আদিবাসী মুদ্রনশিল্পী সুইদিশ সাংমার পথচলা
সাম্প্রতিককালে আদিবাসীদের মধ্যে নানান প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান থাকলেও মুদ্রণের কাজের সাথে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুব বেশি একটা নেই। থাংস্রে কালার সিস্টেম আদিবাসীদের মধ্যে মুদ্রণের কাজে যুক্ত রয়েছে ২০০৭ সাল থেকে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রকাশনের মুদ্রণের কাজ করেছ চলেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সুইদিশ হাগিদক নিজেকে এই কাজের সাথে যুক্ত রেখেছেন ১৯৯৪ সাল থেকে। প্রথমে অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করলেও নিজের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার তাগিদ থেকেই ২০০৭ সালে যাত্রা শুরু করে থাংস্রে কালার সিস্টেম। এ যাবত বিভিন্ন প্রকাশনীর বই, আদিবাসী সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা ও আদিবাসী ছাত্র সংগঠনের প্রকাশনায় মুদ্রণের কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
মামাতো ভাই দীপক সাংমার হাত ধরে মুদ্রনের কাজে আসা। সে সময় দীপক সাংমা কাজ করতো খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের প্রকাশনা প্রতিবেশী-তে। ১৯৯৪ সালে সুইদিশ হাগিদকের কাজের হাতেখড়ি হয় তার সাথেই। ১৯৯৭ সালে যুব উন্নয়নের সরকারি প্রকল্পের আওতায় স্বল্প মেয়াদি কোর্স করেন তিনি। তার কাজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে তিনি আমাদের জানাচ্ছিলেন, প্রথম দিকে মুদ্রণের কাজ সহজ ছিলোনা মোটেও, পেরোতে হয়েছে নানান প্রতিবন্ধকতা। সে সময়ে প্রধানতম বাঁধা ছিলো প্রযুক্তিগত সমস্যা। প্রযুক্তি যেমন দুর্লভ ছিলো ঠিক তেমনই ছিলো প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ মানুষের। আর যারাও আশেপাশে পরিচিত দক্ষ লোক ছিলো তারাও সহজে কাউকে শেখাতে চায়তোনা। তাছাড়া সে সময়ে মুদ্রণের কাজে খরচ ছিলো অনেক। প্রথম দিকে বর্ষা প্রকাশনীতেই মুদ্রকরের কাজ করতেন তিনি। অন্যান্য পেশা ছেড়া এ পেশায় আসাটা কিছুটা প্রয়োজনীয়তার তাগিদ থেকে হলেও শেষে ভালোবেসেই এ কাজেই থেকে গেছেন তিনি। প্রায় পঁচিশ বছর ধরেই মুদ্রণের কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন ।
সুইদিশ হাগিদক সে সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে মুদ্রণের কাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন স্বাধীনভাবে। নিজস্ব ছাপাখানা না থাকলেও প্রকাশনীর মুদ্রণের কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কিছুটা ফ্রিল্যান্স আকারেই কাজ করেন তিনি। এর মধ্যে আদিবাসী ফোরামের প্রায় সব কাজই হয় থাংস্রে কালার সিস্টেমের মাধ্যমে। তাছাড়া বেসরকারি সংস্থা কাপেং ফাউন্ডেশন, বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজের কাজও থাংস্রে কালার সিস্টেমেই হয়। এছাড়া আরো বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কাজ, বিভিন্ন আদিবাসী ছাত্র সংগঠন, সামাজিক সংগঠনের কাজ, বিভিন্ন প্রকাশনীর বইয়ের মুদ্রণের কাজ করে থাকে থাংস্রে কালার সিস্টেম। মুদ্রণের কাজে আনন্দ পান বলেই কাজে লেগে আছেন তিনি। তার মতে এই কাজে তিনি মানসিক সন্তুষ্টি পান। তাছাড়া এ কাজে সৃষ্টিশীলতা রয়েছে বলে অন্যরকম ভাল লাগাও কাজ করে বলেও মনে করেন তিনি।
বর্তমান সময়ে প্রকাশনীর দিকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। তাছাড়া প্রযুক্তি এগিয়েছে বহুদূর। প্রকাশনের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে মুদ্রণ শিল্প শিক্ষায় তৈরি হয়েছে নানা প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হচ্ছে মুদ্রণের কারিগরি নানান বিষয়ে। সেখান থেকে কারিগরি জ্ঞান নিয়ে এ কাজে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব। আদিবাসী তরুনদের মধ্যে এ দিকেও মনোযোগ দেয়া যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। মুদ্রণ শিল্পে পেশা গড়ে তোলার সম্ভবনার দিক থেকে মোটেও কম কিছু নয় বলেও জানান তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটালি প্রকাশনা মুদ্রণের কাজ হচ্ছে। যেখানে ছাপানোর বদলে অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন প্রকাশনা। এ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি মনে করি অনলাইনে বিভিন্ন প্রকাশনা থাকলেও সরাসরি বাস্তব যে প্রকাশনার আকাঙ্ক্ষা কখনোই শেষ হয়ে যাবেনা। তবে অনলাইনে প্রকাশনা হচ্ছে তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রকাশনার প্রতি মানুষের যে আবেগ, যে ভাললাগা তা শেষ হয়ে যাবেনা বলেই আমার বিশ্বাস। তাছাড়া যদি খেয়াল করি একটা বয়সের পর আসলে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকা দুস্কর হয় বলেই আমার ধারনা। যেটা একটা প্রকাশিত বইয়ের ক্ষেত্রে কম হয়। তাছাড়া যন্ত্রের তো চোখের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বেশি রয়েছে সে কারনেও হয়তো ছাপানো বইয়ের প্রতি মানুষের ভালবাসা বা প্রয়োজনীয়তা শেষ হবেনা বলেই আমার ধারনা। আর যারা প্রকৃত পক্ষেই জ্ঞানের অনুসন্ধানে থাকেন তাদের কাছে ছাপানো বই অপরিহার্য বলেও তিনি মনে করেন। অনেকেই মনে করেন ডিজিটালি যেহেতু মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে তাই আগামীতে হয়তো মুদ্রণ শিল্পের বা যারা মুদ্রণে কাজ করেন তাদের সমস্যা তৈরি হবে। সুইদিশ হাগিদক সেটা মনে করেননা মোটেও।
সুইদিশ হাগিদক জন্মগ্রহণ করেছেন ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউরা থানার কলসিন্দুরের পঞ্চনন্দপুর গ্রামে ১৯৭৪ সালে । সেখানেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহন করেন, মাঝখানে কয়েকবছর ছিলেন ভালুকাপাড়ার সেন্ট তেরেজা হাইস্কুলে। পরে তেজগাঁও কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শান্তা মারিয়ামে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক করে পড়া লেখার ইতি টানেন তিনি। বর্তমানে থাংস্রে কালার সিস্টেম নিয়েই তার সমস্ত ব্যস্ততা। এখানেই বিভিন্ন প্রকাশনের মুদ্রণের কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।