জাতীয়

আমরা অর্জন ধরে রাখতে পারিনাঃ পার্বত্য চুক্তির ২২ বর্ষপূর্তিতে মেনন

সতেজ চাকমা: বিগত চার দিনের পত্রিকা পড়ে আমার মনে হয়েছে আমরা আবার জিয়ার আমল বা সামরিক শাসনের দিকে যাচ্ছি বলে মন্তব্য করেছেন ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি ও সাংসদ রাশেদ খান মেনন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২২ তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আজকের আয়োজিত জাতীয় সংলাপে এসব কথা বলেন এই রাজনীতিবিদ। তিনি আরো বলেন, সংঘাতের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত করা সেটেলার বাঙালিদেরকে সামনে রেখেই সেনাবাহিনী যুদ্ধ পরিচালনা করত। তাদের (পুনর্বাসিত হওয়া সেটেলার বাঙালি) কোনো দোষ নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণণা করে তিনি আরো বলেন, ‘আমি যখন পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলাম তখন খোদ সেনা-প্রধান(তৎকালীন) আমার অফিসে এসে জানালেন তাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছু রিসোর্ট করতে চায়। তাহলে কোথায় পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী ‘পর্যটন’ খাতটি পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হয়েছে বলে ধরা হয় বলেও প্রশ্ন তুলেন তিনি। পার্বত্য চুক্তি নিয়ে আমাদের যে অর্জন সে অর্জন আমরা ধরে রাখতে পারিনি বলেও হতাশা প্রকাশ করেন এই সাংসদ। এছাড়া তিনি আশা প্রকাশ করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সাহসী ও আন্তরিক প্রয়াস নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। সে চুক্তি তাকেই বাস্তবায়ন করতে হবে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।

বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের কো-চেয়ারম্যান সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে এবং তাঁর পরিচালনায় জাতীয় সংলাপে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এএলআরডির চেয়ারম্যান ও নিজেরা করি’র নির্বাহী পরিচালক খুশি কবির। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘যারা মানবাধিকারে বিশ্বাস করেন তাদের জন্য পার্বত্য চুক্তি একটি বিশাল প্রত্যাশার জায়গা। দীর্ঘ যে সংগ্রাম ছিল সে সংগ্রামের মাধ্যমে পাহাড়ের আদিবাসীদের যা পাওয়ার কথা ছিল তা হয়নি।

সংহতি বক্তব্যে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান বলেন, চুক্তির পরে আমরা আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু ২২ বছরেও এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। যার ফলে চুক্তি বাস্তবায়নের এই দীর্ঘ সূত্রিতা আমাদেরকে হতাশ করেছে।

উক্ত সংলাপে অংশ নিয়ে চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বলেন, ইদানিং কালে চুক্তি নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। আর বলতে ভালো লাগেনা বলেও হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি হবে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের নয় দাবী করে তিনি আরো বলেন, আজকাল মিডিয়াই যে খবরগুলো চলে আসে সেগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত বৈষম্য তুলে ধরা হয় না । পাহাড়ের স্বকীয়তা না রাখতে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ তার।

আলোচনায় অংশ নিয়ে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। এ মাস আসলে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে উৎসব আর আনন্দে মেতে উঠি। কিন্তু শরীরের কোথাও ক্ষত থাকলে সে সুখানুভূতি আর থাকে না।

তিনি আরো বলেন, সরকার ২০১২ সাল থেকে বলে আসছে চুক্তির ৪৮ টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ক্রোড়পত্র প্রতারনায় ভরা। এই মিথ্যার বেসাতি পরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ক্ষোভ জানিয়ে তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চুক্তির মূল কেন্দ্র বিন্দু হল -ভূমি। বাকীগুলো বাস্তবায়িত হলো কী না এটা দেখবার বিষয় নয়। পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের প্রতি উদ্দেশ্য করে তিনি আরো বলেন, আগে ভূমির মালিকানা বিষয়টি সমাধান করুন তারপর নাহয় আপনারা মন্ত্রণালয়ে বসে থাকুন।

আলোচনায় অন্যতম অতিথি বিচারপতি মো: নিজামুল হক বলেন, যে ইস্যু নিয়ে আমরা আজ আলোচনা করছি সেটা আজ আলোচনা করার কথা ছিল না। ১৯৯৭ সালে আমরা এটা ভাবি নাই যে ২০১৯ সালে এসেও চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে কথা বলতে হবে। তিনি আরো বলেন, এটা এক ধরণের অশনি সংকেত যে, পাহাড়ে আমাদের (বাঙালিদের) নাম্বার বেড়ে যাচ্ছে, আর তোমাদের (পাহাড়িদের) নাম্বার কমে যাচ্ছে।

উক্ত অনুষ্ঠানে অন্যান্য আলোচকদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের উপদেষ্টা ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, বান্দরবান জেলার আদিবাসী ফোরাম নেতা জুমলিয়ান আমলাই বম। এছাড়া উক্ত অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আয়োজক সংস্থা এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।

মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালের সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উক্ত সংলাপটি শেষ হয়। সুলতানা কামাল তাঁর বক্তব্যে পার্বত্য চুক্তিকে প্রক্রিয়ারত খাবারের সাথে তুলনা করে বলেন, সরকার বাজার করে নিয়ে এসেছে, বাটনা বেটেছে, কুটনাও কুটেছে, ধৌত করেছে কেবল রান্নার কাজটিই বাকী আছে। তিনি পার্বত্য চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নের জোড় দাবী জানান।

Back to top button