মতামত ও বিশ্লেষণ

আসুন সাজেক নিয়ে আমাদের ভাবনার পরিবর্তন আনি, মানবতার পাশে দাঁড়াই

মোহাম্মদ জাহেদ হাসানঃ বেশীদিন আগের কথা নয়, ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রথমবারের মতো সাজেক গিয়েছিলাম। যাওয়াটা কোনমতেই ঘুরতে যাওয়া কিংবা বেড়াতে যাওয়া বলা যাবেনা। উন্নয়কর্মী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর্থ সামাজিক উন্নয়নে গত ১০ বছর যাবৎ কাজ করছি তাই এখানকার প্রায় অনেকগুলো এলাকাতেই মাঠ পরিদর্শনে কম বেশী যেতে হয়েছে। আমি ও আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম কর্মসূচীর পরিচালক সে সময় সাজেকের খুবেই কাছেই এক সহযোগী সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়িত একটি প্রকল্পের কাজ দেখতে বাঘাইছড়ি গিয়েছিলাম। মাঠ পরিদর্শন শেষে খুব কাছে বলেই সাজেক থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য্যের একটা আকর্ষণ তো ছিলই, সেই সাথে আদিবাসী এই এলাকাকে ঘিরে সেনাবাহিনীরে এই পর্যটন প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক কৌতুহল ও কাজ করছিল। বাঘাইছড়ি থেকে সাজেক যেতে যেতে সেই আকর্ষণ কিংবা কৌতুহল আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের গাড়ী সহ অন্যান্য গাড়ীর হর্ণ শুনা মাত্রই ছোট ছোট শিশুরা বাসা থেকে ছুটে চলে আসছে। মায়ের কোলের শিশু থেকে শুরু করে স্কুলগামী শিশু সবাই হাত নাড়াচ্ছে, সেই সাথে কিছু একটা জিনিস বলার চেষ্টা করছে। সাথে সাথেই খবর নিলাম এখানে বাচ্চাদেরকে পযটক দেখলে টাটা দেওয়া কিংবা তাদের নিকট চকলেট চাওয়া একটা নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যা পার্বত্য এলাকার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভাবধারার সাথেই একেবারেই বেমানান। বোঝাই যাচ্ছে এই প্রকল্প তাদের জীবন জীবিকা সাংস্কৃতিক ধারাকে অনেকটা প্রভাবিত করে ফেলেছে, যা কোনমতেই কাংখিত ছিলনা। সাজেক প্রকল্পের কারনেই অনেক আদিবাসী পরিবারকে রাস্তার পাশেই বসতি গড়তে হয়েছে যা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ । বান্দরবানের ক্ষেত্রেও দেখেছি অনেকগুলো পরিবার নীলগিরী যাওয়ার পথে এমন ঝুঁকি নিয়ে জীবন যাপন করছে । সে যাই হোক, অনেকটা মন খারাপ নিয়েই সাজেক পৌছলাম। সাজেকের আশে পাশেই আমাদের সহায়তায় পাঁচটি কমিউনিটি স্কুল পরিচালিত হয়। এক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা হলো। কোমলমতি শিশুরা দূর দুরান্ত থেকে পায়ে হেটে স্কুলে আসে , যারা অনেকেই সকালের খাবার না খেয়েই স্কুলে আসে। অন্তত দুইবেলা খাবার জোটেনা অনেক পরিবারেরই। তার উপর আছে তীব্র পানি সংকট। শুধু মাত্র খাবার পানি সংগ্রহ করতে তাদের ছুটতে হয় মাইলের পর মাইল। তাই আপাত দৃষ্টিতে আমরা যে মনমুগ্ধকর সাজেক দেখছি, যার মুগ্ধতা উপভোগ করার জন্য আমরা দুর দূরান্ত থেকে ছুটে আসি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক কিংবা ইনষ্টাগ্রামে ছবি তোলে চেক ইন দেয়ে বলি –“আমি এখন স্বপ্নের সাজেক ভ্যালীতে-মেঘের দেশে” !, আর সেই আমরা কি কখনো সেখানকার আদিবাসী মানুষগুলোর প্রকৃত অবস্থা জানতে চেষ্টা করেছি? তারা কেমন আছেন? কিংবা কিভাবে বেঁচে আছে?
আসুন এবার একটু খোঁজ খবর নিতে চেষ্টা করি সেখানকার মানুষগুলোর। গত দুই মাস যাবৎ আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই ইউনিয়নের প্রায় ৪৫টি গ্রামের ৫০০ পরিবারের প্রায় ২৫০০ মানুষ খাদ্য সংকটের মধ্যে পড়েছে। এখানকার আদিবাসী জুম্ম জনগন মূলত তাদের ঐতিহ্যগত জুম চাষের উপর নির্ভরশীল, যারা ছয় থেকে সর্বাধিক নয় মাস চলনশীল খ্যাদ্যশস্য উৎপাদন করতে সক্ষম। তাই বছরের একটা সময় ৩-৬ মাস তারা খাদ্য সংকটে পড়ে। মূলত, এ খাদ্য সংকটটি শুরু হয় মার্চ-এপ্রিল থেকে এবং এটি অনেক সময় জুলাই-আগস্ট মাস পর্যন্তও চলমান থাকে। এ সময় সাধারণত পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলের জুম চাষীরা অবস্থাসম্পন্ন মহাজন থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে চাল কিনে থাকলেও সাজেকের দূর্গম এলাকায় সে অবস্থা নেই । তাছাড়া গত মৌসুমে জুম চাষের মাধ্যমে উৎপাদনও হয়েছে অনেক কম। যার ফলে গত তিন মাসে জুম্ম নির্ভর কৃষক পরিবারগুলিতে খাদ্য সংকট চলছে। সাজেকের বেশীরভাগ গ্রাম দূর্গম এবং যোগাযোগের জন্য অনুপযোগী হওয়াই সেখানে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের মূল্য বাজার মূল্যের তুলনায় অনেক বেশি। যার ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষের অনেকেই প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করতে পারছে না। এমতাবস্থায় এসব গ্রামের বেশিরভাগ পাহাড়ি মানুষই তাদের দিন কাটাচ্ছে অর্ধাহারে অনাহারে। তবে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়ে প্রশাসন ( দূর্যোগ ও ত্রান মন্ত্রণালয়, সেনাবাহিনী, পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়, রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ) গ্রামবাসীদের জন্য কিছু চাল পাঠিয়েছে, আশা করা যাচ্ছে আরো সহায়তা হয়তো শীঘ্রই আসবে । ইতোমধ্যে পাহাড়ী বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, ছাত্র সংগঠনগুলো নিজ নিজ উদ্যোগে সাহায্য সংগ্রহ শুরু করেছে, যা অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে বিষয়টিকে পাহাড়ের, কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের একক সমস্যা হিসেবে দেখলে চলবে না, এটিকে সামগ্রীক ভাবে দেখতে হবে। সরকারের পাশাপাশি জাতি-বর্ণ-ধর্ম নিবিশেষে সমাজের সকলের এগিয়ে আসতে হবে। শুধু মাত্র চাল দিলেই চলবেনা, চালের পাশাপাশি ত্রাণ হিসেবে তাদের উপযোগী পুষ্টিকর খাবার এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করতে হবে। যেহেতু থানচির মতো সাজেকে খাদ্য সংকট প্রতিবছর একটি নিয়মিত বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে, তাই সেখানকার মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে নীতি নির্ধারণ মহলকে নতুন করে ভাবতে হবে। বেসরকারী প্রতিষ্ঠান (এনজিও) গুলোকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন মেয়াদী পরিকল্পনা করা যেতে পারে। আমরা দেখেছি মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহায়তায় রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি, জুরাছড়িতে এবং বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কিছু ধান ব্যাংকের (গোলাঘর) মাধ্যমে এই ধরনের খাদ্য ঘাটতি পুরনে আপদকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাই সরকারী-বেসরকারীভাবে এমন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
আবার ফিরে আসি সাজেকের সৌন্দয্যের কথায় । একটু ভাবি, আমরা যখন কোন একটা সুন্দর জায়গায় বন্ধু বান্ধব-পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাই, আনন্দ করি, আর ঠিক সে জায়গার পাশেই যদি দেখি সেখানকার মানুষ অনাহারে –অর্ধাহারে আছে, কষ্টে আছে তা কি মেনে নেওয়া যায়? একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষকে দূর্যোগে রেখে আমরা কি ভালো থাকতে পারি? মানবতার দিক থেকে যদি বলি এটি নিশ্চয় লজ্জাজনক। পরিশেষে, আবারো বলি- আমি পর্যটনের বিপক্ষে নই, তবে তা কোনমতে তা বিশেষ অঞ্চলের কিংবা কোন মানুষের অধিকারকে লঙ্গিত করে নয়। তাই আমরা যারা সাজেকের মেঘের খেলা দেখতে দেখতে মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যেতে চাই, “বাংলার দার্জিলিং” অবহিত করে তার রূপ সুধা পান করতে ব্যাকুল হই, তারা অন্তত একবার সেখানকার পুনর্বাসিত মানুষগুলোর খবর নিন, তাদের সন্তানদের পড়াশুনার জানার চেষ্টা করুন, আর অর্ধাহারী-অনাহারী মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ান।
মোহাম্মদ জাহেদ হাসান
উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী
e-mail: [email protected]

Back to top button