আদিবাসীদের নিয়ে সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গিই বর্তমান বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে

সতেজ চাকমা: করোনা মহামারীর এই দুর্দিনের মধ্যে গতকাল(১১ জুন) সংসদে ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট উত্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কর্তৃক ঘোষিত ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত এই জাতীয় বাজেট এবং আদিবাসীদের অংশীদারিত্ব নিয়ে এক ভার্চুয়াল আলোচনার আয়োজন করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। এই আলোচনার মিডিয়া পার্টনার আইপিনিউজবিডি ডটকম এর ফেসবুক পেইজ থেকে সরাসরি প্রচারিত এই আলোচনায় আলোচক হিসেবে ছিলেন আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক এবং সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, এসোশিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এন্ড ডেভলপমেন্ট(এএলআরডি) এর নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এর পরিচালনায় উক্ত আলোচনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যুক্ত হয়েছেন কাপেং ফাউন্ডেশন এর নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, টাঙ্গাইলের মধুপুর থেকে যুক্ত হয়েছেন জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক, পাটুয়াখালীর বরগুনা থেকে মেইনথিন প্রমিলা ও আদিবাসী ফোরামের ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক রিপন চন্দ্র বানাই।
প্রারম্ভিক আলোচনায় আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য সোহেল চন্দ্র হাজং বলেন, প্রতিবছর জাতীয় বাজেটে আদিবাসীরা উপেক্ষিত হয়।আদিবাসীদের জনসংখ্যা অনুপাতে পর্যাপ্ত বাজেট কোনোকালেই পেশ করা হয় নি। সমতলের আদিবাসীদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বাজেট না থাকার আক্ষেপও করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্ধ নেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে যে বরাদ্দ আসে তাতে গতবছরের তুলনায় ৩০ কোটি টাকা বেড়ে বর্তমান বরাদ্দ ৮০ কোটি টাকা হয়েছে যা এখনো পর্যাপ্ত নয়। সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টনীর আওতায়ও সমতলের আদিবাসীদের জন্য কিছু নতুন উদ্যোগ সহ সর্বমোট বরাদ্দ ১২৬ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাজেট ধরা হয়েছে ১২৩৫ কোটি টাকা যা আগের বছরের তুলনায় ৪১ কোটি টাকা বেশি।
চলমান কোভিড-১৯ মহামারির সময় ও তার পরবর্তী সময়ে আদিবাসীদের সুরক্ষা ও সার্বিক উন্নয়নে আদিবাসীদের জন্য ১১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া, সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন, আদিবাসী নীতিমাল প্রণয়ন, জাতীয় বাজেট বক্তৃতায় আদিবাসী বিষয়ে ¯স্পষ্ট বিবরণী রাখা, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও দ্রুত বাস্তবায়ন এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা সহ ১০ দফা সুপারিশও উত্থাপন করেন এই তরুণ আদিবাসী নেতা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, আমরা কেবল মাত্র বরাদ্দের কথা বলছি কিন্তু বরাদ্দ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়েও কথা বলতে হবে। এ বাজেট বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ মনিটরিং এর ব্যবস্থা করারও আহ্বান জানান তিনি। প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা বাজেট প্রণয়ন না করে আমলাদের তৈরীকৃত বাজেট পেশ করা হয় যাতে জনগণের প্রকৃত কথার প্রতিফলন হয় না। আদিবাসীদের জন্য প্রণয়নকৃত বাজেট বাস্তবায়নের সঠিক পর্যালোচনারও দাবী করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, বাংলাদেশের একটি মৌলিক সমস্যা হচ্ছে এ দেশের যে বৈচিত্র্যতা সেটাকে এখনো সেভাবে গ্রহন করা হয়নি। সংবিধানে এখনো আদিবাসীদের যথাযথ স্বীকৃতি আসেনি। যে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ভঙ্গি দিয়ে আদিবাসীদের দেখা হয় তার বলি এই আদিবাসীরা। যার জন্য জাতীয় বাজেটেও আমরা তার প্রতিফলন দেখি।
তিনি আরো বলেন, আমাদের এখানে বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। বাজেট প্রনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সাংসদদের কতটুকু অংশগ্রহন আছে তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমলারা বাজেট তৈরী করে দেয় আর তা নিয়ে আলোচনা করে সাংসদরা। বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহন নেই বলেও দাবী করেন বিশিষ্ট এই ইতিহাসবিদ। আদিবাসীদের জন্য প্রদত্ত বাজেট কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে তার ‘মনিটরিং মেকানিজম’ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই বিশিষ্ট আদিবাসী গবেষক।
আলোচনায় অংশ নিয়ে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক এবং সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, এই কারোনাকালে আমাদের কাছে দু’টি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। আমরা স্বাস্থ খাত এবং শিক্ষা খাতকে খুব বেশি উপেক্ষা করেছি ।
তিনি আরো বলেন, আদিবাসীদের কথা কেউ মনে রাখেনা। এই করোনা পরিস্থিতিতে আদিবাসীরা পর্যাপ্ত ত্রাণ থেকেও বঞ্চিত। সংবিধানে আমরা রাষ্ট্র পরিচালনার যে দৃষ্টিভঙ্গি পেয়েছি তার সাথে বর্তমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যা হচ্ছে তার কোনো মিল নেই। আমরা যে কারণে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম তার কারণের সাথে এ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্পর্ক নেই বলেও দাবী করেন এই সাংসদ। আমরা সংবিধান থেকে যে উন্নয়ন দর্শনটি পেয়েছি সেটা অনুসরন করে বাজেট প্রণয়ন করা হলেও এই বাজেট থেকে আদিবাসী, দলিত,হরিজন সম্প্রদায় বঞ্চিত হতো না বলেও দাবী করেন তিনি।