ক্ষুধার্ত সাজেক ও আমাদের রাষ্ট্রঃ ইমতিয়াজ মাহমুদ
এক কেজি চালে চারজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দুইবেলা ভরপেট খাবার হয়। চারজনের একটি পরিবারে যদি দুইজন শিশু থাকে তাইলে বা একজন শিশু থাকে তাইলে দুইবেলার জন্যে এক কেজি চাল লাগবে না। আপনি যদি বাবুর্চিদের কাছে জিজ্ঞাসা করেন তাইলে ওরা চালের বাজেট হিসাব করতে একজনের জন্যে এক বেলা দুইশ গ্রাম করে চাল লাগবে ধরে হিসাব করবে। এইভাবে হিসাব করে দেখেন তো, একটা ট্রাকে যদি দশ টন চাল ধরে তাইলে এই এক ট্রাক চালে কয়জন মানুষের দুইবেলা খাবার হয়? সহজ গণিত, জিপিএ ফাইভ না পাওয়া ছেলেমেয়েরাও করতে পারবে।
আমি চালের হিসাব কেন করছি? আমার অফিস কাওরান বাজারে, আমি মাঝে মাঝেই চালের ট্রাক দেখি। অফিস থেকে একটু দেরি করে বের হলে দেখি সারি সারি ট্রাক, চাল ডাল আলু শাক সবজি, খাবারের সবকিছু। দেখি আর ভাবি, সাজেকের জনসংখ্যা কতো? তার মধ্যে কতজন খাবারের অভাবে আছে? ওদেরকে দুই মাস দুই বেলা শুধু ভাতটুকু দিতে কয় ট্রাক চাল লাগবে? না, সুগন্ধি কাটারিভোগ চালের দরকার নাই। চট্টগ্রাম থেকে বা খাগড়াছড়ি থেকে মোটা আতপ চালই না হয় কিনলেন। কত টাকা লাগবে?
আরেকটা অংক করেন। এক কেজি চালের দাম চল্লিশ টাকা করে হলে এক টন চালের দাম চল্লিশ হাজার টাকা। চল্লিশ হাজার টাকায় কয়জন মানুষকে কতদিন কয়বেলা থালাভর্তি ভাত খাওয়াতে পারবেন হিসাব করেন তো।
আমি একসময় পার্টিবাজ টাইপ ছিলাম। রাতের বেলায় কারো বাসায় বা ক্লাবে বা রেস্টুরেন্টে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে পান করা, গান শোনা, আড্ডা দেওয়া- এইই। বা কোন কোন সময় একটু বড় পার্টি- নানান বয়সের নারী পুরুষ একসাথে, উত্তম খানা, উত্তম পানীয়, সুগন্ধি সিগার আর ইংরেজিতে আলাপ আলোচনা। এইসব একেকটা খরচ হয়, খুব ঘরোয়া টাইপ হলে পঞ্চাশ হাজার আর একটু বড় হলে তো খরচের আগামাথা নাই। কোন কোন পার্টিতে তো শুধু ইভেন্ট ম্যানেজাররাই আয় করে লাখ টাকা।
ঢাকা শহরে কোন একটা বড় হোটেলে পাঁচজন বা ছয়জন মানুষ যদি ডিনার করে সাথে একটা বা দুইটা করে ড্রিঙ্ক, চল্লিশ হাজার টাকার চেয়ে বেশী বিল হবে। গুলশান ও বনানী এলাকায় মেয়েদের জামাকাপড়ের কিছু দোকান আছে। এইসব দোকানে দুই সেট সালওয়ার কামিজ কিনবেন তো চল্লিশ হাজার টাকায় পাবেন না। এইরকম উদাহরণ আরও অনেকরকম দেওয়া যাবে।
আমি শুধু চালের হিসাবটাই করলাম। কারণ আমি আমাদের পাহাড়ের মানুষদেরকে চিনি- আদিবাসীদের কথাই বলছি, সেটেলাররা না, সেটেলারদের কথা আলাদা- পাহাড়ের মানুষেরা দুই মুঠ চাল পেলেই সাথে একটা শাক্য পাতা কিছু সিদ্ধ করে একটু নুন ছড়িয়ে মহা আনন্দে খেয়ে নেবে। শুধু ভাতও খায়- ওরা বলে বানা ভাত। সেটেলারদের কথা আলাদা কেন বলছি, ওদেরকে তো সরকারই খাওয়াবে, ওরা কখনো না খেয়ে থাকেনা।
না, আমি আপনাদেরকে বলছি না যে আপনি পাহাড়ের মানুষের অনাহারে থাকার দৃশ্য কল্পনা করে কাঁদবেন। বলছি না যে কল্পনা করুন পাহাড়ের ছোট শিশুটি যার মুখে বাবা মা সামান্য দুই টুকরা বুনো আলুসেদ্ধ ছাড়া আর কোন খাবার তুলে দিতে পারছে না। এগুলি তো মিডলক্লাস ইমোশনের ব্যাপার। এইসব সস্তা আবেগের দোহাই আপনাকে দেবনা।
আপনি একটা শুদ্ধ রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর আমাকে দেন। আমাকে বলেন তো, যে সমাজে এইরকম বৈষম্য থাকে- গোডাউন ভর্তি চাল, শহরের হাট বাজার ভর্তি সুস্বাদু পুষ্টিকর খাবার, দেশ চাল ডাল মাছ মাংস সবকিছুতেই স্বনির্ভর, অথচ একদল লোক নিতান্ত দুই বেলা শুদ্ধ ভাতই খেতে পায়না, এই সমাজটাকে আমি ভাঙবো না কেন? শো মি ওয়ান গুড রিজন, কেন আমি এই সিস্টেমটা ভাঙতে চাইব না?
মনে রাখবেন, এই অনাহারী লোকগুলি কিন্তু কাজ করতে চায়না বা পরিশ্রম করতে চায়না এরকম না। এটা একান্তই আমার রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যার্থতা। এই রাষ্ট্র আমি ভাঙবো না কেন?
ইমতিয়াজ মাহমুদঃ আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী