মতামত ও বিশ্লেষণ

আদিবাসী ভূমি ও মানুষ এবং বাঙালি ঔপনিবেশিক নীতিঃ আজিজুল রাসেল

বাঙালি বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবিই যে সর্বজনিন হতে পারেননি, আন্তর্জাতিক হতে পারেননি, এখনও যে তাঁরা কুয়োর জলে বিচরণ করছেন বিভিন্ন সময়ে তা তাঁরা প্রমাণ করছেন। নিজেদের স্বার্থের বাইরে দু’দন্ড তাঁরা যেতে চাননা। এবারও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী প্রশ্নে তাঁরা একই কাজ করলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছেন এ বিষয়ে বেশিরভাগ বাঙালি বুদ্ধিজীবিই নিশ্চুপ। যেকোনভাবেই মানুষ মারা যাবার প্রতিবাদ হতে হবে। কৈফিয়ৎ চাইতে হবে। তারপরও বলছি, সমতলে বা নিজের জাতির ভাই/বোন মারা গেলে বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের মুখ ফোটে, কলম চলে। কিন্তু বাংলাদেশের ভিতরেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বছর বছর নিরবে আদিবাসী মরছে, মানুষ মরছে, এ বিষয় আমাদের বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবিদের কখনও একটুও নাড়া দেয়নি। বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে কত আদিবাসী নারী-পুরুষ যে হত্যার শিকার হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, ধর্ষিত হয়েছেন তার হিসেব রাখাও দুষ্কর। আদিবাসী প্রশ্নে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের চুপ থাকার দু’টি কারণ রয়েছে: এক নম্বর কারণ বেশিরভাগ বাঙালি বুদ্ধিজীবি ব্যক্তিস্বার্থে চালিত। দুই: মারা যাবার ভয়। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আদিবাসি প্রশ্নে লেখার ভয় রয়েছে। এর সাথে আরেকটি বিষয় যোগ হয়েছে, সেটি হল: পুরো বাঙালি জাতিই পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশ্নে, আদিবাসী প্রশ্নে প্যারানয়েড অবস্থার মধ্যে রয়েছে। তাদের এ অবস্থাকে তুলনা করা যেতে পারে ব্রিটিশ ও পশ্চিম পাকিস্তানি উপনিবেশকারদের সাথে। ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনকারীরা যেমন সবসময় ভারতীয়দের সন্দেহের চোখে দেখত, মিলিটারি, পুলিশ দিয়ে দমিয়ে রাখত সেই একই রকম কাজ পশ্চিম পাকিস্তানিরা করেছিল বাঙালিদের সাথে। বাঙালিদের তারা সন্দেহ করত যে, সুযোগ পেলে পূর্ববঙ্গ হয়ত ভারতের সাথে যুক্ত হবে। আমার চারপাশের অনেক বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে এই প্রবণতা প্রবল দেখেছি। তারা মনে করে পার্বত্য চট্টগ্রামে মিলিটারি দিয়ে শাসন না করলে হয়ত এই অঞ্চল আমাদের থেকে বেরিয়ে যাবে। তাই মিলিটারি দিয়ে মেরে, কেটে যেভাবেই হোক আদিবাসীদের, পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসন (শোষণ) করতে হবে। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহের ভাষা ব্যবহার করে বলব পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশের সরকারগুলো যা করছে তা হল ডমিনান্স উইথআউট হেজেমনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি শাসন অনেকটা উপনিবেশবাদের মতই।
বর্তমানে আদিবাসীদের যে বাসস্থানকে আমারা পার্বত্য চট্টগ্রাম বলে জানি, এই ভূমির ও মানুষের পরাধীনতা শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগ থেকে। ব্রিটিশরা তখন আদিবাসী অঞ্চল উপনিবেশের আওতায় এনেছিল। আদিবাসীদের সাথে প্রথমদিকে প্রবল লড়াই হয়েছিল তাদের। ব্রিটিশরাই বাংলাদেশের আদিবাসী অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলকে প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রাম হিসেবে নাম দিয়েছিল এবং বাংলা প্রশাসনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে। ব্রিটিশ উপনিবেশ শেষ হবার পরও আদিবাসী শোষণ ও নিপীড়ন শেষ হয়নি। পাকিস্তানি ‘ঔপনিবেশিক’ শাসনকালে আদিবাসী শোষণ, নিপীড়ন তুঙ্গে উঠেছিল। মূলত এই সময়েই আদিবাসী গ্রাম জনপদ ভাসিয়ে বিদ্যুৎের নামে, উন্নয়নের নামে একটি জনগোষ্ঠীর বাড়িঘর, স্বপ্ন, আশা-ভরসা ডুবিয়ে দেওয়া হয়। আদিবাসীদের চোখের জলে আলো জ্বলে সমতলে বাঙালিদের জনপদে। আহমদ ছফা তাঁর একটি লেখায় লিখেছেন কিভাবে কাপ্তাই লেক আদিবাসীদের বাড়িঘর ডুবিয়ে দিয়েছিল, কিভাবে শুধুমাত্র মাথা গোঁজার জন্য হন্যে হয়ে জায়গা খুঁজতে হয়েছিল তাঁদের।
ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি শোষণ ও নীপিড়নকামী নীতি থেকে বাংলাদেশ বেরোতে পারেনি। ১৯৭১ সালে সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিকতার যে মূলমন্ত্র নিয়ে এই অঞ্চলের মানুষেরা একটি নতুন দেশ গড়ার লড়াইয়ে নেমেছিল, দেশ গড়েছিল, সে দেশই, সে দেশের সংখ্যালঘু জাতির উপর নিপীড়ন শুরু করে উপনিবেশ স্থাপনকারীদের মত। বাংলাদেশের সব সরকারই অভিজাত এবং মধ্যবিত্ত বেশিরভাগ মানুষই আদিবাসী অঞ্চলকে তাদের উপনিবেশের মত মনে করে। একই কায়দায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত মিলিটারির হাতে কত আদিবাসী মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। শুধু প্রত্যক্ষ হত্যাই নয়। পরোক্ষভাবে, পরিকল্পিতভাবে আদিবাসীদের হত্যা, নিধন ও দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। এর প্রথম প্রক্রিয়া হল আদিবাসী অঞ্চলে বাঙালি সেটলারদের পাঠানো। বাঙালি সেটলার আদিবাসী অঞ্চলে পাঠানোয় সেখানকার পরিবেশের ভারসম্য নষ্ট হয়েছে। কারণ সমতলের বাঙালিরা জানে না কিভাবে পাহাড়ি অঞ্চলে পরিবেশর সাথে মানিয়ে বসবাস করতে হয়। এছাড়া বেশিরভাগ আদিবাসীর জীবন ও জীবিকা জড়িত ভূমির সাথে, প্রকৃতি থেকে পাওয়া সম্পদ থেকে। অতিরিক্ত মানুষের কারণে জীবন ও জীবিকার সংকট তৈরি হয়। এছাড়া ক্রমেই রাষ্ট্র আদিবাসীদের জমি কেড়ে নিচ্ছে। আদিবাসীদের জায়গায় রিজার্ভ ফরেস্ট করা হচ্ছে দিনকে দিন। এভাবে আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে এখন আদিবাসীদের নিজেদের জমি চাষ করতে হচ্ছে মিলিটারিদের কাছে লিজ নিয়ে। সম্প্রতি একটি খবরে বেরিয়েছে বগালেক থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। যেকোন সময়ের চেয়ে আদিবাসীরা এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে বান্দরবানের কয়েকটি জায়গায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চলছে। না খেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। এ দুর্ভিক্ষ মানুষ সৃষ্ট, বাঙালি ঔপনিবেশিক নীতি সৃষ্ট। স্বাধীনতার পর থেকেই যেভাবে আদিবাসীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও উচ্ছেদ করা হচ্ছে তাকে একভাবে গণহত্যার সাথেই তুলনা করা যায়।

আজিজুল রাসেল: ইতিহাসবিদ ও লেখক। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের শিক্ষক।

Back to top button