গারোদের অবিসংবাদিত নেতা ‘গারো রাজা’ পরেশ চন্দ্র মৃ’র ১৯তম মৃত্যু বার্ষিকী
গারোদের অবিসংবাদিত নেতা গারো রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ’র আজ ১৯ তম মৃত্যু বার্ষিকী । ১৯৯৮ খ্রীষ্টাব্দের এই দিনে তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আবিমার(মধুপুর) আদিবাসীদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে অগ্রনী সৈনিক ছিলেন পরেশ চন্দ্র মৃ।
মধুপুর গড় তথা বৃহত্তর ময়মনসিহের গারো কোচ প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষায় অগ্রনী নেতা ও সমাজ সেবক পরেশ চন্দ্র মৃ’র জন্ম ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার চুনিয়া গ্রামে । তার পিতার নাম রয়চান নকরেক এবং মাতার নাম টেংয়া মৃ ।
১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দে ভূটিয়া ব্যাপ্টিস্ট মিশনারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা আরম্ভ করেন । এর পর পীরগাছায় কিছুদিন লেখা পড়া করে মধুপুর রানী ভবানী হাইস্কুলে ভর্তি হন । দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে কলকাতা গিয়ে নারিকেলডাঙ্গা হাই স্কুলে ১০ শ্রেণীতে ভর্তি হন । ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন । ক্যাপ্টেন উইলিয়াম সাংমার সাথে বৈঠক করে মেঘালয়ের সংলগ্ন (শ্রীরর্দী, ঝিনাইগাতী, হালুয়াঘাট,দুর্গাপুর,কলমাকান্দা) উপজেলাগুলো নিয়ে আচিক আবিং দাবির আন্দোলনে প্রতিষ্ঠিত ‘আচিক সংঘ’র যুব বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন । ১৯৫২ খ্রী: ১৭ মার্চ খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন । সেইসময় আদিবাসীদের বসতবাড়িসহ অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন ।
৫২ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে জমিদার প্রথা বাতিল হলে গারোসহ আদিবাসীদের জুমচাষ বন্ধ হয়ে যায় । এতে জীবিকার উপর প্রচন্ড চাপ পড়ে । বন বিভাগ লট করে বনজ সম্পদ বিক্রি করে আদিবাসীদের সত্বঃদখলীয় জমিতে বন সৃজন শুরু করে ১৯৫৫ সালে বন বিভাগ ১৯১৪-১৯ সিএস রেকর্ড বাদে বনের সমস্ত পত্তনি জমি খাস ঘোষনা করে । ৬১ সালে ৪০ বর্গমাইল এলাকা ন্যাশনাল পার্ক করে স্থানীয়দের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করে । উচ্ছেদ এর প্রতিবাদ এবং অস্তিত্ব রক্ষা ও অধিকার আদায়ের জন্য ১৯৬২ সালের ২ মার্চ আবিমার ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ’ গঠন করেন । একই বছর ফা: জে ইয়াং এর সাথে জয়েনশাহী সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি (বর্তমানে আবিমা কো-অপারেটিভ ক্রে: ইউ.লি.) গঠনে সহায়তা করেন । বিভিন্ন সময়ে দাঙ্গা, অন্যায়-অত্যাচারে আদিবাসীরা যখন দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন তখন পরেশ চন্দ্র মৃ আদিবাসীদের বিভিন্ন ভাবে রক্ষা ও সহায়তা করেছেন । ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধাদের আশ্রয় এবং খাদ্য , অর্থ দিয়ে সহযোগীতা করেন । এলাকাবাসীর সহায়তায় ১৯৭২ সালে পীরগাছা সেন্ট পৌল হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন । ১৯৭৮ সালে ন্যাশনাল পার্কের নামে আদিবাসী অধ্যুসিত গ্রামগুলি কাটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করে উচ্ছেদ নোটিশ দিলে জোড়ালো প্রতিবাদ করেন তিনি ও তার সংগঠন ।
পরেশ চন্দ্র মৃ বলতেন “ আমরা কোথায় যাব? মরতে হয় এখানেই মরবো, আমাদের বাপ-দাদারা এখানেই মরেছে, সংগ্রাম আন্দোলন করেই থাকতে হবে, বন ছাড়া আমরা বাচঁতে পারবোনা । বন আমাদের নিত্য সঙ্গী, বনেই আমাদের জন্ম, বনেই বেড়েছি, মরতে হয় বনেই মরবো ।”
১৯৭০ সালে গণতন্ত্র নির্বাচনের পর ডিসেম্বরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমান এবং ড:কামাল হোসেন দোখলা রেস্টহাউজে বিশ্রামের ছলে বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য আসেন । সেসময় তারা পরেশ চন্দ্র মৃ’র বাড়ীতে বেড়াতে যান । সেখানে আদিবাসীদের সুখ দু:খ নিয়ে আলোচনায় পরেশ বাবুর নেতৃত্বের বিচক্ষতা, কৌশল এবং সফলতা দেখে, আবিমার আদিবাসীদের জন্য তার অবদানের জন্য তাকে মধুপুরের “গারো রাজা” বলে সম্ভোধন করেন বঙ্গবন্ধু । বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সম্ভোধনেই তাকে পরবর্তীতে আবিমানি গারো রাজা বলে ডাকা হয় ।
পারিবারিক জীবনে ১৯৫৬ সালে নলুয়াকুড়ি গ্রামের বঙ্কু চিসিম ও কুমুদিনী দারুর কন্যা সিসিলিয়া দারুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ।
কৃতজ্ঞতাঃ আচিকনিউজ