পান জুমের খাসিয়া জীবনঃ যা প্রত্যক্ষ করে এলাম- সুমেধ চাকমা
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ার ভারত সীমান্তবর্তী এক খাসিয়া পুঞ্জি পরিদর্শনে গেলাম গত কিছুদিন আগে। সারি সারি চা বাগান বেষ্টিত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য লাগোয়া সেই পুঞ্জি। পুঞ্জিতে যাওয়ার পথে ভ্রমণসঙ্গী খাসিয়া এক উন্নয়নকর্মী তাদের আশা ও বেঁচে থাকার সম্বল পানজুমগুলো দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। কথার সূত্রে তিনি জানাচ্ছেন, বর্তমানে এক কুড়ি নতুন পানের দাম ১৫০০-২০০০ টাকা ( ১৪৪টি পানে এক কান্তা আর ২০ কান্তায় ১ কুড়ি)। তবে বাজার ভালো থাকলে পুরোনো পানের কুড়ির দাম কিছুটা বেশি, ৫০০০ টাকার মতন।
স্থানীয় এক তরুণের সাথে কথা হল। তার ভাষ্যে- তাদের পুঞ্জিটি তুলনামূলক নতুন প্রতিষ্ঠিত। ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে পানজুমকে পুঞ্জিতে পরিণত করেছেন তারা। সবমিলিয়ে ৫০টি পরিবারের এই পুঞ্জিতে বাস। তিনি আমাকে বললেন পুঞ্জির জমি সরকারি রেকর্ডভুক্ত জমি নয়। ২০০৫ সালের সেটেলমেন্টের সময় পুঞ্জির বয়োঃবৃদ্ধরা সচেতন ছিলেন না বলে এই পুঞ্জি সরকারি রেকর্ডভুক্ত হয়নি বলেও তিনি জানালেন। তবে আদিবাসীদের ভূমি ব্যবস্থাপনা ভিন্ন। তারা ভূমিকে বেচা বিক্রির পণ্য হিসাবে দেখে না। তারা এটিকে মা’ হিসেবেই লালন করে। হাজার বছর ধরে লালিত এই ধ্যান, ধারণা, বিশ্বাসের ফলে গড়ে ওঠা এই ভূমি কেন্দ্রিক স্বকীয় প্রথা। এই ভূমির জন্য লাগেনা কোনো দলিল, লাগেনা কোনো সরকারি নথি। কারণ ভূমিই তাদের কাছে মা। আর মা’র মালিকানা কী কোনো দলিল, দস্তাবেজের মাধ্যমে নির্ধারণ সম্ভব?
খাসিয়াদের নিজস্ব স্বকীয় সমাজ ব্যবস্থা রয়েছে। পুঞ্জি প্রধানকে তারা বলেন মন্ত্রী বা মান্ত্রী। উত্তরাধিকার কিংবা জনমতের ভিত্তিতে মন্ত্রীরা নির্বাচিত হন। পুঞ্জির লোকেরা মন্ত্রীকে খাজনা প্রদান করে থাকেন। কথা হলো সেই পুঞ্জির মন্ত্রীর সাথে। তিনি জানালেন, তিনি মাত্রই জনমতের ভিত্তিতে মন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। সেই সাথে জানালেন তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা। যা এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আদিবাসী মানুষেরই প্রতিধ্বনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই মন্ত্রী আমাকে জানালেন- কিভাবে সামাজিক বনায়নের নামে বনবিভাগ তাদের পানজুম কেটে দিয়েছে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে বনবিভাগ সেখানে সামাজিক বনায়নের অনুমতি দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবেই খাসিয়াদের অর্থনীতি পান আর সুপারি বিক্রির ওপর নির্ভরশীল। মন্ত্রী বললেন, সামাজিক বনায়নের নামে এখানে একাশিয়া গাছ লাগানো হচ্ছে। এ গাছগুলোতে পাখিরাও বসে না। এ গাছে পান চাষ করা একেবারেই অসম্ভব। ফলে তারা তাদের স্বাভাবিক জীবনকে যাপন করতে পারছে না। আদিবাসী জীবনে আলাদা জগৎ আছে। সেই জগৎ বন, পাখি, অরণ্য, প্রকৃতি, অন্যসব প্রাণ বৈচিত্র্য এক একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। কিন্তু সেই প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে কৃত্রিম বন সৃজনে কী আদিবাসী জগতের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা সম্ভব? আমি জানিনা, কোন আমলা’র মগজে এই চিন্তা।
মন্ত্রী আরো বললেন, গ্রামের প্রায় ১৫-১৬ জনের নামে বনবিভাগ মিথ্যা মামলা দিয়ে রেখেছে। দুর্গম পাহাড় থেকে মৌলভীবাজার পর্যন্ত মামলার হাজিরা দিতে যেয়ে এক জনের সারাদিনে খরচ হয় প্রায় ৫০০০ টাকা। প্রতিজনের নামে ৫-৬ টি করে মামলা। মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা শুধু হাজিরা দিতেই খরচ হচ্ছে। সংসার আর কোনোভাবেই চালানো সম্ভব হচ্ছে না। এ জীবন কী খাসিয়ারা কল্পনা করেছিল ?
মলিন মুখ নিয়ে ভুক্তভুগী এক খাসিয়া নারী বলছিলেন তার স্বপ্নভঙ্গের কথা। ‘একটি পান গাছ পরিপূর্ণ হতে ৫ বছর সময় নেয়। বনবিভাগের কর্মীরা সেকেন্ডের মধ্যে দা’য়ের এক কোপে আমাদের ৫ বছরের কষ্টে লালিত গাছগুলো কেটে দেয়। আমরা এখন মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি।’ সেই মানবেতর জীবনের কাতরতা কী বনবিভাগ কী বুঝবে ?
স্থানীয়দের মধ্যে কেউ নাম প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নন। এমনকি পুঞ্জির মন্ত্রী পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমের কাছে তার নাম প্রকাশ করতে চাননা। এসবের কেন্দ্রে আছে- ভয়। কারণ কোনো কিছু বললে তাদের নামে আরো মামলা দেয়া হবে; কিংবা বাঙালি নিয়ন্ত্রিত বাজারে তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস পান আর বিক্রি হবে না। স্থানীয় কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল, তাদের পুঞ্জিতে সামাজিক বনায়ন নামক সমস্যার শুরু মূলত ২০১৭ সাল থেকে। ২০১৭ সালে বনবিভাগ সামাজিক বনায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা জানালেন, দিন দিন তাদের আয়ের উৎস সংকুচিত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে তারা তাদের জন্মভূমি ছেড়ে পাশের দেশ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হবেন। ইতিমধ্যেই প্রায় ৩০ একর জমি বাঙালি ও বনবিভাগের দ্বারা দখল হয়েছে বলে জানালেন তারা। এই ভয় ঘুচাবে কে? খাসিয়া জীবনে নিরাপত্তা হবে কে ? প্রশ্নগুলো থেকে যায়।
পুঞ্জিতে আধুনিক জীবনযাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই, সেখানে পৌঁছায়না কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা। পুরো পুঞ্জি ঘুরে দেখা গেল প্রাথমিক শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। নেই কোনো স্বাস্থ্য কেন্দ্র। কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে পুঞ্জিবাসীরা কাঁধে করে দূরের মৌলভীবাজার হাসপাতালে নিয়ে যান। এভাবে চলতে থাকলে সত্যিই হয়তো একদিন এই আদিবাসী মানুষেরা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হবেন। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বাস করা নিভৃতচারী এই খাসিয়াদের নীরব কান্না কি সরকার কোনো দিন শুনতে পাবে না!
লেখক: সুমেধ চাকমা
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।