শিল্প ও সংস্কৃতি

অমর সুরের সন্ধানে যাদু রিছিল

শ্যাম সাগর মানকিনঃ পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক আবহে বড় হয়েছেন। কোন কোন দিন দেখা যেতো তাদের বাড়িতে গানের আসর বসেছে, আর গ্রামের সবাই এসে সেখানে জুটে যেতো। তাছাড়া যেকোন অনুষ্ঠানের জন্য নাচ-গানের প্রস্তুতিও হতো তাদের বাড়িতেই। এমন আসরে মুগ্ধ হয়ে শুনতো আর নিজেও গলা মেলাতো এই ছেলেটি। এমন সুর-তালের মুখর পরিবেশে বড় হচ্ছিলো যে ছেলেটি, তাকে সুরের নেশা পেয়ে বসবে শেষে, এ যেনো এক অমোঘ নিয়মের মতন। হয়েছেও তাই, সেই ছেলেটাই বড় হয়ে অসংখ্য গান লিখেছেন, সুর করেছেন, নিজে গেয়েছেনও। নাম তার জেমস কল্যান রিছিল, যাকে সবাই চেনে যাদু রিছিল নামেই। আদিবাসী মান্দি পরিবারের ছেলে যাদু রিছিল সুরের নৌকায় সেই যে পাল তুলেছেন, আজ অবধি সে নৌকা বেয়ে চলেছেন তিনি।

টাংগাইল জেলার মধুপুরের ছোট্ট মান্দি(গারো) অধ্যুষিত গ্রাম ইদিলপুরে মিতা রিছিল ও বিজন ঘাগ্রা দম্পতির বড় ছেলে যাদু রিছিল। এই দম্পতির সংসারে রয়েছে আরেক মেয়ে। যাদু রিছিলের মা মিশনারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন একসময় আর বাবা বেসরকারি সংস্থার চাকরিজীবী। বাবা মারা গেছেন তাও প্রায় একযুগের মতন হয়ে গেছে। মান্দি ভাষার গান দিংদিং আপ্পাদে দিংদিং ও ওয়ানগালা নিয়ে গান হাই সারি রুনমা, দুখ্রসয়ে রুনমা, ফাংস্রিরিরি জাজং নাম্মাও নকমা ওয়ানগালোঙানা গান শুনেনি এমন মানুষ মান্দি সমাজে নেই বললেই চলে। এমন জনপ্রিয় গানের রচয়িতা ও সুরকার জন থুসিন রিছিলের ছোট বোনের পরিবারের ছেলে হিসেবে যাদু রিছিলের গান ও সুরের যাত্রাটা কিছুটা ঐতিহ্যগত তা বললে খব একটা ভুল হবেনা। জন থুসিন সম্পর্কে যাদুর নানা হন। পারিবারিক এই ধারা ও আবহ ছোটবেলা থেকেই যাদুর মননে গান লিখা ও সুর করার বীজ বুঁনে দিয়েছিলো হয়তোবা।

স্কুলের গন্ডি পেরুতেই হাতে পেলেন গিটার। সে সময়ের কথা আমাদের জানাচ্ছিলেন যাদু রিছিল। কলেজ জীবন শুরু হয় ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে। সে সুবাদে কাঁচিঝুলি জিবিসি হোস্টেলে উঠি। সেখানেই হোস্টেলের কয়েকজনকে গিটার বাজাতে দেখতাম। নিজেও কিনে নিই বাদ্যযন্ত্রটি। বাজানোর হাতেখড়ি হয় হোস্টেলের বড়ভাই অনুতোষ ম্রংয়ের হাতে। গাইতে গেলে কিংবা সুর করতে গেলে কোন বাদ্যযন্ত্র বাজানোতে দক্ষ থাকা সুবিধাজনক। গিটারে হাতেখড়ি তার সেই সুবিধা আর উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছিলো। প্রথম কিভাবে গান সুর করার দিকে ঝুঁকেছিলো ঠিক খেয়াল নেই তার। গান গাইতে গাইতে নিজে সুর করাটাকে কিছুটা স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হিসেবেই দেখেন তিনি। তবে প্রথম পুরো নতুন একটা গানের সুর করেছিলেন যেটা সেটা মনে রেখেছেন। জানালেন, এক বড়ভাই শামীম পারভেজের লেখা স্বপ্নস্নান গানে সুর করেছিলাম। গানের কথা ছিলো, প্রথম তোমায় দেখা…প্রথম তোমার গান…প্রথম ভালোবাসা…প্রথম স্বপ্নস্নান। এরপর তার আরো অনেক গানে সুর করেছি। তবে সেগুলোর সবটা সেভাবে মানুষের কাছে পৌছে দেয়া সম্ভব হয়নি। এরপর আরো অনেকের গানেই সুর আর কন্ঠ দিয়েছি। নিজে গান লিখেছি, লিখছি সুর করছি। কিন্তু বর্তমানে গানে সুর করতেই ভালো লাগে। তাছাড়া সংগীত পরিচালনা করার কাজও উপভোগ করি আমি।

নিজের একক মৌলিক গানের এ্যালবাম করেছিলেন ২০১৩ সালে। মান্দি কবি বাবুল ডি নকরেকের কথায় যাদুর সুর সংগীত আয়োজনে এ্যালবামটির নাম ছিলো “দূরের গল্প”। একদম নিজেদের উদ্যোগে করা সেই এ্যালবামে গান ছিলো ৬ টি। ভার্জিনিয়া, পথ দেখানো আলো, দূরের গল্প, ধুলিধূসর, জন্মদিন, ইচ্ছের কি আছে ডানা শিরোনামের গানগুলি খুব বেশি সাড়া জাগাতে না পারলেও সুরকার ও শিল্পী হিসেবে যাদুর আনুষ্ঠানিক যাত্রাটার একটা মাইলফলক হিসেবেই থেকে যাবে। তারও আগে ধারাবাহিক নাটক ট্রাফিক সিগন্যাল এর শিরোনাম সংগীতের সুর করেছিলেন, যা জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী তাহসান গেয়েছিলেন। এরপর ২০১৪ সালে মান্দি তরুন শিল্পীদের নিয়ে মৌলিক ও পুরনো গান নিয়ে একটা এ্যালবামের কাজ করেন। মাইকো চানচিয়া নামের এই এ্যালবামে গান ছিলো ছয়টি। বিভিন্ন জনের কথা-সুর এবং নিজের করা সুরে পুরো এ্যালবামের সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন যাদু রিছিল। মান্দিভাষার এ এ্যালবামের নতুন সংগীতায়োজনে গাওয়া পুরনো গান দিংদিং আপ্পাদে ও মাইকো চানচিয়া শিরোনামের গান মান্দি শ্রোতাদের কাছে শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। এরপরের বছর ২০১৫ সালে যাদু রিছিলের সুর আর সংগীত পরিচালনায় এমসিকিউ শিরোনামের ডিজিটাল এ্যালবামের ছয়টি গানে কন্ঠ দেন ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তী, দেশের ফাহমিদা নবী, আসিফ আকবর, বাপ্পা মজুমদার, সামিনা চৌধুরী এবং ফেরদৌস ওয়াহিদ। এ্যালবামের পরিবেশনায় ছিলো জিপি মিউজিক। এরপর আরো দু একটা এ্যালবামে ও নাটকের শীর্ষ সঙ্গীতের কাজ করেন তিনি। তার মধ্যে কবি মাসুদ পথিকের চাষারপুত ও কুঁড়েঘর গান দুটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বর্তমানে দেশসেরা শিল্পীদের নিয়ে দেশের গানের দুটি এ্যালবাম এবং দক্ষিন এশিয়ার ছয়টি দেশের শিল্পীদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে একটি এ্যালবামের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন এই শিল্পী। আর এরই মাঝে নিজের একক এ্যালবামের কাজও টুকটাক করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া সাম্প্রতিক কলকাতার নির্মানাধীন একটি বাংলা সিনেমাতে তার সুর করা গান যাচ্ছে বলে আমাদের জানালেন তিনি।

জনপ্রিয়তা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাননা তরুন এই সুরকার ও সংগীত পরিচালক। গানের প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা থেকে গানের সুর ও সংগীত পরিচালনা করে যাচ্ছেন তিনি। প্রায় হাজারের কাছাকাছি গানের সুর দেওয়া হয়ে গেলেও তার বেশিরভাগ গানই আলোর মুখ দেখেনি এখনো। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, সে নিয়ে কিছুটা খারাপ লাগা আছে বটে। তবে যখন সুযোগ আসে নিজের গান করার তখন দ্বিধায় পড়ে যাই কোন গানটা করবো আর কোনটা করবোনা, এটায় একটা মানসিক পীড়ার কারন আমার কাছে। মনে হয় আমার শরীরে প্রায় হাজারটা ক্ষত রয়েছে, যখন কোন গান এ্যালবামে শেষ করতে পারি মনে হয় একটা ক্ষত শুকিয়ে গেছে। এভাবেই নিজের অভিব্যাক্তি প্রকাশ করলেন এই তরুন।

গানে সুর করাটা একপ্রকার নেশার মতন তার কাছে। যে নেশার ঘোর নিয়ে জীবনের সুখদুখের মুহূর্তগুলো পার করে দেয়া যায় অনায়াসে। যাচ্ছেও যেনো তাই। জীবনের পুরোটা সময় জুড়ে কেবল গান আর সুর করে কাটিয়ে দিলেন। এখনো অক্লান্ত সেই পথ বেয়ে যাচ্ছেন। এমনই সে নেশা! গানের জগতে টিকে থাকতে হলে প্রচন্ড ধৈর্য ও মানসিক শক্তি থাকতে হয়। আর এমন প্রচন্ড ঘোরলাগা ভালবাসা না থাকলে হয়তো গান গাওয়া হয়, হুট করে জনপ্রিয়ও হয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু গানে সুরে এমন একাকার করা জীবন কাটানো দুঃসাধ্য বলেই মনে করেন যাদু রিছিল।

এতোদূর পথ এসে নিজেকে এখনো সংগীতের কাঁচা ও অনভিজ্ঞ একজন ছাত্রই মনে করেন যাদু রিছিল। শিখে চলেছেন অবিরাম। হয়তো একদিন আসবে যেদিন কিছুটা পাকা হয়ে উঠতে পারবেন। সৃষ্টি করতে পারবেন এমন কিছু গান যা শ্রোতাদের হৃদয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে আজীবন। এমন স্রষ্টা কেনা হতে চায়। যাদু রিছিল তার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করেছেন ভালো গান সৃষ্টি করাটাকে। যদিও বর্তমান সময়ে সেই ভালো গানের সৃষ্টি খুব একটা হচ্ছেনা বলেই তার ধারণা। গানের প্রতি সুরের প্রতি এর পেছনে যে মানুষগুলো কাজ করেন তাদের আন্তরিকতা, ভালোবাসা্র কমতিই এর কারন বলে মনে করেন যাদু রিছিল। আসলে ভালো গান সৃষ্টি করা উচিৎ, সুর করা উচিৎ মনের আনন্দে, নিজের খেয়ালে। কেবল জনপ্রিয়তা পাবার জন্য সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলে ভাল গান সৃষ্টি হবেনা বলেও মনে করেন তিনি।

এমন ভালো গান ও সুরের সন্ধানেই আজীবন পার করে দিতে রাজি যাদু রিছিল। তাই সময় পেলেই ঘুরে বেড়ান দেশের দেশের বিভিন্ন জনপদ, আদিবাসী জনপদ। তার বিশ্বাস হয়তো একদিন এই জনপদের মানুষগুলোর কাছে, প্রকৃতির কাছে তিনি পেয়ে যেতে পারেন তার সৃষ্টির রসদ। হয়তো কোন একদিন তার হাতে ধরা দেবে সেই অমর সুর যা দিয়ে যাদু রিছিল রচনা করতে পারবেন এমন গান যা তাকে তার মৃত্যুর পর বাঁচিয়ে রাখবে এই পৃথিবীতে। এমনই স্বপ্নে বিভোর এই আদিবাসী তরুন সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। এমন স্বপ্নগুলো বেঁচে থাক, পূর্ণতা পাক। আমাদেরও এই আশাবাদ।

Back to top button