“আমাদের শেকড় সুদৃঢ় করা, নিজেদের ভবিষ্যত নিজেরাই গড়ে তোলা”- ফালগুনী ত্রিপুরা
এশিয়া ইন্ডিজেনাস পিপলস প্যাক্ট’র ২৫তম এবং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের ১০ম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে অঙ্গীকারের ঘোষণা।
আদিবাসীদের সহজাত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সমুন্নত রাখতে, প্রসার ঘটাতে ও এগিয়ে নিতে; রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতন, বিজাতীয় সংস্কৃতি ও আইনী আগ্রাসন মোকাবেলা করতে; ঐক্য-সংহতি গড়ে তোলা, সম্মিলিত আশা-আকাক্সক্ষার লক্ষ্যে অভিজ্ঞতা ও চিন্তা-ভাবনা বিনিময় করার একটি ফোরাম হিসেবে; সমতা, ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রান্তিক ও নির্যাতিত জাতি, জনগোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কাছে পেতে ১৯৯২ সালে এশিয়া ইন্ডিজেনাস পিপলস প্যাক্ট গঠন করে,
উল্লেখিত চেতনায় পরিচালিত হয়ে, বিগত ২৫ বছর ধরে, আমাদের সহজাত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও স্বশাসিত সরকার ব্যবস্থার অধিকার; মানবাধিকার ও প্রথাগত আইন; ভূমি, ভূখন্ড ও সম্পদের উপর আমাদের অধিকার; সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার; এবং আমাদের নারী, শিশু, যুব, প্রবীন ও প্রতিবন্ধীদের অধিকারের লক্ষ্যে আলোচনা করা, প্রচার করা ও নিশ্চিত করার জন্য আমরা সংঘবদ্ধ ও সংগঠিত হয়েছি,
২০০৭ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের ঐতিহাসিক গৃহীতকরণের ফলে বিশ্বের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার প্রসারে ও সুরক্ষায় এবং আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইনী স্বীকৃতির প্রসার ও অগ্রগতি সাধনে যে যুগান্তকারী সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তাকে স্বীকার করে,
আমরা আমাদের কর্মপ্রচেষ্টায় সামনের দিকে অনেক এগিয়েছি, এবং আমাদের সামনে এখনো যে বিদ্যমান ও জরুরী চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, সেসব মোকাবেলায় অব্যাহতভাবে আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা রয়েছেÑ এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে, এআইপিপি’র ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের একদশক পূর্তি, ৯ আগস্ট ২০১৭ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে, এআইপিপি’র সদস্য সংগঠনসমূহ ঘোষণা করছে যে-
১. আমাদের রাজনৈতিক মর্যাদা স্বাধীনভাবে নির্ধারণ এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন পরিচালনার নিমিত্তে স্বশাসিত সরকারের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষাই হচ্ছে আমাদের সংগ্রামের চালিকাশক্তি। আমরা প্রাধান্য দিই যে, আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হলো গণতন্ত্রের জন্য যা সার্বজনীন মানবাধিকার নীতি ও আদিবাসীদের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে।
আমরা আমাদের সংগঠন শক্তিশালীকরণ ও গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করতে পুনরায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছি, যার মাধ্যমে আমাদের স্বকীয় রাজনৈতিক, আইনগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও গড়ে তুলতে আমরা উদ্বুদ্ধ হই।
আমরা একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সমতা, ন্যায়বিচার ও শান্তির জন্য রাষ্ট্র ও তার সংস্থাসমূহ, আন্তর্জাতিক সংস্থা, সুশীল সমাজের সংগঠন এবং অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক সম্প্রসারণ, সহযোগিতা ও কাজ করতেও অঙ্গীকার করছি।
২. আমাদের ভূমি, ভূখন্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে আমাদের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক এবং আমাদের নিজস্ব ভাষা, ধর্ম ও প্রথা সংরক্ষণের মাধ্যমে আমাদের যে স্বকীয় অস্তিত্ব, তা আজ সামরিকায়ন, উন্নয়ন আগ্রাসন, উচ্ছেদ ও সাংস্কৃতিক কর্তৃত্বের ফলে হুমকীর সম্মুখীন হয়েছে।
সুতরাং, আমরা আমাদের স্বাধীনতা এবং আমাদের ভূমি, ভূখন্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারের পুন:প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এবং পরিবর্তিত অবস্থা অনুসারে নিজেরাই নিজেদের বিষয় নির্ধারণ করার যে প্রক্রিয়া ও উপায় রয়েছে তদনুসারে এসবের উপর আমাদের অব্যাহত স্বত্বাধিকার নিশ্চিতকরণের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি।
আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিশ্চিকরণ এবং আমাদের ভাষা, ধর্ম ও রীতিনীতি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরকরণের জন্য সকল প্রকার পন্থা গ্রহণে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
৩. আমাদের ন্যায়বিচার, সততা ও অন্তর্ভুক্তিকরণের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আমাদের বিশ্বব্যাখ্যা ও মূল্যবোধের সাথে দৃঢ়ভাবে গ্রোথিত আমাদের প্রথাগত প্রতিষ্ঠান ও শাসন ব্যবস্থা আজ রাষ্ট্র কাঠামো ও বিজাতীয় আইন ব্যবস্থা এবং বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাবের ফলে মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
আমাদের জন্য অর্থবহ ও সঙ্গতিপূর্ণ অবকাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে আমাদের হস্তান্তরকরণ ধারা ও অব্যাহতকরণ প্রক্রিয়ার জন্য, পাশাপাশি এবং পক্ষান্তরে, রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা বা জায়গা নিশ্চিত করতে আমরা আমাদের প্রথাগত প্রতিষ্ঠান ও শাসন ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিতকরণের জন্য অঙ্গীকার করছি।
৪. নারী, শিশু, যুব, প্রবীন, প্রতিবন্ধী ও এল.জি.বি.টি.আই.সহ আদিবাসী সম্প্রদায়ের স্বকীয় অধিকার এবং বিশেষ বিশেষ বিষয়ের উপর ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন হয়েছে।
এসব জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র প্রয়োজনীয়তার প্রতি যাতে ব্যবস্থা নেয়া হয় তা নিশ্চিতকরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে আমরা নিজেদেরকে অঙ্গীকার করছি।
৫. আদিবাসী নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকারের অগ্রগতি সত্ত্বেও, আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে আদিবাসী নারীরা যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে, যথার্থভাবে তার স্বীকৃতি নেই, এবং বিশেষ করে রাজনৈতিক পরিমন্ডলে সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় তাদের সমান সুযোগ নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
এক্ষেত্রে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে, আমরা আদিবাসী নারীর সমান অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের অঙ্গীকার করছি।
৬. জলবায়ু পরিবর্তনের সমকালীন চ্যালেঞ্জসমূহ বেড়ে চলেছে এবং অভূতপূর্ব ঘটনার উদ্রেক হচ্ছে যা মানুষের জীবন, উন্নতি ও বিশ্বশান্তিকে বিপদাপন্ন করছে। পরিবেশের মধ্যে জীববৈচিত্র্যতার সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে, আদিবাসীদের বেঁচে থাকার অস্তিত্ব মারাত্মক ঝুঁকিতে পতিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত এরকম সংকট মোকাবেলায় রাষ্ট্র ও তার এজেন্সিসমূহ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সকলকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।
সুতরাং, সতর্কভাবে সমন্বিত সমাধান বের করার জন্য এবং নৈতিকভাবে একটি সমভাগী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পরিপূরক ও অংশীদারিমূলক দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্র ও তার এজেন্সিসমূহ, আন্তর্জাতিক এজেন্সি, নাগরিক সংগঠন এবং অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক সম্প্রসারণ, সহযোগিতা ও কাজ করার জন্য আমরা অঙ্গীকার করছি।
৭. আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র গৃহীতকরণের ফলে অর্জিত অগ্রগতি ও সুযোগ সত্ত্বেও, ঘোষণাপত্রে সন্নিবেশিত আশা-আকাক্সক্ষাসমূহ এখনো অর্জিত না হওয়ায় এবং এশিয়া অঞ্চলের সরকারসমূহ এসব বাস্তবায়নে অনাগ্রহী হওয়ায় আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করছি।
ঘোষণাপত্রের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের নিমিত্তে রাষ্ট্র, আন্ত:সরকারি, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক এজেন্সি ও সংগঠনসহ সকল প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার জন্য সকল প্রকার সুযোগ কাজে লাগাতে আমরা অঙ্গীকার করছি।
উপরেল্লেখিত অঙ্গীকার ব্যক্ত করে, আদিবাসীদের দাবিনামা ও আশা-আকাঙ্খা পরিপূরণে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী, নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করা এবং তাদের সমর্থন আরো জোরদার করার জন্য আমরা উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।