কল্পনা চাকমার অপহরণকারীদের শাস্তি ও ন্যায়বিচারের দাবিতে ঢাকায় সংহতি সমাবেশ ও প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৬ বছর উপলক্ষ্যে অপহরণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবীতে আজ ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনে সংহতি সমাবেশ ও প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম যৌথভাবে এই আয়োজন করে। বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমা’র সভাপতিত্বে এবং বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সভাপতি চন্দ্রা ত্রিপুরা’র সঞ্চালনায় সংহতি সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আন্তনী রেমা। এছাড়াও আলোচনা পত্র উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা। সংহতি সমাবেশে বক্তব্য রাখেন নারীপক্ষের সদস্য শিরীন হক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগের সদস্য দীপায়ন খীসা, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের শাহনাজ সুমী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ-সভাপতি রেখা চৌধুরী প্রমুখ।
স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আন্তনী রেমা বলেন, ২৬ বছর আগে আজকের এই দিনে পাহাড়ের আদিবাসী নারীদের কন্ঠস্বর কল্পনা চাকমা’কে অপহরণ করা হয়। কল্পনা চাকমার যে মুক্তির লড়াই সেটাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার অপচেষ্টা ছিল। কিন্তু ব্যক্তি কল্পনাকে স্তব্ধ করা যেতে পারে কিন্তু তার আদর্শ ও চিন্তাকে নয়। আদিবাসী নারীকে এখনো দমিয়ে রাখা হয়েছে। তার জন্য আমরা আমাদের লড়াই জারী রাখবো।
বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন, কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনাটি একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু।এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ও দেশের আদিবাসী নারীদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও সহিংসতার এক জ্বলন্ত প্রতীক। কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনাটি আজ ২৬ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও এই রাষ্ট্র, সরকার, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল বিভিন্ন দায়িত্বশীল বিভিন্ন গোয়েন্দা বিভাগ, সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন সকলেই কল্পনা চাকমার হদিশ দিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছ, পারেনি অভিযুক্ত অপহরণকারীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে।
নারীপক্ষের সদস্য শিরীন হক বলেন, আমরা একটা জায়গায় সমবেত হয়েছি, একটা বিশাল অন্যায় সে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে। এখনো এই প্রতিবাদ জারী রেখেছে পাহাড়ের নারীরা। অনেক আগে আমরা বড় ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এখন সেই প্রতিবাদ শোনার জায়গাও নেই। আগে আমরা কোনো না কোনো উত্তর পেলেও এখন কোনো উত্তর পাই না। কল্পনা অপহরণের ২৬ বছর মানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়সের অর্ধবছর। আমাদের জবাবদিহীতার জায়গাতে ঘাটতি আছে বলেই এসব হচ্ছে। ২৬ বছরে আমরা একটা গুম-খুন-হত্যা-অপহরণের দেশ হিসাবে পেয়েছি। কিন্তু আমরা তো এই ধরণের বাংলাদেশ চাইনি।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, কল্পনা চাকমার গ্রামে আমরা গিয়েছিলাম শান্তি চুক্তির পর পর। কল্পনা চাকমার মা এবং তার ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্র বা সরকার কল্পনা চাকমার সন্ধান দিতে পারেনি। আমরা যারা তাঁর সন্ধান চাই, বিচার চাই- আমরা সবাই অপেক্ষায়। গত ২৬ বছরে রাষ্ট্র অনেক বদলে গেছে। আগে যেমন লিখতে পারতাম কিন্তু এখন আর সেভাবে লিখতে পারি না। নিজে নিজে আমরা সেন্সর করি। অন্ধকারের পরে ভোর আসবে। আমরা প্রত্যাশা করি যে, যখন রাষ্ট্রের নাগরিকরা যখন এভাবে হারিয়ে যান, নিখোঁজ, নিরুদ্দেশ হন এবং খুঁজে না পান তখন আমাদের রাষ্ট্র, তার সাংসদ, জেনারেলরা দু:খিত হবেন, লজ্জ্বিত হবেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগের সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, কল্পনা অপহরণ নিয়ে আমরা নানা কিছু দেখেছি। তৎসময়ে ২৪ পদাতিক ডিভিশন হেলিকপ্টারের মাধ্যমে প্রচার পত্র বিলি করে তাকে সন্ধান দিতে পারলে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরষ্কার দেবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন। আমরা সহযোদ্ধা হিসাবে মিছিলে একসাথে ছিলাম। কিন্তু কল্পনা চাকমাকে চিনেছি ‘কল্পনা চাকমা’র ডাইরী পড়ে। কল্পনা চাকমা যে অবস্থান থেকে উঠে এসেছেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা সাধারণ কৃষিজীবি জুমিয়া পরিবার থেকে উঠে এসে পড়াশুনা করে প্রতিবাদী হয়েছেন। প্রান্তিক মানুষের কথা বলেছেন। সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যারা বলছেন কল্পনা চাকমা’র সাথে আমরা ছিলাম সেটা খুবই সহজ ছিল না। কেননা, তখনকার সময়টা খুব একটা ভালো ছিল না। ভৌগোলিক পরিস্থিতি ছিল বিরূপ এবং এখনকার সময়ের মত ইন্টারনেট ছিল না। কাজেই কল্পনার লড়াই, সংগ্রাম আজকের তরুণ বন্ধুদের বুঝতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের বয়স ২৬ কি ৫২ হলেও এর বিচার হবে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্র বিচার করবে না। দাম্বিকতা নিয়ে থাকবে। কিন্তু যতদিন মানবিকতার পক্ষে লড়াই হবে, জুম পাহাড়ের মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন আমরা কল্পনার আদর্শকে ধারণ করবো এবং অনন্তকাল আমরা কল্পনা চাকমাকে স্মরণে রাখবো বলে দৃঢ় প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে কল্পনা চাকমার বান্ধবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি কল্পনা চাকমাকে প্রথম দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে। খুব শান্ত শিষ্ট একটা মেয়ে। কিন্তু তিনি ছিলেন মেজাজী। একটা সময় সে আমাকে চিঠি দেয়। সেই চিঠিতে ছিল একজন বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং পাহাড়ে যা ঘটছে তা জানাবার প্রয়াস। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে পাহাড়ের প্রত্যন্তের একজন মেয়ে কীভাবে এত প্রাগ্রসর চিন্তা করতে পারে। কল্পনা সেসময় সেনাশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন এবং একই সাথে নিজ সমাজের পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের বিরুদ্ধেও। বাংলাদেশে নারী আন্দোলন একসময় জাতীয়তাবাদী ছিল। কল্পনা অপহরণের পরই প্রথম এই জাতীয়তাবাদী চরিত্রে অভিঘাত তৈরী করে। তখনই মূল ধারার নারী আন্দোলনের সাথে পাহাড়ের আদিবাসী নারী আন্দোলনের এক সমন্বয় ঘটে। কল্পনা চাকমার মেজাজের ধার কেবল বুঝতে পেরেছিল সেনাবাহিনী। যার জন্য তাকে অপহরণ করেই নি:স্তব্ধ করে দেওয়া হল। রাষ্ট্র সেসময় কল্পনার বিরুদ্ধে নানা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে পাহাড়ে সেনা শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেন তিনি। কল্পনা শুধু পাহাড়ের মশাল নয়, এদেশের নারী আন্দোলনে এবং নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের মশাল বলেও দাবি করেন তিনি।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের শাহনাজ সুমী বলেন, আমাদের দেশের জন্য খুবই দু:খজনক যে, ২৬ বছরেও আমরা কল্পনা চাকমার খোঁজ পেলাম না। এর মধ্যে ৩৯ বার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে। প্রশাসন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখনো তার কোনো হদিস দিতে পারেনি। এটা আমাদের বিচার ব্যবস্থার দুরাবস্থার কথা ইঙ্গিত করে। বাংলাদেশে আমরা যখন নারী নিপীড়নের ঘটনা দেখি তখন সেখানে বিচারের দীর্ঘ সূত্রিতা দেখি। আমরা যারা নারী অধিকার নিয়ে কথা বলি, স্বজন আছি তারা সবাই সেই ১৯৯৬ সালে কল্পনা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে রাজপথে আছি। অন্যদিকে ১৯৯৭ সালে যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তারও অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা একই সাথে কল্পনা অপহরণের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি চাই্ এবং পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী যে বাহিনীগুলোকে পাহাড়ের বাইরে সরিয়ে নিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল তাদেরও যেন সরিয়ে আনা হয় এবং পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চাই।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ-সভাপতি রেখা চৌধুরী বলেন, আজ ২৬ বছর হয়ে গেল। কিন্তু আমরা এখনো পর্যন্ত তার কী হয়েছে তা কিছুই জানতে পারিনি। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। তারপরও আজকে আমাদেরকে অপহরণ দিবস, নিঁখোজ দিবস পালন করতে হচ্ছে। নিখোঁজ ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজন ও শুভাকাংখীরা আবেদন জানিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো হদিস মিলছে না। একটা রাষ্ট্রে সুশাসন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কতটা ঘাটতি থাকলে এধরণের ঘটনাগুলো বারংবার ঘটে। এখন আমরা পোষাক কী হবে, কীভাবে চলবো সব ধরণের আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমরা যারা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা বলি, বাঙালি, আদিবাসী, প্রান্তিক সকল মানুষের বাংলাদেশের কথা বলছি সেসব মানুষরা আমরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছি। কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনা নিয়ে এখনো যারা কন্ঠ সোচ্চার রাখছেন তাঁদের সবাইকে কন্ঠ জারি রাখবার আহ্বানও জানান এই নারী নেত্রী।
এছাড়াও সংহতি বক্তব্য রাখেন কল্পনা চাকমা’র সহযোদ্ধা ও নারী নেত্রী ইলিরা দেওয়ান। অনুষ্ঠানের সভাপতি চঞ্চনা চাকমার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনা শেষ হয় এবং সংহতি সমাবেশের পরে প্রতিবাদী গান করেন মাদল, এফ-মাইনর, বাংলাদেশ আদিবাসী কালচারাল ফোরাম, ও অরূপ রাহী।