মতামত ও বিশ্লেষণ

কম্বলের বিনিময়ে আদিবাসীদের শেষ সম্বলঃ প্রশান্ত ত্রিপুরা

এই লেখায় যে বিষয়টা সামনে আনতে চাচ্ছি, তা ইতোমধ্যেই ছোট একটা স্ট্যাটাস (লিঙ্ক) আপডেটের আকারে প্রকাশ করেছি। তবে সেখানে আমার বক্তব্য সরাসরি পেশ করার বদলে আমি একটা প্রশ্ন রেখেছিলাম, যা এখানে আবার তুলে ধরছি:

পার্বত্য এলাকার এক পর্যটন কেন্দ্রে জমেছে কম্বলের পাহাড়।
এটির বিনিময়ে আজ নিয়ে নেওয়া হবে সেখানে জড়ো হওয়া পাহাড়ি আদিবাসীদের শেষ সম্বল।
কী সেটা?

উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর হিসেবে আমার ভাবনায় কী রয়েছে, তা বলছি। তবে প্রশ্নটা কেন মাথায় আসল, তা একটু বলে নেই আগে।

শীতকাল আসলেই কাতর মানুষদের অজস্র ছবি দেখা যায় বিভিন্ন মাধ্যমে। আমি শীতার্তদের কথা বলছি না, বরং দরিদ্র মানুষদের শীতবস্ত্র দেওয়ার নাম করে একজন দান-গ্রহিতাকে ঘিরে যে দশ-বিশজন প্রচার-প্রত্যাশী মানুষ ক্যামেরার সামনে সহাস্য বদনে দাঁড়িয়ে থাকে, সেই কাঙালদের কথা বলছি। বিভিন্ন মাধ্যমে এ ধরনের একাধিক অশ্লীল ছবি দেখেই আমার মাথায় উল্লিখিত প্রশ্নটা জেগেছে।

যে উত্তর আমার মাথায় রয়েছে, তা সরাসরি বলার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক আমার পূর্বোক্ত স্ট্যাটাসে যাঁরা মন্তব্য করেছেন, তাঁরা কোন ধরনের বিষয় উল্লেখ করেছেন:

ভূমি
ভিটামাটি
ইজ্জত
মা-বোনের সম্মান
সংস্কৃতি
জীবন
অনুভূতি
অধিকার
আত্মসম্মান

উল্লিখিত বিষয়গুলির মধ্যে ভূমি বা ভিটামাটির কথা আসে না, কারণ ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের সাথে মিশে আছে ভূমি হারানোর ইতিহাস। সাজেক থেকে নীলগিরি, সবখানে আদিবাসীদের প্রাক্তন পাড়া বা জুম ভূমিতেই গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। তার মানে নিজেদের পুরানো আবাসে মাগনা কম্বল নিতে আসা আদিবাসীরাতো তাদের ভূমি হারিয়েই বসে আছে ইতোমধ্যে, তাই ভূমি তাদের ‘শেষ সম্বল’ হতে পারে না।

‘ইজ্জত’ কথাটি সচরাচর পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে ‘মা-বোনের সম্মান’ কথাটাও একই ধরনের। এ ধরনের গোলমেলে ধারণা আমার বিবেচনায় ছিল না। অন্যদিকে ‘সংস্কৃতি’ কথাটি ব্যাপক, যার মধ্যে অনেক কিছুই চলে আসে। আমি ঠিক এমন কোনো উত্তরও আশা করছিলাম না।

সম্ভাব্য উত্তর হিসেবে আমি নিজে ‘জীবন’, ‘অনুভূতি’ বা ‘অধিকার’ নিয়ে ভাবি নি বটে, তবে এগুলি ভেবে দেখার মত বিষয়। যেমন, কম্বলের বিনিময়ে জীবন হরণের ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল, আর তা ঘটিয়েছিল ইউরোপের তথাকথিত ‘সভ্য’ মানুষেরা, যারা তাদের দৃষ্টিতে ‘অসভ্য’ আদিবাসীদের বসন্ত রোগীদের ব্যবহৃত কম্বল ‘উপহার’ দিয়ে নির্মূল করতে চেয়েছিল (এ প্রসঙ্গে আমার ‘সভ্যতার অন্ধকার, ভদ্রলোকীয় অন্ধতা ও আদিবাসী চেতনা’(লিঙ্ক) শিরোনামের নিবন্ধ পড়ে দেখতে পারেন)! তবে আমি ঠিক এমন কোনো বিষয় নিয়েও ভাবছিলাম না।

আদিবাসীদের শেষ সম্বল বলতে আমি ভাবছিলাম মর্যাদা বা আত্মসম্মানের কথা। যাদের আমরা আদিবাসী বলি, তাদের মধ্যে দা্ন-খয়রাতের উপর নির্ভরশীলতার ইতিহাস খুব একটা নেই, এবং অতীতে ভিক্ষাবৃত্তি একেবারেই দেখা যেত না। কিন্তু বঞ্চনার এসব উপসর্গ এখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, যার একটি নমুনা হল ত্রাণ গ্রহিতাদের কাতারে আদিবাসীদের সংখ্যাবৃদ্ধি। অথচ এই অবমাননাকর দৃশ্য দেখে আমরা অনেকে তথাকথিত ‘দাতা’দের বাহবা দিতে শুরু করি।

উল্লেখ্য, এই লেখার যে শিরোনাম একদম শুরুতে আমার মাথায় এসেছিল, তা ছিল, “চলুন ম্রোদের মর্যাদা কেড়ে না নেই”। ম্রোদের নাম কেন বিশেষভাবে উচ্চারণ করেছিলাম, তার কারণ রয়েছে। আজ সেটা বিস্তারিত ব্যাখ্যার সময় নেই, তবে সংক্ষেপে এটুকুই বলি, আমার দৃষ্টিতে ‘আদিবাসী’ বলতে যে ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক বাহক বোঝায়, পাহাড়িদের মধ্যে ম্রোদের মধ্যেই তা অনেকটুকু অটুট ছিল এই সেদিন পর্যন্ত। কিন্তু আজ আর সে কথা বলা যায় না। অথচ দুর্দশাপীড়িত ম্রোদের বিড়ম্বনার গভীরে না গিয়ে আমরা অনেকে ‘ম্রো’ পরিচয়কে নতুনভাবে তৈরি করে নিচ্ছি দানগ্রহিতা হিসেবে। ‘ম্রোদের জন্য অমুক [বা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেউ] এই করেছে, তমুক সেই করছে’ ধরনের কথা ঢাকঢোল দিয়ে প্রচার করছি। এতে করে কি পুরো ম্রো জাতিকে হেয় করা হচ্ছে না?!? তাদের কাছ থেকে চিম্বুকসহ বহু পাহাড় কেড়ে নিয়ে সেগুলির বিনিময়ে এখন তাদের কিছু কম্বল ‘দান’ করে যদি আবার সেই কাহিনি ফলাও করে প্রচার করা হয়, সেটা কি তাদের শেষ সম্বল কেড়ে নেওয়া নয়?

প্রশান্ত ত্রিপুরার ফেসবুক ওয়াল থেকে……।।
প্রশান্ত ত্রিপুরা; নৃবিজ্ঞানী।

Back to top button