গাইবান্ধার সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম : ভূমি সংকট ও সংগ্রামঃ পাভেল পার্থ
পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য কেমন দেখেছেন?
‘তহন রাজনীতি কারে কয় বুঝতাম না। বাড়ির পাশেই ছিল মহিমাগঞ্জ সুগার মিল। চিনি আমগো দেশে আমরা উৎপাদন করি, আর আমরাই খাই বেশি দামে, ওরা খায় কম দামে, এইসব শুনতাম। একবার বঙ্গবন্ধু মিটিং করতে আইছিল ইসলামিয়া স্কুলে। সে কইল বহু বৈষম্যের কথা।
তার ভাষণ শুনলেই গায়ের লোম খাড়াইয়া যাইত’।
(মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ চাঁনমিয়া সরদারের ভাষ্য, ১১ নং সেক্টর, গাইবান্ধা)
শব্দসংক্ষেপ: রংপুর (মহিমাগঞ্জ) সুগার মিল, সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম, অধিগ্রহণ, চিনি, ভূমি সংকট, আদিবাসী ও বাঙালি, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, গাইবান্ধা
সারসংক্ষেপ:
গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ৫নং সাপমারা ইউনিয়নের রামপুর, সাপমারা, মাদারপুর, নরংগাবাদ ও চকরাহিমপুর মৌজার ১৮৪২.৩০ একর ভূমি ‘রংপুর (মহিমাগঞ্জ) সুগার মিলের’ জন্য অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নেয় তৎকালিন পূর্ব-পাকিস্তান সরকার। এলাকাটি সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম নামে পরিচিত। অধিগ্রহণের ফলে ১৫টি আদিবাসী গ্রাম ও ৫টি বাঙালি গ্রাম উচ্ছেদ হয়। কথা ছিল অধিগ্রহণের নামে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেয়া এই জমিনে আখ চাষ হবে। আখ ভিন্ন অন্য কোনো ফসল চাষ করা হলে বা চিনিকলের উদ্দেশ্যর সাথে সম্পর্কহীন কোনোকিছু করা হলে কেড়ে নেয়া এসব জমি আবারো ভূমিমালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হবে। অধিগ্রহণের পর বেশ কিছু জমিনে আখ চাষ হয় এবং আখ ব্যবহার করে চিনিও উৎপাদিত হয়। কিন্তু চিনিকল কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ও অব্যস্থাপনার দরুণ ৩১ মার্চ ২০০৪ সালে কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে নানা সময় একবার চালু হয়, আবার বন্ধ হয় এভাবেই চলতে থাকে। চিনিকল কর্তৃপক্ষ নানাভাবে অধিগ্রহণকৃত জমি বহিরাগত প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দিতে শুরু করে। অধিগ্রহণের চুক্তি লংঘন করে কেবলমাত্র আখচাষের জন্য বরাদ্দকৃত জমিতে ধান, গম, সরিষা ও আলু, তামাক ও হাইব্রিড ভূট্টা চাষ শুরু হয়। জন্মমাটি থেকে উদ্বাস্তু আদিবাসী ও বাঙালিরা পুরো ঘটনাটি প্রশাসনের নজরে আনে। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সনের ৩০ মার্চ গাইবান্ধা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম এলাকা সরেজমিন তদন্ত করেন। তদন্তকালে তারা উল্লিখিত জমিতে ধান, তামাক ও মিষ্টিকুমড়ার আবাদ দেখতে পান। কিন্তু গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন ১০ মে ২০১৬ তারিখে উক্ত ভূমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন সরকার বরাবর। বাপ-দাদার জমিনে অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবিতে আদিবাসী-বাঙালি ভূমিহীনদের তৈরি হয়েছে দীর্ঘ আন্দোলন। আন্দোলন দমাতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন ভূমিহীনদের সংগ্রামে হামলা-মামলার বাহাদুরি চালাচ্ছে। আন্দোলনকারীদের উপর নির্বিচার গুলি চালিয়েছে প্রশাসন, গুলিবিদ্ধ ৪জন ও আহত অনেক নারী পুরুষ। কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন আন্দোলনকারী ৫১ জনের নামে ৪টি বানোয়াট মামলা দিয়েছে। গাইবান্ধা জেলে এখনও আটক নিজ ভূমিপ্রত্যাশী ৩ জন। ১৯৬২ থেকে ২০১৬, দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে চিনি উৎপাদনের অজুহাতে রাষ্ট্র সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের ভূমিউদ্বাস্তু হাজারো মানুষের সাথে বর্ণবাদী অন্যায় করে চলেছে। ঘটনাটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান, মানবিকতা ও আইন সবকিছুই লংঘন করে চলেছে। দ্রুত এর সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার জরুরি। চলতি আলাপখানি সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের চলমান ভূমিসংকট ও নিম্নবর্গের ভূমি সংগ্রামকে সামনে রেখে রাষ্ট্রের উপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব ও বিনাশী উন্নয়ন দর্শন বদলের জোর আহবান জানায়। চলতি আলাপখানি তৈরি হয়েছে উল্লিখিত এলাকায় নিবিড় পর্যবেক্ষণ, সাক্ষাৎকার, দলীয় আলোচনা, দীর্ঘ আলোচনা এবং সংশ্লিষ্ট নানা নথি ও দলিল থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে। আদিবাসী ও বাঙালি বর্গদ্বয়কে চলতি আলাপে তাদের সকলের আত্মপরিচয়কে মান্য করেই ‘ভূমিউদ্বাস’’ হিসেবে এক একক বর্গ হিসেবে দেখা হয়েছে। প্রতিবেশতর্ককে মূল না করে, ভূমিপ্রশ্নকে চলতি আলাপে নিম্নবর্গের উৎপাদন সম্পর্ক এবং সামাজিক সংস্কৃতি হিসেবেই পাঠ করা হয়েছে। চিনি উৎপাদনের নামে কোম্পানির লাগাতার অন্যায়কে নয়াউদারবাদী কর্পোরেট এজেন্সির আগ্রাসন এবং রাষ্ট্রের আচরণকে বর্ণবাদী রাজনৈতিকতা হিসেবে দেখছে এই চলতি আলাপ।
বিস্মৃত বাগদা সরেন ও বাগদা ফার্ম
ঐতিহাসিকভাবেই গুড় ও চিনি দেশীয় পণ্য। তাল, খেজুর, গোলপাতা কী আখ থেকে গুড় ও চিনির মত প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্য উদ্ভাবিত হয়েছিল এ অঞ্চলেই। ষোড়শ শতকে বাংলার উন্নতমানের চিনি সুপরিচিত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণে চিনি রপ্তানি করত। ১৭৯৫ সালে এ রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ২০ হাজার মণ এবং ১৮০৫ সনে ৩৩ লাখ ২৪ হাজার মণ। আগে থেকেই গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ আখ অঞ্চল। ব্রিটিশ আমলে ঐতিহ্যবাহী খেড়ি কুশল, সোম কুশল ও গেন্ডারীর আবাদ হত এখানে। সেই আখ গরু দিয়ে মাড়াই করে তৈরি হত চিনি-গুড়। গোবিন্দগঞ্জের ঘোড়াঘাট ও বহমনকুন্ডা পরগণা ছিল আদিবাসী অধ্যুষিত। সাঁওতাল ও পাহাড়িয়া জাতির আধিক্য। ঘোড়াঘাট পরগণার বগদহ মৌজার একজন জমিদার ছিলেন বাগদা সরেন। সাঁওতাল গান-গল্পে উত্তরাঞ্চলে দু’জন রাজার নাম পাওয়া যায়, ঘোড়াঘাটের ‘রাপে রাজ’ নামে পরিচিত এই রাজাই হয়তো বাগদা সরেন। ঘোড়াঘাট পরগণার জমিদার অখিল চন্দ্র চক্রবর্ত্তী বাগদা সরেনের জমিতে বগদহ মৌজায় একটি চিনিকল তৈরি করেন। বাগদা সরেনের নামে এর নাম হয় ‘বাগদা ফার্ম’। ১৯৪০ সনের পর থেকে বাগদা ফার্ম বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। জমির রায়তগণ জমির স্বত্ব লাভ করেন। ১৯৫০ সনে প্রজাস্বত্ত্ব আইনের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্য থেকে শুরু করে দেশের ময়মনসিংহ, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, নোয়াখালী হতে উদ্বাস্তু মানুষেরা এ অঞ্চলে আসতে শুরু করে। তারা বগদহ মৌজা দখল নেয়। বহিরাগত এই অভিবাসীদের সাথে স্থানীয়দের ভূমিদ্বন্দ্বটি ঐতিহাসিক বিধায় এখনও এই অভিবাসীরা স্থানীয়দের কাছে ‘রিফ্যুজি’ নামে পরিচিত। ১৯৫৫ সনে অভিবাসিত ‘রিফ্যুজিরা’ বগদহসহ আশেপাশের মৌজাতে তাদের স্থায়ী স্বত্ত্বের জন্য রাজনৈতিক সম্পর্ক শুরু করে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৬২ সনে এইসব জমি তাদের নামে রেকর্ড করে দেয়। এককালের সাঁওতাল জনপদ বগদহ মৌজা নিমিষেই সাঁওতাল শূণ্য হয়ে যায়। আজ আর এই মৌজায় কোনো সাঁওতাল নেই। এককালের স্বনির্ভর আদিবাসীরা আজ বাঙালির জমিনের অচ্ছুৎ দিনমজুর। বর্ণবাদী পাকিস্তান সরকারের কাছে আদিবাসী ও বাঙালিদের ঐক্য ও এই জনবৈচিত্র্য মেনে নেয়া খুব কঠিন ছিল। আর তাই পুরো এলাকার জাতিগত সম্প্রীতির ইতিহাস চুরমার করে দিতে পাকিস্তান সরকার পরবর্তীতে রংপুর (মহিমাগঞ্জ) সুগারমিলের নামে ১৫টি আদিবাসী ও ৫টি বাঙালি গ্রাম উচ্ছেদ করে দেয়। আসলে এখানে চিনি উৎপাদনই মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল না, এটি একইভাবে জাতিগত বৈচিত্র্যের উপর পাকিস্তানী রাষ্ট্রীয় জাত্যাভিমান।
কারখানা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে আখ খেত!
রংপুর (মহিমাগঞ্জ)চিনিকল গাইবান্ধা জেলার একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান। গোবিন্দগঞ্জের মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের শ্রীপ্রতিপুর মৌজায় এই চিনিকল তৈরি করা হয়। ১৯৫৪ সনে এই চিনিকল নির্মাণ শুরু হয় এবং ১৯৫৭ সনে শেষ হয়। ১৯৫৭-৫৮ সন থেকে এই চিনিকলে উৎপাদন শুরু হয়। চিনিকলটি প্রায় ৩২৬ একর জায়গাতে অবসি’ত এর ভেতর ৭০ একর জায়গা তাদের খরিদকৃত। বিস্ময়করভাবে ১৯৫৪-১৯৫৫ সনে যখন নানাভাবে ‘রিফ্যুজিরা’ এসে আদিবাসী, বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিম রায়তদের জায়গা জমিতে বসতবাড়ি গড়ে তুলছে তখনি পাকিস্তান সরকার ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম’ এলাকাটি চিনিকলের জন্য নিশানা করে। চিনিকল থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ৫নং সাপমারা ইউনিয়নের রামপুর, সাপমারা, মাদারপুর, নারাংগাবাদ ও চকরাহিমপুর মৌজার ১৮৪২.৩০ একর ভূমি ‘রংপুর (মহিমাগঞ্জ) সুগার মিলের’ জন্য অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নেয়া হয়। ১৯৫৬ সালে ‘পাকিস্তান ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’ এর জন্য তৎকালীন সরকার এভাবেই ১৫টি সাঁওতাল ও পাহাড়িয়া আদিবাসী গ্রাম ও ৫টি বাঙালি গ্রাম উচ্ছেদ করে। জন্মমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে অনেকেই নিরুদ্দেশ হয়ে যান এবং অনেকে নাটোর, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও বগুড়ায় চলে যান। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সনে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গঠন করে সরকার। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় দুটি পৃথক হয় এবং ৪টি স্বতন্ত্র শিল্প সংস্থা তৈরি করে, যার একটি হচ্ছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন। এই সংস্থার অধীনে আছে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, শ্যামপুর, জয়পুরহাট, সেতাবগঞ্জ, রংপুর, ফরিদপুর, নর্থবেঙ্গল, কেরু এন্ড কোং (বিডি), পাবনা, রাজশাহী, জিল বাংলা, কুষ্টিয়া ও মোবারকগঞ্জ সুগার মিলস লিমিটেড এই ১৪টি চিনিকল। ১৯৭২ সনেই বাংলাদেশ সরকার এই রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকলকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে।
অন্যায় অধিগ্রহণ, ২০ গ্রামের মূল্য ৮ লাখ ৭ হাজার টাকা!
১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬ সনের ভেতর ২০টি গ্রাম উচ্ছেদ করে ১৮৪২.৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে পাকিস্তান সরকার। অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে জমিমালিকদের ভাষ্য, সরকার জমির কোনো মূল্য দেয়নি। তখন জমিতে সেকল শস্য ফসল ছিল, বসতবাড়ির গাছপালা, কুয়া এবং ঘরবাড়ির একটা মূল্য ধরে দেয়। সেখানে ভূমির কোনো মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। ১৮৪২.৩০ একর জমির অধিগ্রহণ বাবদ মোট ৮ লাখ সাত হাজার ৩১৮ আনা ১০.৬ পয়সা রংপুর জেলা প্রশাসকের কাছে ১৯/৫/১৯৫৫, ২৯/২/১৯৫৬ এবং ৫/১০/১৯৫৬ তারিখে অগ্রীম প্রদান করে ‘পাকিস্তান ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’। অধিগ্রহণপত্রে জমির বৈশিষ্ট্য প্রকার এবং জমিতে কী কী আছে তার কোনো কিছুরই উল্লেখ নেই। এমনকি প্রতিজন জমিমালিকের নামের পাশে কেবলমাত্র হাত বা কারো কারো পায়ের বুড়ো টিপসই নেয়া হয়। তবে কেউ কেউ স্বাক্ষরও করেছেন। বিশটি গ্রামে দলা, ডাঙ্গা ও বাস’ এ তিন ধরণের জমি ছিল। ছিল পুকুর, সাঁওতালদের জাহেরথান ও মাঝিথান নামে ধর্মস্থল, পাহাড়িয়াদের ধর্মস্থল, বাঙালিদের মন্দির, মসজিদ, কবরস্থান ও সমাধি। অধিগ্রহণ অঞ্চলে ‘লায়েক জংগল’ বলে একধরণের গ্রামীণ বনও ছিল। অধিগ্রহণের ফলে অনেকেই উচ্ছেদ হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, তারা কোনো ধরণের মূল্য বা ক্ষতিপূরণ পায়নি। অধিকাংশরাই অধিগ্রহণের জন্য যে মূল্য নির্ধারণ করা হয় তাও পেতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারি ভাষ্যমতে, ১৯৪৮ সনের ‘রিক্যুইজিশন অব প্রপার্টি অ্যাক্ট’ অনুযায়ী এই জমি অধিগ্রহণ করা হয়। তবে জমিহারা ভূমিমালিকরা এই জমিকে তাদের ‘বাপ-দাদার সম্পত্তি’ বলছেন এবং তাদের ভাষ্য অধিগ্রহণের নামে তাদের জমি ‘কেড়ে নেয়া’ হয়েছে।
চুক্তির শর্ত লংঘন
বিস্ময়করভাবে অধিগ্রহণের নামে জমি কেড়ে নেয়ার প্রায় ৬ বছর পর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ‘পাকিস্তান ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’ এবং পূর্ব পাকিস্তান’ সরকারের মধ্যে চুক্তিপত্র হয় ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই। উক্ত চুক্তিপত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘…১৮৪২ক্স৩০ একর সম্পত্তি ইক্ষু ফার্ম করার জন্য লওয়া হইল। উক্ত সম্পত্তিতে ইক্ষু চাষের পরিবর্তে যদি কখনো কি কোন সময় অন্য কোন ফসল উৎপাদিত হয় অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা হইয়াছে সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত না করিয়া অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় এবং তাহা প্রকৃত উদ্দেশ্যে বিপরীত হয় অথবা এই রকম ঘটনা ভবিষ্যতে ঘটিলে এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন অধিগ্রহণকৃত ১৮৪২ক্স৩০ একর সম্পত্তি সরকার বরাবর ফেরত (সারেন্ডার) প্রদান করিবেন। দেশের সরকার বাহাদুর উক্ত সম্পত্তি গ্রহণ করিয়া পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়া (রেসটোরেশন) যাইতে পারিবেন।’
১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের সময় চিনিকল বন্ধ থাকে এবং ভূমিহারা আদিবাসী ও বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সনে কারখানাটি আবার চালু হয়। অধিগ্রহণ চুক্তিতে বলা হয়েছে আখ চাষের কথা, কিন্তু কী জাতের আখ তা বলা হয়নি। দেখা যায় চিনিকল দেশীয় আখ প্রজাতিকে বাদ দিয়ে নতুন আখ চারা দেয় কৃষকদের এবং রাসায়নিক পদ্ধতিতে জমির বৈশিষ্ট্য ক্ষুন্ন করে বাণিজ্যিক আখ আবাদ শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীতে চিনিকল কর্তৃপক্ষের লাগাতার অবহেলার কারণে কারখানা কয়েকবার বন্ধ হয়ে যায়। চিনিকলের জন্য আখ চাষ ও সেই আখ মাড়াই খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রংপুর চিনিকলের জন্য ২০১৪-২০১৫ সনের চাষকৃত আখের ৫৮তম মাড়াই কর্মসূচি উদ্বোধন করেন গাইবান্ধা-৪ গোবিন্দগঞ্জ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ। অধিগ্রহণকৃত জমিনে আখ চাষ হবে এবং চিনিকলটি বেঁচে থাকবে, বাঁচবে কৃষক-শ্রমিক। কিন্তু অধিগ্রহণকৃত জমিনে আখচাষের কোনো সক্রিয় পরিকল্পনা ও উদ্যোগ কখনোই দেখা যায়নি। আখ আবাদ বাদ দিয়ে ধান, গম, সরিষা ও আলু, তামাক ও হাইব্রিড ভূট্টা চাষ শুরু হয়। এমনকি মিল কর্তৃপক্ষ খামারের ভেতর ছয়টি পুকুর খনন করে সেখানকার মাটিও বিক্রি করেছে। চিনিকল কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ও অব্যস্থাপনার দরুণ ৩১ মার্চ ২০০৪ সালে কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। চিনিকল কর্তৃপক্ষ নানাভাবে অধিগ্রহণকৃত জমি প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দিতে শুরু করে। জানা যায় ২০০৫ সনে চিনিকলটি বিক্রির জন্য একটি টেন্ডার নোটিশও হয়েছিল। চিনিকল কর্তৃপক্ষ বারবার অধিগ্রহণ চুক্তি লংঘন করছে এবং রাষ্ট্র এর বৈধতা দিচ্ছে। তাহলে আমরা কী বুঝবো চুক্তিটি পাকিস্তান আমলে হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে এই চুক্তি বাতিল। যদি তাই হয় তবে জমিমালিকরা কেন অন্যায়ভাবে কেড়ে তাদের জমি ফেরত পাবেন না? প্রশ্নটি মৌলিক এবং অবশ্যই রাজনৈতিক। রাষ্ট্রকে এই রাজনৈতিকতা সামাল দিয়ে দাঁড়াতে হবে।
নামে চিনিকল, কিন্তু কামে না
চিনি উৎপাদনের জন্য মিল কর্তৃপক্ষ কী রাষ্ট্র কখনোই আন্তরিক ছিল না। তাই বারবার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কারখানা। ২০০৪ সনে বন্ধের পর ২০০৬ সনের ১৬ জুলাই মিলটি পুনরায় চালু করার নির্দেশ দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। ২০০৭-২০০৮ মওসুমে ৩৩ দিন চালু থাকে এবং ৫,৩২৫ টন চিনি উৎপাদিত হয়। ২০১৩-২০১৪ মওসুমে ৫,২৬৮ এবং ২০১৪-২০১৫ মওসুমে ২,৪৪০ টন চিনি উৎপাদিত হয়। বছরে ১৫ থেকে ৪৫ দিন কারখানা চালু থাকে। ২০১২-২০১৩ মৌসুমের ৫৬ তম আখ মাড়াই কার্যক্রম উদ্বোধনের পর মাত্র ১০ ঘন্টা পরেই বন্ধ হয়ে যায় চিনিকলের কার্যক্রম। রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকলে প্রচুর চিনি অবিক্রিত থেকে যায়। ২০১৩ সনে তিনহাজার ২৪৬ মেট্রিক টন চিনি বস্তাবন্দী হয়ে দুই বছর ধরে গুদামে পড়ে গলে গেছে। রংপুর চিনিকল আখচাষি কল্যাণ গ্রুপের সভাপতি তখন গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছিলেন, চিনিশিল্প সংস্থার ভুল নীতির কারণে এত চিনি অবিক্রিত থেকে যায়। একটি হিসাবে দেখা যায় তিন বছরে প্রায় ৩১ কোটি টাকার চিনি অবিক্রিত ছিল। শুধু তাই নয়, মিল কর্তৃপক্ষ শ্রমিক কর্মচারীদের ঠিকমত বেতন ভাতা দিতেও সমস্যা করে। চিনিকলে র্করত প্রায় ৮১২ জন শ্রমিক তিন মাসের বকেয়া বেতন ভাতা, বোনাস ও পোষণ ভাতার দাবিতে ২০১৫ সনের ১২ জুলাই মিল চত্বরে বিক্ষোভ ও ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে।
বর্তমান সরকার বলছে, তারা চিনিশিল্প রক্ষায় দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ। এই সেক্টরে বিপুল সংখ্যক কৃষক এবং শ্রমিক কর্মচারীর স্বার্থ জড়িত রয়েছে। আসলেই কী তাই? চিনিকলগুলোতে কো-জেনারেশন পদ্ধতিতে একইসঙ্গে চিনি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নিচ্ছে চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন। এ লক্ষ্যে ৭৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকার একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। প্রথমে নর্থবেঙ্গল সুগার মিল থেকে ৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে এবং ২ মেগাওয়াট ব্যবহার করে জাতীয় গ্রীডে যুক্ত করা যাবে ৪ মেগাওয়াট। শুধু বিদ্যুৎ নয়, নর্থবেঙ্গল সুগারমিলে বছরে ৯০ লাখ লিটার মদ উৎপাদনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেখানে চিনি উৎপাদন প্রক্রিয়াটিই সক্রিয় নয়, সেখানে এর পাশাপাশি অন্য কিছু উৎপাদনের পরিকল্পনা কতটা যৌক্তিক। রংপুর চিনিকলের বাস্তবতায় আমরা কী দেখি? সেখানে তো নিয়মমত আখই চাষ করা হয়নি, জুমিন সব লুটপাট হয়ে গেছে। সেখানে আবার আখ ভিন্ন অন্য কিছু থেকে চিনি উৎপাদনের কথাও বলছে সরকার। আখের অভাবে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না করেই বেশ কয়েকটি চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আখের পরিবর্তে সুগারবিট ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। আখ উৎপাদনে রাষ্ট্র কখনোই আন্তরিক ছিল না, রংপুর চিনিকলও চিনি উৎপাদনে তৎপর ছিল না। যার জন্য পুরো প্রক্রিয়াটিই দেশের রাজস্ব ও শিল্পখাতকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। বরং সরকার ও আইন সম্পর্কে ভূমিবঞ্চিত হাজার হাজার মানুষের মনে একধরণের বঞ্চনা ও ক্ষোভ জমা হল দীর্ঘদিন। রাজনৈতিকভাবেই জনগণের বুকের গহিনে জমে থাকা এই অভিমান সরাতে হবে।
সরকারি তদন্ত প্রতিবেদনে কী আছে?
জন্মমাটি থেকে উদ্বাস্তু আদিবাসী ও বাঙালিরা পুরো ঘটনাটি প্রশাসনের নজরে আনে। সরকারিভাবে এ ঘটনায় সরেজমিন তদন্ত ও প্রতিবেদনও তৈরি হয়। কিন্তু এসব তদন্ত প্রতিবেদনও লংঘিত হচ্ছে। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিসের একটি প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ১৮৪২.৩০ একর জমির ভেতর আনুমানিক ১৫০২ একর জমি মিল কর্তৃপক্ষ শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত লিজ দিয়ে আসছেন এবং অবশিষ্ট ৩৪০ একর জমির মধ্যে স্টাফ কোয়ার্টার, রাস্তাঘাট, পুকুর আছে। ১৫০২ একর জমি ২০১৩-২০১৪ অর্থ বছরে ২৯ মাসের জন্য লিজ দেয়া জমিতে ধান, তামাক, গম ও পাট ও বিভিন্ন শাকসব্জি চাষ হচ্ছে। তবে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিস ২০১৫ সনের ২৮ জুন তারিখের একটি চিঠি থেকে জানা যায়, ৫টি মৌজার ৯২ থেকে ৯৭ একর জমিতে ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে আখ চাষাবাদ হয়েছে।
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি ভূমি ফেরতের দাবি জানিয়ে দরখাস্ত করেন গাইবান্দা জেলা প্রশাসক বরাবর ২০১৫ সনের ১৫ মার্চ। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সনের ৩০ মার্চ গাইবান্ধা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম এলাকা সরেজমিন তদন্ত করেন। তদন্তকালে তারা উল্লিখিত জমিতে ধান, তামাক ও মিষ্টিকুমড়ার আবাদ দেখতে পান। এ সময় গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং সার্ভেয়ার উপস্থিত ছিলেন। তদন্তের সময় চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জেনারেল ম্যানেজার এবং অভিযোগকারীদের বক্তব্য শোনা হয়। এ বিষয়ে গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ২০১৫ সনের ২১ জুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনটিতে আখ বাদে অন্য ফসল চাষের ক্ষেত্রে চিনিকল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হলো, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের ২৫/৮/২০০৯ তারিখের ১৮৭৪ নং বোর্ডসভার সিদ্ধান্তের আলোকে সাহেবগঞ্জ খামারের ১৫০২ একর জমিতে তারা আখ চাষের পাশাপাশি অন্যান্য ফসল আবাদ করার জন্য তারা জমি লিজ দিয়ে থাকেন। পাশাপাশি ‘অন্যান্য ফসল’ বলতে কীভাবে তামাক ও হাইব্রিড ভূট্টাকে বোঝায় তা স্পষ্ট নয়। কারণ চিনিকলের জমি মূলত: আখচাষের জন্য। চিনি একটি খাদ্যপণ্য। খাদ্য উৎপাদন বাদ দিয়ে খাদ্যের জন্য বরাদ্দকৃত জমিনে ‘তামাক’ আবাদ কীভাবে সম্ভব? কৃষক-জুমিয়া থেকে শুরু করে সরকার যেখানে দেশের খাদ্য সুরক্ষায় লড়ছে, সেখানে খাদ্যবিরোধী এই অন্যায় রাষ্ট্রীয় বৈধতা নিয়েই টিকে আছে। আবেদনকারীদের বক্তব্য এবং দাখিলকৃত কাগজপত্রাদি পর্যালোচনা করে জেলা প্রশাসক তদন্ত প্রতিবদনের শেষে মতামত দেয়, ‘আবেদনকারীদের অভিযোগ সত্য’। ভূমিহারা আবেদনকারীদের সত্য অভিযোগকে তাহলে সরকার কেন আমলে নিচ্ছে না? অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নেয়া জমিন জমিমালিকদের ফিরিয়ে দিয়ে ‘রংপুর (মহিমাগঞ্জ) সুগার মিলটি সক্রিয় ভাবে চালু করছে না?
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রস্তাব
শতাধিক ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ তৈরির ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ। নি:সন্দেহে কৃষিসভ্যতার রক্ত বয়ে নিয়ে চলা একটি দেশের জন্য এটি এক নয়াবার্তা। ঘুরে দাঁড়ানোর এক সাহসী কায়দা। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাবরই প্রাণ, প্রকৃতি ও জীবনে এক দু:সহ যন্ত্রণা তৈরি করেছে। গাইবান্ধা জেলা প্রশাসনও চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নেয়া জমিনে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে সরকারের কাছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে প্রস্তাবের সময় জেলা প্রশাসক নিজের চোখে দেখা কৃষি কাজকে অস্বীকার করেছেন। বরং গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন এক্ষেত্রে প্রবল মিথ্যাচার করেছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তাবপত্রে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন বিরোধপূর্ণ এ জমিনকে বলছে, ‘অব্যবহৃত’ ও ‘পরিত্যক্ত’। এবার তাহলে কী হবে? ভূমি উদ্বাস’ সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের গরিব আদিবাসী ও বাঙালিরা কখনো ধারণাও করতে পারেনি তাদের বংশগত ভিটামাটি নিয়ে রাষ্ট্র বারবার এমন ছিনিমিনি খেলবে? একটার পর একটা অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তা ছুঁড়ে দিবে ভূমিহীনের দিকে। ঘটনাটি ঘটেছিল পূর্ব পাকিস্তানে। বাংলাদেশ স্বাধীনের পরও নিদারুণভাবে রাষ্ট্র বর্ণবাদীই রয়ে গেছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য প্রস্তাবিত ভূমির প্রায়টাই কৃষি জমিন আর তাই এটি আখচাষের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবিত কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন ২০১৫ অনুযায়ী কোনোভাবেই কৃষিজমিনে শিল্পাঞ্চল সম্ভব নয়। এমনকি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইনে আছে, পরিবেশসহ অন্যান্য ক্ষেত্রের অঙ্গীকারসমূহ রক্ষায় অধিকতর দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও পরিবীক্ষণ কার্যক্রমকে উৎসাহিতকরণের কথা। রাষ্ট্র কী আইন ও জনআবদার উপেক্ষা করে তথাকথিত উন্নয়ন বাহাদুরি তৈরি করবে? ইতোমধ্যেই হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের চান্দপুর-বেগমখান চাবাগানের কৃষি জমিনে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির উদ্যোগ জনআন্দোলনের মাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্প থেকে সরকার জনপ্রতিরোধের মুখে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের ভূমিবঞ্চিত নারী-পুরুষেরাই যন্ত্রণা আর ক্ষোভ নিয়ে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। রাষ্ট্রকে জনগণের এই দ্রোহী আখ্যান ও আহাজারি বুকে ধারণ করবার মত সাহসী হতে হবে।
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি সংগ্রাম
ভূমিবঞ্চিত মানুষেরা দিনে দিনে সংগঠিত হয়েছেন। নিরুদ্দেশ হওয়া স্বজন প্রতিবেশীদের সন্ধান করেছেন। ২০১৪ সনের ৫ মার্চ গঠিত হয়েছে ৬১ সদস্য বিশিষ্ট ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি’। ২০১৫ সনের ২৫ ফেব্রুয়ারি সাহেবগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে সংগ্রাম কমিটি এক বিশাল জনসভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, এমপি, ৩২ গাইবান্ধা-৪। অনুষ্ঠানে ভূমিহারা কৃষকেরা এমপির কাছে স্মারকলিপি তুলে দেন। স্মারকলিপিতে সংগ্রামী জনতা উপস্থিত জনপ্রতিনিধির কাছে নিজেদর জন্মমাটি ফেরত পাওয়ার দাবি জানান। ২০১৫ সনের ৩০ আগষ্ট এ কমিটি জাতীয় আদিবাসী পরিষদসহ ঢাকায় এসে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে। প্রেসক্লাবের ভিআইপ লাউঞ্জে জন্মমাটি ফেরতের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে। সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬১ তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে সংগ্রাম কমিটি গোবিন্দগঞ্জের কাটামোড়ে প্রায় ৬০০০ মানুষের এক বিশাল সমাবেশ আয়োজন করে। ১০ জুলাই সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে কাটামোড় থেকে চারা বটগাছ পর্যন্ত চার কিলোমিটার রাস্তায় মানববন্ধন করে। আশেপাশের নানা এলাকার ৫০ হাজার আদিবাসীদের সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এই ভূমি আন্দোলনে। কিন্তু রাষ্ট্র জনগণের দাবিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, বরং হামলা-মামলার মাধ্যমে নানাভাবে আন্দোলন স্তব্দ করে দিতে চাইছে।
এলোপাথারি হামলা ও লাগাতার মামলা
সম্প্রতি অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নেয়া জমিনে ভূমিউদ্বাস্তু গরিব কৃষিমজুরেরা প্রায় ২০০০ পরিবার ঘর তুলেছে। ২০১৬ সনের ১ জুলাই চিনিকল কর্তৃপক্ষ, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা পাঁচটি মৌজায় পরিদর্শণ করে সকলকে ঘরবাড়ি তুলে চলে যাওয়ার কথা বলেন। ৩ জুলাই তারা পুনরায় স্থানীয় সাংসদসহ এসে আন্দোলনকারীদের জমি খালি করবার হুমকী দেন। ঐদিনই রংপুর চিনকল কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারী ১৩ জনের বিরুদ্ধে গোবিন্দগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও গোবিন্দগঞ্জ থানা নরেঙ্গাবাদের জাফরুল ইসলাম ও জাহিদুল ইসলামের নামে মামলা দায়ের করে। ৯ জুলাই মিল কর্তৃপক্ষ পুলিশসহ সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মে এসে সবাইকে ওঠে যাওয়ার জন্য ধমক দেয় এবং আগুন লাগিয়ে নতুন বসতি পুড়িয়ে দেয়ার হুমকী দেয়। ২০১৬ সনের ১১ জুলাই মিল কর্তৃপক্ষ দুপুর একটার দিকে পুলিশ ও লাঠিয়াল বাহিনি নিয়ে নারেঙ্গাবাদ মৌজায় অবস্থান নেয় এবং আন্দোলনকারীদের বাড়িঘর ভাঙচুর করে। নারেঙ্গাবাদ মৌজায় চিনিকলের একটি পরিত্যক্ত ঘর আছে, হামলাকারীরা সেই অফিস ভাঙচুর করে দায় চাপায় আন্দোলনকারীদের উপর। তারপর হঠাৎ কোনোধরণের ঘোষণা ছাড়াই পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর গুলি করে। ভূমিহীন জনগণও তীর-ধুনক নিয়ে দাঁড়ায়। পুলিশের গুলিতে বেলোয়া গ্রামের মাঝি হেমব্রম, বুলাকিপুর গ্রামের মাইকেল মার্ডি, গুচ্ছগ্রামের সোবান মুরমু ও বেলোয়া গ্রামের মুংলী টুডু চারজন গুলিবিদ্ধ হয় এবং অনেকেই আহত হয়। গুলিবিদ্ধ চারজনকে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের ওসমানপুর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করানো হয়। রাত প্রায় সাড়ে তিনটার দিকে অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, এমপি পুলিশসহ হাসপাতাল থেকে গুলিবিদ্ধ আহত চারজনকে গোবিন্দগঞ্জ থানায় সোপর্দ করেন। পরেরদিন তাদের গাইবান্ধা জেলে চালান দেয়া হয়। গুলিবিদ্ধ ৪জন সহ হরিপুর গ্রামের নাজারুশ টুডু এই পাঁচ জনের বিরুদ্ধে গোবিন্দগঞ্জ থানায় ১২ জুলাই একটি মামলা দায়ের হয়। একইসাথে গোবিন্দগঞ্জ থানায় আন্দোলনকারী ৩১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় ১২ জুলাই। ১৮ জুলাই মংলী টুডু ও নাজারুশ টুডু জামিন পান। পুরো সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম জুড়ে বিচারহীনতার পাশাপাশি এক ভয়ের অধ্যায়ও জারি হয়েছে। অনেকেই গ্রাম থেকে পলাতক, তিন জন হাজতে, কেউ আহত, কেউ নিরুদ্দেশ। অথচ রাষ্ট্র, বিচার বিভাগ কী শিল্পপ্রক্রিয়া সবই নিশ্চুপ। এমনকি গণমাধ্যমও এই ঘটনায় খুব একটা সরব ও সক্রিয় নয়।
নির্দয় কোম্পানি বনাম নিখোঁজ ওয়ারিশ
১৯৮৭ সালের ভূমি সংস্কার আইনে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘ভূমিহীনের’ বৈশিষ্ট্য পরিচয় তৈরী করা হয়েছে। উক্ত আইনে বলা হয়েছে, সেই পরিবার ভূমিহীন যে পরিবারের বসতবাটি এবং কৃষিজমি কিছু্ই নাই, কিন্তু পরিবারটি কৃষি নির্ভর। যে পরিবারের বসতবাটি আছে কিন্তু কৃষি জমি নেই অথচ কৃষি নির্ভর। যে পরিবারের বসতবাটি এবং কৃষি জমি উভয়ই আছে কিন্তু উহার মোট পরিমান ০.৫০ একরের কম অথচ কৃষি নির্ভর তারাই ভূমিহীন। কিন্তু অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নেয়া সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের জমিমালিকদের রাষ্ট্র কী বলবে? কী পরিচয় দেব? নিশ্চিতভাবে এর উত্তর একটি কোনো সূত্রে আবদ্ধ নয়, এটি উপনিবেশিকতা ও বর্ণবাদের এক চূড়ান্ত ভঙ্গি কাল থেকে কালে রাষ্ট্র যা বহন করে চলেছে। রাজনৈতিক চর্চার ভেতর দিয়েই এই বৈষম্যের গণিত পাল্টাতে হবে। মহাজোট সরকারে অন্যতম দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করেছিল, …আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনি অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। কিন্তু ভূমি কমিশন গঠন দূরে থাক আদিবাসীসহ দেশের মেহনতি নিম্নবর্গ তার নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের বিচারই পাচ্ছে না। মধুপুর শালবনের গীদিতা রেমা, নওগাঁর আলফ্রেড সরেন, শ্রীমঙ্গলের নাহার চাবাগানের নিতাই তাঁতি, খুলনার করুণাময়ী সর্দার কী নেত্রকোণার সত্যবান হাজং। ইতিহাস থেকে ইতিহাসে ভূমিশহীদদের তালিকাটি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। হুল, উলগুলান, তেভাগা, টংক, নানকার বিদ্রোহ থেকে আজকের সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি আন্দোলন। একদিকে মেহনতি নিম্নবর্গ, আরেকদিকে নিপীড়ক। সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের ভূমিউদ্বাস’ আদিবাসীরা ‘অধিগ্রহণ’ শব্দটি বোঝেন না, এমনকি ‘একোয়ার’। চিনিকলের জন্য কোম্পানি তাদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়েছে, দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে তারা এই বুঝে চলেছেন। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ, রাষ্ট্র বদল হলেও এই জমি নিয়ে রাষ্ট্রের মনস্তত্ত্ব পাল্টায়নি। এ নিয়ে ভূমিহারা মানুষের সাথে তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রের এক দীর্ঘ মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব ও বিবাদ।
ষাটের দশকে চিনিকলের জন্য এই জমি কেড়ে নেয়া হয়। এটি তৎকালীন উপনিবেশিক পাকিস্তান সরকারের বর্ণবাদী উন্নয়ন দর্শন। নিম্নবর্গকে স্তব্ধ করে, সকল বৈচিত্র্য ও সম্প্রীতি ছিন্ন করে তখন শুরু হয়েছিল বিনাশী সব উন্নয়ন প্রক্রিয়া। বিদ্যুত উৎপাদনের নামে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ডুবিয়ে দেয় পার্বত্য চট্টগ্রামের এক বিশাল অঞ্চল, নিরুদ্দেশ হয় এক লাখ আদিবাসী। তখনি দেশের কৃষিসভ্যতাকে রক্তাক্ত করে চালু হয় রাসায়নিক সার-বিষ নির্ভর তথাকথিত ‘সবুজ বিপ্লব’। চুক্তিবদ্ধ সকল কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রেই আমরা সবসময় রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে কোম্পানি। ব্রিটিশ জুলুমের ভেতর দিয়ে পরিচালিত হয় নীল চাষ। এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে প্রাকৃতিক বনভূমি বিনাশ করে রাবার চাষ। পার্বত্য বনভূমি উজাড় করে আজকের ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির তামাক চাষ। উত্তরাঞ্চলে মনস্যান্টো-সিনজেনটা কোম্পানির হাইব্রিড ভূট্টা আবাদ। ফিনলে-ডানকান কোম্পানির শৃংখলিত চাবাগান। চিনিকলের জন্য আখচাষ এবং এর জন্য জমি অধিগ্রহণও কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত এই মনস্তত্ত্ব ধরেই বিকশিত হয়েছে। তাই পাকিস্তান সরকার চিনিকলের নামে আদিবাসী-বাঙালিদের উচ্ছেদ করে আখ চাষের জন্য জমি অধিগ্রহণ করেছে। আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ কোনোভাবেই পাকিস্তান সরকারের সেই বর্ণবাদী বৈষম্যমূলক উন্নয়ন চিন্তা ও দর্শন ধারণ করতে পারে না। উন্নয়নের নামে রাষ্ট্র যেসব নাগরিককে নিরুদ্দেশ করেছিল, ভূমিউদ্বাস্তু মানুষেরা মাঠে ঘাটে ঘুরে ঘুরে নিখোঁজ ওয়ারিশদের খুঁজে বের করেছে। আজ সব ওয়ারিশ আবারো জেগে ওঠেছে, আর এটাই ইতিহাসের ব্যাকরণ। মহান হুলের নেতা ফুলমনি মুর্মু কী আজকের সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের গুলিবিদ্ধ মুংলী টুডুর রক্তে এই জাগরণই ধ্বনিত হচ্ছে বারবার। আমরা দৃঢ়ভাবে চাই সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির ন্যায্য দাবিগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়িত করবে সরকার। ‘রেস্টোরেশনের মাধ্যমে বাপ-দাদার ১৮৪২.৩০ একর সম্পত্তিতে’ সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের ভূমিউদ্বাস্তু আদিবাসী ও বাঙালি নারী-পুরুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোক, এখনি।
লেখক ও গবেষক। ই-মেইলঃ [email protected]
(প্রবন্ধটি ২০ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাব কনফারেন্স রুমে সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম বিষয়ক মতবিনিময় সভায় পাঠ করা হয়েছে)