জাতীয়

আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে শ্রেণী সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই

আইপিনিউজ ডেস্কঃ আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে শ্রেণী সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই। সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬১ বছর উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত এই কথা বলেন। ২৩ জুন ২০১৬, বৃহস্পতিবার, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও কাপেং ফাউন্ডেশন এর যৌথ উদ্যোগে রাজধানী ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি ও কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন রবীন্দ্রনাথ সরেন এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঐক্য ন্যাপ সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত, অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, টিপু সুলতান এমপি; মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের ওয়াসিউর রহমান তন্ময় প্রমুখ। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এর সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য দেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা। মূল প্রবন্ধ যৌথভাবে উপস্থাপন করেন পাভেল পার্থ এবং মানিক সরেন।

সভায় পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, আদিবাসীদের আন্দোলন ব্যতীত এই উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন কখনই সম্ভব হতোনা। সিধু-কানুর নেতৃত্বে সাঁওতালদের ন্যায়সঙ্গত হুল বা বিদ্রোহ আমাদের দেখিয়ে গেছে কিভাবে অধিকার আদায় করে নিতে হয়। তবে এতোবছর পরেও বাংলাদেশের আদিবাসীদের ভাগ্যের চাকা খুব পরিবর্তন হয়নি। তিনি অভিযোগ জানিয়ে বলেন, আমাদের মধ্যেই কিছু মানুষ আছে যারা আন্দোলন সংগ্রামকে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকারও রসিকতা করে যাচ্ছে। আদিবাসীদের জমি রক্ষার আন্দোলনে আদিবাসী বাঙালি নির্বিশেষে সকল কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষকে একসাথে থেকে কাজ করতে হবে তবেই আন্দোলন বড় আকার ধারন করবে ও সফলতা পাবে।

আবুল বারাকাত বলেন, পৃথিবীর সকল আদিবাসীদের দেখলে আমরা দেখি আদিবাসীরা যেসব জায়গায় বসবাস করে সেসব জায়গা নানা ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। আর এই সম্পদকে লুটপাট করার জন্যই সব জায়গাতেই আদিবাসী উচ্ছেদ চলছে। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম দেখিনা। এখন আদিবাসীদের এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে বিপ্লব প্রয়োজন। দাতাগোষ্ঠীদের টাকায় আলোচনা সভা, সেমিনার করতে থাকলে বিপ্লবও কোনদিন হবেনা বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি আরো বলেন, আমাদের বুঝতে হবে আদিবাসীদের উপর অন্যায় অত্যাচারের মূল কারণ কি? এটা কি বাহ্যিক সমস্যা নাকি শ্রেণী সমস্যা। আমার যতটুকু বুঝ তাতে মনে হয় এটি শ্রেণীগত সমস্যা। তাই আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে শ্রেণী সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই।

সাদেকা হালিম বলেন, আদিবাসীদের কাছ থেকে ভূমি কেড়ে নেওয়াটা বরাবরই রাজনীতির অংশ। আন্দোলন সংগ্রামের কারণে ব্রিটিশ সময়েই ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন আইনী দলিল তৈরি হয়েছে। বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্র্র কাঠামোতেও অনেক দলিল তৈরি হয়েছে কিন্তু সে সমস্ত আইনী দলিলগুলোতে অনেক ফাঁকফোঁকর রয়ে গেছে। ফলে প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের জমি নানা কায়দায় লুট হয়ে যাচ্ছে। তিনি সমতলের আদিবাসীদের ভূমি রক্ষার জন্য স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানান।

সাংসদ টিপু সুলতান বলেন, বর্তমানের সাংসদেরা সবাই ভোগবাদী। যার কারণে আমরা দেখি সাংসদদের জন্য প্লট-ফ্লাট বরাদ্দ করতে হয়। অথচ অন্যদিকে গরীব কৃষক শ্রমিক আদিবাসী মানুষেরা থাকার জায়গার জন্য এক টুকরো জমির জন্য লড়াই সংগ্রাম করতে হচ্ছে। যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটাও কেড়ে নেওয়ার জন্য নানারকম ফন্দি ফিকির করা হচ্ছে। সাঁওতাল বিদ্রোহ কিন্তু আমাদের শিখিয়ে গেছে অন্যায় অত্যাচারীদের সাথে কি করতে হবে। আবারো বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ তৈরি হবে এই আশা রাখি।

সঞ্জীব্র দ্রং বলেন, মধুপুরে গোপনে জাতীয় উদ্যানের নামে আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এভাবে অনেক জায়গাতেই আদিবাসীদের সাথে আলোচনা না করেই অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নেওয়া হচ্ছে। সবশেষে আদিবাসীদের উচ্ছেদ হতে হচ্ছে আর প্রতিবাদ করলে জীবন বিলিয়ে দিতে হচ্ছে। কিন্তু কবে আমাদের রাষ্ট্র আদিবাসীদের জন্য মানবিক হবে? মানবিক রাষ্ট্রই কেবল পারে সকলের জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে।

সভাপতির বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, গোবিন্দগঞ্জে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম এর ১৮৪২.৩০ একর জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। এরই মধ্যে শুনছি সরকার সেখানে চিনিকল টিকিয়ে রাখতে না পেরে সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পায়তারা করছে। তবে সরকারকে হুশিয়ারি দিয়ে জানাতে চাই যদি সেখানে আদিবাসীদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া না হয় তাহলে আবারো হুল হবে। অতীতে দেওয়া বর্তমান সরকারের প্রদত্ত অঙ্গীকারগুলো স্মরণ করে তিনি বলেন রাষ্ট্রকে তার সকল অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে এবং আদিবাসীদের জমি-জমা রক্ষায় অঙ্গীকারের দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।

প্রবন্ধ উপস্থাপনা করতে গিয়ে পাভেল পার্থ ও মানিক সরেন বলেন, ১৮৫৫ সালে আদিবাসীদের যে আর্থ-সামাজিক অবস্থা তা আজ ২০১৬ সালেও যেন এই দেশে বিদ্যমান। আমরা দেখছি ব্রিটিশ শাসক, জমিদার, মহাজনদের মতো বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় বাহিনী, প্রশাসন, বিচার কাঠামো, আইন-আদালত আদিবাসীদের জমি-জঙ্গল-জলা কেড়ে নিয়ে অমানবিক ও অন্যায্য প্রান্তিকতায় ঠেলে দিচ্ছে। আদিবাসীরা জান দিয়ে দেশকে স্বাধীন করলেও এই স্বাধীন রাষ্ট্র অকৃতজ্ঞের মতো আদিবাসী জনগণকে অন্যায়ভাবে দূরে ঠেলে দাবিয়ে রেখেছে। আদিবাসী জনগণের উপর জুলুম আর জবরদস্তি জারি রেখেছে। রাষ্ট্রের বিচারহীন সংস্কৃতির ভেতর অস্বীকারের যাবতীয় জঞ্জাল মাড়িয়ে শত বাঁধা পেরিয়ে আজো আদিবাসী জনগণ বাংলাদেশের প্রাণ ও প্রকৃতির রঙিন ডানা সমুন্নত রাখছেন। আদিবাসী অধিকার সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের মাতম তুলে কত না অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন কতজনে, কতভাবে। করুণ বিষয় হলো সেইসব অঙ্গীকার বারবার কোথায় যে হারায় আর মিলিয়ে যায় তার হিসাব রাষ্ট্রের কোনো কৌশলপত্র কী লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আয়োজনে হদিশ করা হয় না। সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬১ বছরে দাঁড়িয়ে আজ স্পষ্টভাবে আবারো আদিবাসী সংশ্লিষ্ট অঙ্গীকারের বার্তাগুলো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। বলতে চাই এসব অঙ্গীকার সত্যিকারভাবেই রাজনৈতিক হয়ে ওঠুক। সাঁওতাল বিদ্রোহের মতই সাহসী আর মজবুত হয়ে দাঁড়াক।
আলোচনা সভায় মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ূয়া, তারিক মিঠুল, হরেন্দনাথ সিং, বিচিত্রা তির্কি প্রমুখ।

Back to top button