“এইখানে য্যান থাকতে পারি, এইখানেই মরবার পারি”
সরেজমিন প্রতিবেদন; শ্যাম সাগর মানকিনঃ ৩রা অক্টোবর,শরতের ঝকঝকে বিকেল। ঢাকা থেকে আমরা কয়েকজন সাভারের মৈস্তাপাড়ায় এক বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিতে গিয়েছিলাম। আমাদের দলে ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, চলচ্চিত্র নির্মাতা লতা আহমেদ, আদিবাসী রাজনৈতিক কর্মী দীপায়ন খীসা, আদিবাসী যুবনেতা হরেন্দ্রনাথ সিং ও এই প্রতিবেদক। বিক্ষোভ সমাবেশে লোকজনের শোরগোল, ঢাকা থেকে প্রধান অতিথি এসেছেন। সবার চোখে মুখে বেশ উৎসাহ ঝিলিক দিচ্ছে। বিক্ষোভ সমাবেশটা মৈস্তাপাড়া বহুমুখী আদিবাসী কল্যাণ সমিতির ডাকে। যুগ যুগ ধরে বসত করে আসা ভিটে থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আতংক নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন লোকগুলো।
নেপালচন্দ্র আদিবাসী সমাবেশে আগতদের একজন, কথা হল উনার সাথে। কথায় কথায় জানা গেল, মৈস্তাপাড়ায় উনাদের বসত সেই নবাব আমল (ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর আমল) থেকে, তখন নীল চাষী হিসেবে এরা কাজ করতো। নবাব মৈস্তাপাড়ার খাস জমিতে তাদের বসতি করিয়ে দেন। কিন্তু বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত এক কর্ণেল তাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করে জমির দখল নিতে চাইছে। তারা এর প্রতিবাদ করছে। কথাগুলো বলতে বলতে কিছুটা স্মৃতিকাতর হতে দেখলাম লোকটাকে।
মৈস্তাপাড়া আদিবাসী বহুমুখী কল্যাণ সমিতির সভাপতি পরিমল আদিবাসী জানালেন, “আমরা সেই নবাবের আমল থেকে এখানে বসবাস করে আসছি। এখানে আমাদের প্রায় ৪৫ বিঘা জমি ছিল। সেখানে শ্মশান, মন্দির, কমিউনিটি সেন্টার, খেলার মাঠ, সবজি ক্ষেত ছিল, এখন কিছুই নেই। হারাতে হারাতে এখন একেবারে কোণঠাসা হয়ে গেছি। মাত্র দেড় দুই বিঘা জমিতে এতোগুলো পরিবার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করছি। ভূমি খেকোদের নজর এখন এই জমির উপরেও।”
মৈস্তাপাড়ার দক্ষিণ অংশে মূলত নিজেদের ‘বুনোয়া’ পরিচয় দেওয়া জনগোষ্ঠীদের বাস। পাড়ায় গিয়ে দেখা গেলো ঘেঁষাঘেঁষি টিনের ঘর, ঘিঞ্জি পরিবেশ। দেড় দুই বিঘার মধ্যে প্রায় ৩০-৪০ টি পরিবারের বাস। ছোটখাটো বস্তির মতন দেখতে। সেখানেই সরকারী অনুদানে নির্মিত মন্দির ও অব্যবহৃত কমিউনিটি সেন্টার। শুনেছি প্রায় পনের বিশ বছর হয় তাদেরকে এরকম একখানে করে দেওয়া হয়েছে। তখন কথা হয়েছিল এখান থেকে আর কেউ সরাতে পারবেনা। সরল মনের মানুষগুলো তা বিশ্বাসও করেছিল। কিন্তু ক্ষমতাবান লোকের লোভের যে শেষ নেই তা যেন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন তারা। এবার দখলদারদের চোখ তাদের এই সামান্য অংশটুকুতেও পড়েছে।
পাড়ার পাশেই ইটের দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে দখলি জমি। গেটে ‘দক্ষিণ সিটি’র নাম লেখা সাইনবোর্ড দেখা গেল। তাঁর মাঝখানে একটি ছোটখাটো বিল্ডিং যেটা দক্ষিণ সিটির অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাড়ার লোকগুলোকে ঐদিকে যেতে দেয়া হয়না বলে কেউ কেউ অভিযোগ করছিলো। এমনকি বাচ্চারা খোলা অংশে খেলতে গেলেও নাকি তাড়িয়ে দেয়া হয়। আর প্রতিনিয়ত জায়গা ছেড়ে দেয়ার হুমকি-ধামকি, রাস্তাঘাটে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে বিনিদ্র রাত আর অনিশ্চয়তার দিন পার করছে রাষ্ট্রের কাছে প্রান্তিক এই মানুষগুলো।
ফেরার আগে আমাকে এক তরুণ ডেকে নিয়া লড়াইয়ে জয় পরাজয়ের সম্ভাব্যতা জানতে চাইলো। আমাকে বললো, ‘ভাই আপনারা ঢাকা থেকে আসছেন দেখেন কিছু করতে পারেন কিনা। আমরা এ জায়গা ছেড়ে কোথাও যেতে চাইনা। এইখানে য্যান থাকতে পারি, এইখানেই মরবার পারি’। আমি কিছুই বলতে পারিনা। মনে মনে ভাবি দখলদারেরা খুব শক্তিশালী হয়তো, তাদের সাথে প্রশাসনের সব স্তরের লোকের যোগাযোগ রয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে প্রান্তিক মানুষগুলোর কাছে প্রভাবশালীরা প্রতিনিয়ত পেশির জোরে সব দখল করে নিয়েছে। এরা ক্রমেই দানব হয়ে উঠেছে। এই ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে লড়াইয়ে জেতা সহজ নয়। কিন্তু মানুষের প্রতি আস্থাবান থাকতে হয়। নিশ্চয় মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে লড়াই করবে দানবের বিপক্ষে।
মন্দির প্রাঙ্গণে ছোট ছোট বাচ্চারা মনের আনন্দে খেলা করছে দেখলাম। জীবনের এমন নির্মমতায় হয়তো কদিন পর তাদের আনন্দ উধাও হয়ে যাবে। তাই পূজোর জন্যে তৈরি হওয়া দেবী প্রতিমার মত অনড় তাকিয়ে থাকা মানুষের সাজে না। মৈস্তাপাড়ার ‘বুনোয়া’ জাতির মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে সে কারণেই হয়তো।