকথিত ২টি গণহত্যার বিপরীতে।
সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করতে শাসকগোষ্ঠী নতুনভাবে মাঠে নেমেছে। সেনাবাহিনী ও শাসকগোষ্ঠী গোয়েবলসীয় কায়দায় অপপ্রচারের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও সংস্থা, সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন গোষ্ঠী, ভাড়াটে সাংবাদিক, অনলাইন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি সিন্ডিকেট সৃষ্টির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে ভিত্তিহীন ইতিহাস রচনা করে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার পায়তারা চালিয়ে যাচ্ছে। যার প্রথম ধাপ হিসেবে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালে এসে ইনকিলাব, মানবজমিন, কালেরকন্ঠ, জনকন্ঠ ইত্যাদি জাতীয় দৈনিক সহ অনলাইন পত্রিকা দ্বারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধারাবাহিক অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নসহ অধিকার আদায়ের ন্যায্য আন্দোলনে জুম্ম ছাত্র সমাজের অংশগ্রহণকে বিতর্কিত করার লক্ষ্যে ১ মে ২০১৭ তারিখে “পার্বত্য এলাকার নিখোঁজ তরুণরা গভীর জঙ্গলে” শীর্ষক শিরোনামে দৈনিক মানবজমিন ও গত ৩০ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে “পাহাড়ে শিক্ষার্থীরা তিন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মানবঢাল” শীর্ষক শিরোনামে দৈনিক ইত্তেফাক একটি সংবাদ পরিবেশন করে। যদিও এই ধরনের উড়ো খবর তারা কোথা হতে সংগ্রহ করেছেন তার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ দিতে পারেননি।
দেশে সমসাময়িক সময়ে কয়েকজন ছাত্র জঙ্গীগোষ্ঠী আইএসে যোগ দেয়ার ধারণাকে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে প্রয়োগের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন মাত্র। বস্তুতপক্ষে জুম্ম জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ছাত্র সমাজের অগ্রগামী নেতৃত্ব দেখে এবং সাম্প্রতিক সময়ে সেনাবাহিনীর নির্যাতনে এইচএসসি পরীক্ষার্থী রমেল চাকমা হত্যার ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য এই ধরনের মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল। এই আন্দোলননে ছাত্র সমাজকে বিতর্কিত করার লক্ষ্যে ছাত্র সমাজকে টার্গেট করে শাসকগোষ্ঠী অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। জুম্ম ছাত্র সমাজ জুম্ম জনগণের অগ্রগামী সৈনিক। তাই জুম্ম ছাত্রসমাজকে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য প্রশাসন হেরোইন, ইয়াবা, গাজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য চোরাচালানকারী চক্রকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
আমরা ভুলে যাইনি খাগড়াছড়িতে আমরা পিসিপি কর্মীরাই প্রথম হেরোইন ও ড্রাগের ব্যবসা শুরু করে পাহাড়ের তরুণ প্রজন্মকে পঙ্গু বানানোর প্রক্রিয়া প্রতিরোধ করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। এখনও পাহাড়ে বিভিন্ন উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কোম্পানী কর্তৃক তামাকের চাষ হচ্ছে। যেগুলো প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে রয়েছে। এই একই কারণে বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি শহরে মাদকদ্রব্য চোরাচালানের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তার সাথে ছাত্র নেতৃত্বকে ধ্বংসের লক্ষ্যে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের শত শত নেতাকর্মীদের ওপর গণহারে মামলা দায়ের ও জেলজুলুম চালিয়ে যাচ্ছে।
(৪)
বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে ডুলুছড়ি মৌজায় রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ, কোয়ান্টাম কোম্পানী কর্তৃক এবং ফ্যাসাখালী ইউনিয়নের ত্রিশডেবায় মুহাম্মদীয়া জামিয়া শরীফ ওরফে লাদেন গ্রুপ এই তিনটি কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক চার হাজার একর জমি বেদখল সরেজমিনে পরিদর্শন করতে গেলে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্যসহ নাগরিক প্রতিনিধিদলকে গত ৬ মে ২০১৭ তারিখে লামার ইয়াংসায় সেনাবাহিনী কর্তৃক বাধা দেয়া হয়। এই ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য bdlive.com নামক অনলাইন নিউজ পেপারে “লামায় জেএসএস ও ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে অবরোধ” শীর্ষক শিরোনামে একটি মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ প্রচার করা হয়। যেখানে এসব কর্পোরেট কোম্পানীগুলোর ভুমি বেদখলের কারণে ম্রো, মারমা ও ত্রিপুরারা প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ হচ্ছে তারাই নাকি আবার প্রতিনিধিদলের বিরুদ্ধে অবরোধ ডাকবে? বিষয়টা হাস্যকর। সত্যটা হচ্ছে এই যে, সেদিন পার্শবর্তী এলাকার কয়েকজন ম্রো যুবকদের ধরে এনে জোরপূর্বক রাস্তায় দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়।
গত ৪ মে ২০১৭ তারিখে দৈনিক যুগান্তরে “পাহাড়ে শান্তি বিনষ্ট করলে ম্রোরা রুখে দাঁড়াবে” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত ম্রোদের সংবাদ সম্মেলনে জেএসএসকে হুমকি প্রদানের বিষয়টাও এখান থেকে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঠিক একই কায়দায় মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমুলকভাবে ২৯৯ পার্বত্য রাঙ্গামাটি আসনের সংসদ সদস্য ও জেএসএসের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি শ্রী উষাতন তালুকদারের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা তথা জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব সম্পর্কে জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ৪ মে ২০১৭ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠ, bdnews24.com, chttimes.com সহ বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে “পার্বত্য রাজনীতিতে নতুন চমক, নৌকায় উঠলেন উষাতন” ও “তের জন সংসদ সদস্যর সাথে উষাতনের আওয়ামী লীগে যোগদান” ইত্যাদি শিরোনামে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করা হয় ।
জুম্মদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আচার আচার অনুষ্ঠান পালনে বাধা সৃষ্টি করার জন্য বিজু, সাংগ্রাই ও বিভিন্ন পুজা অনুষ্ঠানের জন্য জনগণের স্বেচ্ছায় দেয়া এককালীন অর্থকেও আজকে চাঁদাবাজি হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। যার সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্র হিসেবে ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখ দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় “পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠনে চাঁদাবাজির রাজত্ব” ও ১ জানুয়ারী ২০১৭ দৈনিক জনকণ্ঠে “প্রতিদিনই পার্বত্য অঞ্চল থেকে সশস্ত্র উপজাতি প্রুপগুলো এক থেকে দেড় কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে” বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এসব পত্রিকাগুলো ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, যুবলীগ, বাঙালি ছাত্র পরিষদের মত সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজি নামক সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকার কথা তুলে ধরে না। গত কয়েক মাস আগে বাঙালি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চাঁদাবাজির অপরাধে খাগড়াছড়িতে গ্রেফতার হন এবং সেটেলাররা এর প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে একদিন সড়ক অবরোধের ডাক দেয়। ১৪ জানুয়ারি টেন্ডার পাওয়ার জন্য রাঙ্গামাটির লংগদুতে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মারামারি, ২০১৪ সালে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পের ২৫ লাখ টাকার টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষ এবং ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে বিশেষ বরাদ্দের ৯ কোটি টাকা দীপঙ্কর তালুকদারের ডানহাত জাহাঙ্গীর কর্তৃক আত্মসাতের অভিযোগে পাহাড়ের মানুষ ভুলে যায়নি। এছাড়া সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় শত কোটি টাকার বাঁশ-গাছ পাচারের অভিযোগ রয়েছে, যেগুলোকে চাঁদাবাজির হিসেবে আখ্যায়িত না করে ডাকাতি হিসেবে আখ্যায়িত করা উচিত।
(৫)
পার্বত্য চট্টগ্রাম কে নিয়ে গোয়েন্ডা সংস্থা,সেনাবাহিনী ও প্রশাসন গভীর ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারে নেমেছে। তাই জুম্ম জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে তারা সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজি হিসেবে অপপ্রচার,পৃথক জুমল্যান্ড-পৃথক পতাকা,মুদ্রা ও স্বায়ত্তশাসিত সরকার সম্পর্কে অপপ্রচার,অস্ত্র ও অস্ত্রভান্ডার সম্পর্কে অপপ্রচার,পার্বত্য চুক্তি নিয়ে অপপ্রচার,পার্বত্য ভুমি কমিশন সম্পর্কে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি কে অস্থিতিশীল করে তুলছে।
বৃহৎ বাঙালি জনগোষ্ঠীরকে ভুলে গেলে চলবে না যে, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশ ছিল আফ্রিকা। ইউরোপীয়রা যুদ্ধপীড়িত অবস্থার সৃষ্টি করিয়ে আফ্রিকাকে শোষণ করেছে। গত ৫০০ বছর ধরে আমরা আফ্রিকাকে সেভাবেই দেখছি ইউরোপীয়রা যেভাবে দেখিয়েছে। যদিও গোয়েবলসের থিওরির অনেক বছর নীরবে কাজ করে যায় কিন্তু সত্যও এত বড় বদমাশ নয়। কিছুদিন পরে হলেও সত্য কবর থেকে উঠে এসে দাঁত খেলিয়ে হাসে। ইতিহাস বড় নির্মম তাই একসময় কাজ করলেও সময়ে সেটা আর কাজ করে না। এই জিনিষটা সেনাবাহিনী, ভাড়াটে হলুদ সাংবাদিকরা, শাসকশ্রেণির কায়েমী গোষ্ঠীর যতই দ্রুত বুঝতেন ততই দেশের সামগ্রিক মঙ্গল হবে বৈকি।

লেখক: ছাত্র ও সমাজকর্মী

Back to top button