আদিবাসীদের মাতৃভাষা চর্চার অধিকার রয়েছে- এমরিপ চেয়ার বিনোতাময় ধামাই
জাতিসংঘের এক্সপার্ট ম্যাকানিজম অন দ্যা রাইটস অব ইন্ডিজেনাস পিপলস (এমরিপ)এর গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত একটি ভার্চুয়াল সাইড ইভেন্টে এমরিপ চেয়ার বিনোতাময় ধামাই বলেন আদিবাসীদের মাতৃভাষা চর্চার অধিকার রয়েছে অন্যথায় এটি ঐতিহাসিক অবিচারের অংশ হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক উদযাপন বাংলাদেশ কমিটির উদ্যোগে এই সাইড ইভেন্টে স্পেশ্যাল ইন্টারভেনশন দিতে গিয়ে তিনি আরো বলেন আদিবাসী ভাষার অধিকার চর্চার জন্য জাতীয় পর্যায়ে এর স্বীকৃতি থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ঐক্যমতের মাধ্যমে আসতে হবে। তিনি বলেন আদিবাসীদের ভাষা তাদের সমষ্টিগত অধিকারের মূল উপাদান। জাতিসংঘে আদিবাসী ভাষা দশক ঘোষণার মধ্য দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে এটি নিয়ে কাজ করার একটি জায়গা তৈরি হয়েছে। আমাদের এ সুযোগ কাজে লাগানো উচিত। যদিও জাতীয় পর্যায়ে আদিবাসীদের ইউনেস্কো এর সাথে কাজ করার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে কিন্তু যেহেতু জাতিসংঘের আদিবাসী ভাষা দশক পালন করা হচ্ছে তাই আদিবাসীরা ইউনেস্কো-এর প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে এই ব্যাপারে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে যেখানে এমরিপ এবং আদিবাসী বিষয়ক পার্মানেন্ট ফোরাম সহযোগিতা করতে পারে।
আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক উদযাপন বাংলাদেশ কমিটির সদস্য সোহেল হাজংয়ের সঞ্চালনায় উক্ত অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন কমিটির সদস্য-সচিব বাঁধন আরেং। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৪০টির মতো আদিবাসীদের মাতৃভাষা রয়েছে যার মধ্যে ১৪টি ভাষা বিপন্ন এবং অন্যদের অবস্থাও ঝুঁকিপূর্ণ। আদিবাসীদের মাতৃভাষার এ করুণ অবস্থার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশে এই আদিবাসী ভাষা দশক উদযাপন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান। সেসাথে আদিবাসীদের মাতৃভাষা রক্ষা, উন্নয়ন ও সংরক্ষণে তাদের নানামুখী উদ্যোগের কথা বলেন যেখানে আন্তর্জাতিক ম্যাকানিজম ও জাতীয় প্রতিষ্ঠান যেমন- সরকারি, বেসরকারি সকল পর্যায়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার আহ্বান করেন ।
আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সমন্বয়কারী প্রফেসর ড. মেসবাহ কামাল বলেন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের আদিবাসীদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে নানাবিধ কারণ আছে। আদিবাসীদের ঐতিহাসিক বৈষম্য ও বঞ্চনা তার মধ্যে একটি। তাদেরকে মূল স্রোতধারার সাথে একিভূতকরণও এক্ষেত্রে কারণ হিসেবে কাজ করছে। দেশের মূল স্রোতধারার মানুষের অনেক ভূমিকা রয়েছে- আদিবাসী সম্পর্কে বোঝা ও তাদের স্বীকৃতি দেওয়া প্রযোজন। সেসাথে ঝুঁকিপূর্ণ আদিবাসীদের ভাষাগুলোকে সংরক্ষণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের কর্তব্য আরো বেশি এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ সংবিধান দেশের সকল জনগণকে বাঙালি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে কিন্তু বাঙালি জাতি ছাড়াও যারা এদেশে বসবাস করে আসছে তাদেরকেও স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন। তবে সংবিধানের ২৩ এর ক ধারায় দেশের আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে আংশিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যদিও ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে কিন্তু সরকারের ধীর গতিতে অর্থাৎ সাত বছরেরও বেশি সময় লেগেছে প্রথম ধাপে ৫টি আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে। এ প্রক্রিয়ার ধীর গতির জন্য এই ৫টি আদিবাসী ভাষা ছাড়া অন্যান্য মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণের সরকারি উদ্যোগ আমরা আর দেখছি না। দ্বিতীয় ধাপে অচিরেই যেন কমপক্ষে আরো ৫টি আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয় তিনি সে প্রত্যাশার ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশের ন্যাশনাল কারিকুলাম এন্ড টেক্সটবুক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর সাবেক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুনাব্বির হোসাইন বলেন, তিনি আদিবাসীদের ৫টি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরীর কাজে সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বলেন, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ভাষামেলা আয়োজন করা যেতে পারে যা জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হবে যে বাংলাদেশে কোন কোন ভাষায় কথা বলা হয়। এছাড়া আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোতে এথনিক ল্যাঙ্গুয়েজ শিক্ষা প্রদানের জন্য নাইট স্কুল চালু করা যেতে পারে বলেও তিনি পরামর্শ দেন। তিনি বলেন আমরা প্রাথমিকভাবে ৫টি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরি করে শিশুদের শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নিলেও কিন্তু স্কুলে ঐসব ভাষায় পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারছি না।
গত ৫ জুলাই বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টায় এমরিপ এর তালিকাভুক্ত এই সাইড ইভেন্ট টি অনুষ্ঠিত হয়। এবারের এমরিপ অধিবেশনের ১৩ টি এজেন্ডা আইটেম এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা অধিবেশন ছিল আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক। এ অধিবেশনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক উদযাপন কমিটি এই অনলাইন সাইড ইভেন্ট টি আয়োজন করে। উক্ত আলোচনা সভায় আরো বক্তব্য রাখেন ওঁরাও ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক যোগেন্দ্রনাথ সরকার, মণিপুরী ভাষা এক্টিভিস্ট হামোম প্রমোদ (কানাডা থেকে), খুমী ভাষা এক্টিভিস্ট লেলুং খুমী, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য-সচিব চঞ্চনা চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক রিপন বানাই, উন্নয়নকর্মী খোকন সুইটেন মুরমু (অস্ট্রেলিয়া থেকে), সুন্দরবন আদিবাসী মুন্ডা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক কৃষ্ণপদ মু-া, আদিবাসী ফোরামের অর্থ-বিষয়ক সম্পাদক এন্ড্রু সলমার, আদিবাসী ফোরামের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হরেন্দ্র নাথ সিং প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন আয়োজক কমিটির যুগ্ম-আহবায়ক ও জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা।