আদিবাসী সাংস্কৃতিক শক্তিঃ ঈশানী চক্রবর্তী
আদিবাসী বলতেই আমাদের গড়পড়তা বাঙালি মানসে সাধারণভাবে সহজ-সরল, বোকা-সোকা, অশিক্ষিত, দরিদ্র, নিস্পেষণ, নিপীড়নে ন্যুজপ্রায় একগুচ্ছ মানুষের ছবি ভেসে ওঠে। এর বিপরীতে আদিবাসী শক্তির ধারণা কেমন যেন বেমানান লাগে- এদের আবার শক্তি! ক্ষমতা ও শক্তির ধারণা মিলেমিশে এক হয়ে যাবার কারণে এমনটা মনে হয় যে, ক্ষমতাহীন মাত্রেই শক্তিহীন! ক্ষমতা থেকে দূরে থেকেও যে শক্তির অধিকারী হওয়া সম্ভব এদেশের আদিবাসীদের আবহমান কালের ইতিহাস তারই সাক্ষ্য দেয়। ভারতবর্ষে আদিবাসীদের ইতিহাস মানেই মূলতঃ বিরতীহীনভাবে প্রবল বিরুদ্ধ শক্তির মোকাবেলা করে টিকে থাকার ইতিহাস। যুগ যুগ ধরে, সেই আর্যদের আগমনের সময় থেকে এদেরকে একাদিক্রমে একাধিক আগ্রাসী শক্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে। এর মধ্যে একাধারে রয়েছে আগ্রাসী বিদেশী শক্তি ও আধিপত্যকামী দেশীয় শক্তিরা। শুরু হয়েছে আর্য-অনার্য সংঘাত দিয়ে দেশীয় ভূমিজ আদিবাসী মানুষদের হঠানোর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে, পরবর্তীতে যা প্রবল হয়েছে উপনিবেশিক শক্তির শাসন শোষণের মাধ্যমে। উপনিবেশ উত্তরকালীন সময়ে শাসক বদলালেও আদিবাসীদের জন্য শাসন-শোষণের হাত থেকে নিস্কৃতি মেলেনি। বরং ভিন্নতা ও স্বল্পতার অজুহাতে তাদের উপর দেশজ বৃহৎ জাতিগোষ্ঠীর নির্যাতন নিপীড়ন এসময় বহুমাত্রিক রূপ ধারণ করেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আধিপত্যের পাশাপাশি চলেছে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন যা পাকিস্তান আমল থেকে অদ্যাবধি স্বাধীন বাংলাদেশে সমানভাবে অব্যাহত। বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে যে, এতো প্রতিকূলতা, শাসন- শোষণ, নিপীড়ণ সত্ত্বেও আদিবাসীরা নিঃশেষ, নিশ্চিহ্ন না হয়ে বরং সগৌরবে টিকে রয়েছে। আধিপত্য, আত্মীকরণ, বিচ্ছিন্নকরণ, উৎখাত, নির্মূলকরণের নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এদের অস্তিত্ব বিলোপ ঘটেনি, বরং নিজস্বতা ও স্বকীয়তা নিয়ে টিকে আছে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আগ্রাসী বিশ্বায়নের ফলে ছোট-বড় অনেক মূলধারার জাতিগোষ্ঠীও আজ যেখানে সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন সেই হুমকীর সামনেও কিন্তু সংখ্যাল্প, সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত আদিবাসীরা নিজেদের স্বতন্ত্র সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ে সগর্বে টিকে রয়েছে।
প্রবল প্রতিকূলতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে টিকে থাকার এই যে অসম্ভব শক্তি তার উৎস কি? আলবেয়ার কামু তার বিখ্যাত উপন্যাস প্লেগ এ এক বিরল ভাবনার উপস্থাপন করেছিলেন যে, জীবনের নিরাপত্তাহীনতা মানুষকে এমন গভীর ভাবনায় প্ররোচিত করে যা আর কিছুতে করে না। এর মধ্যে এক ধরণের essentialism থাকলেও এর অনুকরণে আমরা কি ভাবতে পারি আধিপত্য ও নিপীড়নের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, অনিরাপদ, অনিশ্চিত জীবন এবং অস্তিত্ব রক্ষার নিরন্তর সংগ্রাম আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ক্ষয়িষ্ণু, ভঙ্গুর না করে শক্তি ও সাহস দিয়েছে? দীর্ঘ অনিরাপত্তা, অধিকারহীনতা ও সংগ্রাম মানুষকে লড়াকু করলেও, কখনো কখনো তা প্রাণশক্তি নির্জীবও করতে পারে। কাজেই শুধু ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা শোষণ নিপীড়ন এবং প্রতিরোধ সংগ্রাম দিয়েই আদিবাসী শক্তির উৎসের পুরোটা ব্যাখ্যা মেলে না।
আদিবাসী শক্তির মূল উৎস তাদের সমাজ ও সংস্কৃতির বিশেষ ধরণ। ভারতবর্ষ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ভারতবর্ষের ঐক্য রাষ্ট্রভিত্তিক নয়, সমাজভিত্তিক। ভারতবর্ষের বা উপমহাদেশের মূলধারার জনগোষ্ঠীরা সেই ঐতিহ্য হারিয়ে পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক রাষ্ট্রশক্তির উপর নির্ভর করেছে, যার খেসারত এখনো আমরা নানাভাবে দিয়ে চলেছি। বিপরীতে আদিবাসী জীবন এখনো সমাজ ও গোষ্ঠীভিত্তিক। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পত্তন ও আগ্রাসনের কারণে নির্দিষ্ট রাষ্ট্রকাঠামোয় বসবাস সত্ত্বেও আদিবাসীরা অদ্যাবধি স্বতন্ত্র সমাজবদ্ধ জীবনের ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছে । যে স্বাতন্ত্র ও ঐতিহ্যিক জীবনাচরণের কারণেই তারা অন্যদের থেকে ভিন্ন তথা আদিবাসী। আবার এ কারণেই মূলধারার অনুকরণ স্বর্বস্ব অধিপতি জনগোষ্ঠীর চোখে তারা ’আদিম’, ’অসভ্য’, ‘জংলী’ বা আরো কত কি! আদিবাসী প্রসঙ্গে কোথাও বলা হয়েছিল যে, এরা proud but not primitive। এই গর্ববোধ থেকেই এরা বিভিন্ন সময়ে আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার শক্তি দেখিয়েছে, সে লড়াই যতই অসম হোক না কেন। লড়াই এর কৌশল হয়তো পাল্টেছে সময়ের সাথে সাথে, কিন্তু সংগ্রামী প্রবণতা রয়ে গেছে।
আদিবাসী সংস্কৃতির বলিষ্ঠতার আরেকটা দিক হচ্ছে প্রকৃতি নির্ভর, শ্রম-ঘন জীবনধারা। বন, পাহাড়, নদী ও মাটির সাথে এদের জীবন, জীবিকা ও সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ক। এরা জীবনের প্রয়োজনে প্রকৃতিকে ব্যবহার করে, আবার জীবনের প্রয়োজনেই প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করে। কেননা, বন পাহাড়ের সুরক্ষা তার খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্যই আবশ্যক। স্বভাবতঃই তার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও আবর্তিত প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বহুল পরিচিত কাড়াম পূজা এরই একটা দৃষ্টান্ত। প্রকৃতির সাথে আদিবাসী জীবনের পারস্পরিক এই দেয়া-নেয়া, ভারসাম্য রক্ষা করে চলা আবহমানকালের। ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বর্তমানে পরিবেশগত ভারসাম্য তথা ecological balance বজায় রাখার যে আপ্তবাক্য নিরন্তর সর্বস্তরে কপচানো হচ্ছে তা আদিবাসী জীবনধারার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য। আদিবাসীরা এই ভারসাম্য রক্ষার কৌশলে সিদ্ধহস্ত; এরা প্রকৃতি থেকে, বন থেকে ততটুকু্ই নেয় ঠিক যতটুকু তাদের প্রয়োজন। যে কারণে ঐতিহ্যগতভাবে এদের অর্থনীতি ছিল subsistent economy ভিত্তিক, surplus economy ভিত্তিক নয়। ধনতান্ত্রিক সমাজে উদ্বৃত্ত অর্থনীতি ভিত্তিক মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে আদিবাসী সমাজের কাঠামোগত পার্থক্য এখানেই। আদিকালে সব মানুষকেই জীবন ও প্রকৃতির মধ্যে এক ধরণের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হতো, আর সেজন্যই সম্ভবতঃ পৃথিবী আজও অবধি বাসযোগ্য রয়েছে। তবে ভোগবাদী ধনতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে তথাকথিত আধুনিকায়ের নামে যে প্রকৃতি- বিচ্ছিন্ন , প্রকৃতি-বিরূপ জীবনরীতির প্রচলন ঘটেছে তাই আজকের বিশ্বের পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। তারপরেও এই অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় যে, আদিবাসীরাই নাকি বন, পাহাড় ধ্বংস করে- গাছ কেটে, জুম চাষ করে প্রকৃতিকে নিঃশেষ করছে। সারবত্তাহীন এই অভিযোগের কূট রাজনীতিটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়না, যার মূলে রয়েছে দখল, উৎখাত, উৎপাটন, বিতাড়ন ইত্যাদির চিরচেনা বাসনা, তা সে উন্নয়ন, রিজার্ভ ফরেষ্ট, ইকো পার্ক, অধিগ্রহণ ইত্যাদি যে নামেই করা হোক না কেন। জীবনধারার আদি মানবিক টেকসই রীতিগুলো ধরে রেখেছে বলেই তো আদিবাসীরা এখনো ‘আদিবাসী’। প্রকৃতি নির্ভর বিধায় আদিবাসী জীবন দৈহিক শ্রমের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, এমনকি আজকের এই টেকনোলজি নির্ভর সময়েও। যে জন্য তাদের নাচ, গান, গল্পকথায় শ্রমের জয়গান তথা বস্তুনিষ্ঠ জীবনের সাথে গভীর সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়। আদিবাসী সংস্কৃতির বলিষ্ঠতার ও স্থায়ীত্বের সম্ভবতঃ এটি আরেকটি কারণ।
সাংস্কৃতিক শক্তি ও বলিষ্ঠতার কারণেই সংখ্যায় অতি অল্প হওয়া সত্ত্বেও, বৃহৎ অধিপতির সংস্কৃতিতে আদিবাসীরা বিলীন হয়ে যায়নি কখনোই। ভারতীয় উপমহাদেশে আদিবাসীদেরকে পর্যায়ক্রমে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, ইসলাম ইত্যাদি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মসমূহকে মোকাবেলা করতে হয়েছে একের পর এক। অন্য যেকোন সংস্কৃতির মতোই সর্বপ্রাণবাদী, প্রকৃতি-পূজারী আদিবাসীরা এসব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে কখনো কখনো গ্রহণ করেছে বা তাদের রীতি আচরণ, প্রথা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, কিন্তু মূল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে নয়। আর্যদের আগমনের পর একসময় হিন্দু চতুরাবর্ণাশ্রম প্রথার মাধ্যমে ডোম, হাড়ি, মুচি, মেথর ইত্যাদি পেশাজীবিগোষ্ঠীর নিম্নবর্ণ হিসেবে আত্মীকরণ ঘটে; কিন্তু একই সময় আদিবাসী সাঁওতাল, ওরাও, মুন্ডা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীরা কিন্তু কখনোই এই নীচের স্থানটিকে মেনে নেয়নি। তারা বর্ণাশ্রম প্রথার বাইরে স্বতন্ত্র স্বত্তা নিয়ে টিকে থেকেছে, পরবর্তীকালে scheduled tribe হয়েছে, কিন্তু scheduled caste নয়। অত্যন্ত গর্বের সাথে সাঁওতালরা বলে থাকেন, ‘আবে দো হড় জাতি’ । সাঁওতাল ভাষায় তারা ‘হড় হপন’ অর্থাৎ মানবজাতির আসল সন্তান যা তাদের ‘হড় দিশম’ বা দেশ/ভূমি চেতনার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। যে জন্য বলা হয়, ভূমি হারানো অর্থ আদিবাসীদের সত্তা হারানো। ‘হড় হপন’ হিসেবে এই যে গর্ববোধ আদিবাসী চেতনায় প্রোথিত তা সাংস্কৃতিক বলিষ্ঠতার জোরে প্রচণ্ড বিরুদ্ধ শক্তির আঘাতের মুখেও বিলীন হয়নি পুরোপুরি। একইভাবে বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান ধর্মকেও আদিবাসীরা গ্রহণ করেছে প্রয়োজনের তাগিদে কিন্তু নিজস্বতার আঙ্গিকে; যে কারণে তাদের সামাজিকতায়, সাংস্কৃতিক উদযাপনে ধর্মীয় রীতিনীতি ও আদিবাসী আদি রীতিনীতি সহবস্থান করে। ফলে দেখা যায় একজন খ্রীষ্টান আদিবাসীর বিয়েতে চার্চের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সিঁদুর পড়ানো বা অন্যান্য সনাতন রীতিনীতিও পালিত হচ্ছে । অন্যদিকে বর্তমান বাংলাদেশে ইসলামীকরণের প্রবল জোয়ারের মুখেও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অন্যান্য অঞ্চলের আদিবাসীরা কিন্তু ধর্মান্তরিত হননি। আদিবাসী সাংস্কৃতিক শক্তির কারণেই বৃহত্তর ধর্মগুলো তাদের পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি। যেজন্য দেখা যায়, উত্তরবঙ্গে খ্রীষ্টান চার্চগুলো নানা বাধা-নিষেধ আরোপ করে চলেছে ‘বিশুদ্ধ খ্রীষ্টান’ আদিবাসী বানানোর প্রচেষ্টায়, আর তার বিপরীতে চলছে আদি সংস্কৃতিকে পালনের সহজাত এবং সমবেত নানা প্রচেষ্টা, তা যত সীমিত আকারেই হোক না কেন। অর্থাৎ যেখানে গ্রহণ করেছে সেখানেও পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে নয়। আর গ্রহণ-বর্জন সভ্যতা বিকাশের স্বাভাবিক নিয়ম; আদিবাসী সমাজ, সংস্কৃতি এর উর্দ্ধে ‘বিশুদ্ধতার ক্যাপসুলে’ মোড়া কোন স্থির, নিশ্চল বিষয় নয় বা ভাবাটা স্বাভাবিক, বৈজ্ঞানিকও নয়। বৈশ্বিক ও দেশীয় প্রেক্ষাপটের বর্তমান বাস্তবতায় আদিবাসী সাংস্কৃতিক বলিষ্ঠতার এই দিকগুলো বেশি করে পরিচর্যা ও আলোচনায় আসা দরকার। তবে বিশুদ্ধতা রক্ষার নামে পুনরুত্থানবাদী চিন্তার অবকাশ যেমন নেই, তেমনি প্রায়োগিক পরিবর্তন মেনে নিয়ে রূপান্তরের ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আদিবাসী সংস্কৃতির যে অন্তর্গত বলিষ্ঠতা তার নিজস্ব সত্তাকে ধরে রাখায় অদ্যাবধি শক্তি যুগিয়েছে তাকে লালন করাটা তাই জরুরি।
# ঈশানী চক্রবর্তী, শিক্ষক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়.
৯ আগষ্ট ২০১৬, আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের প্রকাশনা ‘সংহতি‘-তে প্রকাশিত