জাতীয়

আদিবাসী মাতৃভাষা বিষয়ক কর্মশালাঃ ভাষাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দাবি

পপেন ত্রিপুরা,বিশেষ প্রতিনিধিঃ জাবারাং কল্যাণ সমিতি ও বনফুল এডুকেশন ফাউন্ডেশন’র আয়োজনে বৃৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) সকাল নয়টায় ঢাকাস্থ বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন (বিএনসিইউ) সম্মেলন কক্ষে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল চূড়ান্তকরণ বিষয়ক জাতীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
অনুষ্ঠানের প্রথম অধিবেশনে জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন। বিশেষ অতিথি ছিলেন, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. রমজান আলী ও বিএনসিইউ’র সচিব মো. মনজুর হোসেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, বাংলাদেশ নানা ভাষা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ একটি দেশ। ম্যানুয়েল খসড়া প্রণয়ন একটি মৌলিক কাজ। তাই খসড়াকে পরিশুদ্ধ, পরিপূর্ণতার জন্য পরামর্শ প্রদান করা অংশগ্রহনকারীদের মৌলিক দায়িত্ব। বাংলাদেশ একটি সম্প্রীতির দেশ উল্লেখ করে তিনি বলেন দেশের সকল ক্ষেত্রের অগ্রগতি দেশের সকল অঞ্চলের মানুষ ভোগ করবে। তাই যার যার অবস্থানে থেকে কাজ করে এগিয়ে যেতে হবে।
বিশেষ মনজুর হোসেন বলেন, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে দেশের মানুষ ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল। তাই ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করার পর দেশের সকলের ভাষাকে পরিচর্যা করা এবং উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা অন্যান্য দেশের থেকে বাংলাদেশের দায়িত্ব কিছুটা হলেও বেশি। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষায় শিক্ষক ম্যানুয়েল প্রণয়নের এই উদ্যোগ যখন শুরু করা হয়, তখনও এসব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনার কাজ সম্পন্ন হয়নি। এখন সরকারের পাঠ্যপুস্তক রচনার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। স্কুলগুলোতে সেসব বই সরবরাহ করা হয়েছে। সরকারের যদি অনুরূপ কোন ম্যানুয়েল থাকে, তা সাথে সাংঘর্ষিক হয় সেদিকে খেয়া রাখার জন্য তিনি অনুরোধ করেন। পরবর্তীতে এই ম্যানুয়েলগুলোকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করার জন্য প্রয়োজনে ডিপিই ও এনসিটিবি’র সহায়তা নেয়ার জন্যও তিনি পরামর্শ দেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সেলিনা হোসেন বলেন, মাতৃভাষা রক্ষা ও বিকাশের ক্ষেত্রে এটি বাংলাদেশ সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ। তিনি বলেন, প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীকে নিজেদের চেতনাকে জাগ্রত রাখতে নিজ সন্তানদেরকে মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদান ব্যতীত কোনো বিকল্প নেই। কয়েকটি ভাষার সমন্বয়ে একটি সম্মিলিত অভিধান রচনার প্রয়োজন রয়েছে উল্লেখ করে আদিবাসী মাতৃভাষার শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে স্থানীয় ভাষাভাষীর শিক্ষক নিয়োগ করারও পরামর্শ দেন সেলিনা হোসেন।
বিশেষ অতিথি মো. রমজান আলী বলেন, বাংলাদেশে অনেক সম্প্রদায় বসবাস করেন কিন্তু এসব জাতিগোষ্ঠীর লিখিত ভাষা চর্চা না থাকায় ভাষা সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি। কিন্তু যারা মাতৃভাষা চর্চা করেন না, তারা অনেক বিষয়ে অজ্ঞ থেকে যান। তিনি প্রণীত শিক্ষক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েলটি খুবই ভাল হয়েছে বলে প্রশংসা করেন। আউট সোর্সিংএর মাধ্যমে পিটিআইগুলোকে বিভিন্ন ভাষাভাষী বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হবে বলেও জানান রমজান আলী।
দ্বিতীয় অধিবেশনে কর্মশালায় উপস্থিত চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা বিশেষজ্ঞদের হাতে সংশ্লিষ্ট ভাষার শিক্ষক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েলটি তুলে দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়। অংশগ্রহনকারীরা দলীয় কাজের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে তাদের মূল্যায়ণ ও মতামত প্রদান করেন।
চাকমা ভাষার ম্যানুয়েল পর্যবেক্ষণ উত্তর উপস্থাপন করেন বিদ্যুৎ জ্যোতি চাকমা, মারমা ভাষার ম্যানুয়েল পর্যবেক্ষণের উপস্থাপন করেন মংসাজাই মারমা ও ত্রিপুরা ভাষার ম্যানুয়েল এর উপর উপস্থাপন করেন অমর সিংহ ত্রিপুরা।
অনুষ্ঠানের বক্তারা বলেন, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি গৃহিত হয়েছে। এই শিক্ষানীতি এবং পূর্বাপর বিভিন্ন সরকারি নীতি কৌশলের আকাঙ্খা অনুসারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এই বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের শুরুতেই দেশের লক্ষিত স্কুলগুলোতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাদরি ও গারো ভাষায় শিখন শেখানোর সামগ্রী সরবরাহ করেছে। প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্যও পাঠ্যপুস্তক রচনার কার্যক্রম এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই কার্যক্রম দেশের শিক্ষার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
তাঁরা আরো বলেন, দেশের বিভিন্ন জাতিসত্তার মাতৃভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা নিজ নিজ ভাষায় পড়তে ও লিখতে সক্ষম নন। তাই পাঠ্যপুস্তকগুলো স্কুলে সরবরাহ করার পর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরকে স্ব স্ব মাতৃভাষায় দক্ষ করে তোলা।
এই চাহিদার কথা মাথায় রেখে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের এই কাজে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের অধীনে ইউনেস্কো পাটির্সিপেশন প্রোগ্রাম ২০১৬-২০১৭ এর অর্থায়নে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষায় পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের সুবিধার্থে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ভাষার বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে এসব ম্যানুয়েলের খসড়া প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ১৯ অক্টোবরের জাতীয় কর্মশালার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ভাষার অন্যান্য বিশেষজ্ঞ ও তথ্যজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ, অভিজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞগণের মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে খসড়া ম্যানুয়েলগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে আশা করি ম্যানুয়েলগুলো সংশোধন ও পরিমার্জন করা হবে এবং পরবর্তীতে এসব ম্যানুয়েল ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট ভাষার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। বক্তারা সরকারি উদ্যোগে যথাশিগগির সম্ভব ভাষাভিত্তিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের দাবি উত্থাপন করেন।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ভাষা বিশেষজ্ঞ সুগত চাকমা, সুসময় চাকমা, পুলক বরন চাকমা, পল্লব চাকমা, মোঃ মোশাররফ হোসাইন, এভেলিনা চাকমা, জলিমং মারমা ও জয়প্রকাশ ত্রিপুরা, জাবারাং কল্যাণ সমিতির কর্মসূচি সমন্বয়কারী বিনোদন ত্রিপুরা প্রমূখ।
দিনব্যাপী আয়োজিত কর্মশালায় বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিচালক মোঃ ফসিউল্লাহ্, বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের প্রোগ্রাম অফিসার মোঃ তাজউদ্দিনসহ বিভিন্ন ভাষা কমিটির লেখক-বিশেষজ্ঞগণ, স্ব স্ব ভাষায় অভিজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষিকামণ্ডলি, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার বিশেষজ্ঞগণ উপস্থিত ছিলেন।

Back to top button