আদিবাসী দিবস এবং আমাদের জীবনের আহ্বানঃ সতেজ চাকমা
৯ আগষ্ট। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস । ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে মূল ধারার বাঙালী জনগোষ্ঠী ছাড়া অপরাপর ভিন্ন ভাষাভাষী ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে বসবাস করা ৫৪ টির অধিক ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীগুলো প্রতিবছর দেশের বিভিন্নস্থানে জাতীয়ভাবে এবং আ লিকভাবে এ দিবসটি পালন করে থাকে।যুগ যুগ ধরে যাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী ছিল এবং এখনো চলমান রয়েছে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা গোষ্ঠীর অব্যাহত শাসন,শোষণ, নিপীড়ন,নিস্পেষণ, দমন, বিচ্ছিন্নকরন, নির্মূলীকরণ এবং দেশান্তরের মত করুণ পরিণতি ।এইসব শাসন-শোষণ ও অব্যাহত দমন-পীড়ন এবং আগ্রাসী বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই ভাগ্যহত মানুষগুলো নিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছে নিজেদের স্বকীয় শিল্প,সাহিত্য ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে আকঁড়ে ধরে বাঁচার তাগিদে ।বাংলাদেশের ভূখন্ডে ৫৪ টি অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী মানুষ আদিকাল থেকে বসবাস করে আসছে।এদের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে (রাঙ্গামাটি,খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) বসবাস করছে ভিন্ন ভাষাভাষী ১৪ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী।আমি পাহাড়ের মানুষ। তাই পাহাড়ের কথায় আমি তুলে ধরি দেশের গোটা আদিবাসীদের সুখ,দুঃখের প্রতিধ্বনি হিসাবে। চলমান লেখায় আমার কাঁচা হাতে প্রিয় পাহাড়ে বসবাসরত উপরোক্ত ১৪টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর গড়পরতায় যাপিত জীবনের কথাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
অনেক সময় বিভিন্ন সভা সমাবেশে কিছু বলার সুযোগ পেলেই কেবল এ কথায় বলি ”লংগদুর একখন্ড পোড়া পাহাড়ি জনপদই পুরো পাহাড়ের নিপীড়িত আদিবাসীদের জীবনের প্রতিচ্ছবি আর গাইবান্দার গোবিন্দগঞ্জের রাষ্ট্রের হাত ধরে পুড়ে যাওয়া একখন্ড সান্তাল পল্লীই পুরো সমতল অ লে বসবাসরত আদিবাসীর জীবনকথা।”
আদিবাসী দিবসের কিছুদিন আগে ৩১ জুলাই ’১৮এর শেষ বিকেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির রাজু ভাস্বর্যের পাদদেশকে ঘিরে আমাদের সমাবেশ চলছে । এইতো সেই সমাবেশ ।কখনো আদিবাসী তরুণীর ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের পর হত্যার প্রতিবাদে সমাবেশ । কখনোবা পোড়া লংগদুর দুঃখের কথা জানান দিতেই সমাবেশ। কখনোবা গোবিন্দগঞ্জের পোড়া সান্তাল পল্লির প্রতিধ্বনি জানাতেই আমাদের সমাবেশ।হত্যা,ধর্ষণ,নিপীড়ন, নিস্পেষণ, আদিবাসী গ্রামে অগ্নিসংযোগ কিংবা কখনো সাম্প্রদায়িক হামলায় দাউ দাউ করে জ্বলা বাঘাইছড়ির বাঘাইহাটের কথা বলতে কিংবা কখনো বিলাইছড়ির ওড়াছড়ি গ্রামে রাতের আঁধারে তল্লাশির নামে সেনাসদস্য কর্তৃক দুই মারমা বোনের একজনকে ধর্ষণ এবং অপর জনকে যৌন হয়রানির পর শান্তনা হিসাবে ১০০ টাকার নোট উপহারের গ্লানিকে সইতে না পেরে তীব্র ক্ষোভ নিয়ে মানুষ হিসাবে বাঁচতে চাওয়ার বারতা দিতে আমাদের মিছিল নামে রাজপথে আর সমাবেশ চলে সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে কিংবা কখনো শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে অথবা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে।
সেদিনের সেই সমাবেশটি চলে কোমল কৃত্তিকার রক্তে পাহাড়ের সবুজ মৃত্তিকা রক্তাত্বের কথা জানান দিতে।বিগত ২৮ জুলাই ’১৮তে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় ৯ মাইল ত্রিপুরা পাড়ায় ১১ বছরের ছোট্ট কৃত্তিকা ত্রিপুরাকে হায়েনাসম সেটলার বাঙালীরা তার ছোট্ট দেহটিকে ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছে।পায়ুপথে বাঁশ ঢুকিয়ে এবং যৌনিপথ ক্ষত বিক্ষত করে নিভিয়ে ফেলা হয়েছে এই নিস্পাপ জীবন প্রদীপটিকে। ভ্রাতৃপ্রতীম অনেক ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ঝাঁঝালো বক্তব্য দিচ্ছে । পথচারীদের অনেকেই হা করে তাকিয়ে দেখছে। আর আমি !!
কেবল কৃত্তিকা নয় । তারও আগে ধর্ষণের শিকার এবং ধর্ষণের পর হত্যার শিকার আদিবাসী তরুণী সুজাতা, তুমাচিং, বলিমিলা, অংমেচিংৃৃ আর হারিয়ে যাওয়া নারীনেত্রী কল্পনা চাকমা সহ অসংখ্য আদিবাসী নারীর বিরুদ্ধে শাসকদের অব্যাহত নিপীড়ন এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে মিছিলে স্লোগান দিয়ে যখন সেইদিন সমাবেশের বক্তব্য শুনছি আর নিরব দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে আছি ।যেইনা আকাশে তাকিয়েছি ততক্ষণে শেষ বিকেলের কালো মেঘের ভিড়ে ডানা মেলে উড়ছে অসংখ্য পাখি ।
পাখিদের এ জীবন্ত, মুক্ত,স্বাধীন ডানা মেলে নিজেদের মত করে উড়বার যে স্বাধীন চিত্রটি দেখলাম হঠাৎ করেই শেষ বিকেলের দিনের শেষভাগে একফোটা জল জমেছে আমার চোখের কোণে।সে জল হয়ত কোমলমতি বোন কৃত্তিকার জন্য নয়তো হারিয়ে যাওয়া অদেখা বোন কল্পনার জন্য। যারা এসব নিয়ত ধর্ষণ,হত্যা,সাম্প্রদায়িক হামলা, শাসকদের ক্রমাগত নিপীড়ন, নিস্পেষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিয়ত সংগ্রাম করছে নিজেদের জীবনগুলো এই উড়ন্ত পাখিদের মত করে স্বাধীন সত্ত্বায় স্বকীয়ভাবে যাপনের তাগিদ নিয়ে ।কত শখ করেই তো গেয়ে থাকি মাদলের গান-
পাখির স্বভাব পাখির মত উড়বে বলে
বন পাহাড়ে উড়ে ঘুরে গাইবে বলে
লালচে মাটির গন্ধ বুকে যুচবে বলে
সবুজ মায়ার বাঁধন অটুট রাখবে বলে
শাল বৃক্ষের মতন সিনহা টান করেছে
মানুষ হয়ে বাঁচতে পীরেন যান দিয়েছে ।।
কিন্তু আমরা কি এখনো মানুষ হিসাবে বাঁচতে পারার সুযোগটুকু পেয়েছি ? সকল আদিবাসী মানুষ নিশ্চয় সমস্বরে এই প্রশ্নের না-বোধক উত্তর দিতে এক সেকেন্ডও সময় নেবে না কেননা এই আদিবাসী মানুষরা নিয়ত উচ্ছেদ হচ্ছে তার বাপ-দাদার ভিটে মাটি থেকে।আর সেখানে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তারা গড়তে দেখছে অসংখ্য সাজেক,নীলগীরি আরো কত নীলাচল!!
আর সেখানে বিশ্ববিদ্যালযের অনেক বাঙালী বন্ধুর মৌসুমী পর্যটক হয়ে আমুদে মননে ভ্রমনের হিড়িক দেখে সরল সোজা মন এমনেই বিরক্ত,বিক্ষুব্ধ হয়ে ইচ্ছেমত গালি দিতে ইচ্ছে করে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ধারা জনগোষ্ঠীর অনেক বন্ধু যখন আমার কাছে সাজেক,নীলগীরি,নীলাচল পর্যটনে পাহাড়ের বাহারী সৌন্দর্য দেখতে চাওয়ার আকুতি নিয়ে আসে আর প্রস্তাব দেয় তখন আমি তাদের গল্প শোনাই ।
গল্প শেষে বলি-
ওহে বন্ধু, ঘুরতে যাবি চল্
সাজেক,নীলগীরি আর নীলাচল
পাহাড়ের সৈন্দর্য নয়,দেখতে কান্নার নোনাজল!!
যাবি! এবার বল ?
এই কান্নার নোনাজলকে সংগী করে নিয়ত সংগ্রাম করা আদিবাসীরা এখনো মানুষ হিসাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। কারণ, বাংলাদেশের আদিবাসী মানুষ সিধুঁ-কানু, চাঁদ-ভৈরবের যোগ্য উত্তরসূরী। হাজং মাতা রাশিমুনির সন্তান, পীরেন ¯œালের মত এক এক জন সংগ্রামী মানুষ যারা মৃত্যুতেই জীবনকে খুঁজে। বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার গড়া এক এক জন গেরিলা, কল্পনার অদমিত চিৎকারের প্রতিধ্বনি। শাসকদের অব্যাহত অস্বীকৃতির দাম্বিকতাকে তুচ্ছ করে যারা নিজেদের স্বকীয় শিল্প,সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সাথে নিয়ে স্বীয় ঐশ্বর্যের বর্ণাঢ্য সাজ পড়ে এখনো দম্বের সাথে দাঁড়ায় শহীদ মিনারের পাদদেশে ”আদিবাসী!! আদিবাসী” দাবী নিয়ে। এই দাবী আমাদের মানুষের মত করে বাঁচতে চাওয়ার ।এই দাবী ুু আমাদের জীবনের আহ্বান ।এই দাবী মানতেই হবে ।
লেখকঃ সতেজ চাকমা।
শিক্ষাথী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সদস্য, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।।