মতামত ও বিশ্লেষণ

অবরুদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রাম

লামা থেকে ফিরে সুমন মারমাঃ ৫ মে। দীর্ঘ ১৪ ঘন্টা ভ্রমণ করে কক্সবাজারে স্থানীয় একটি হোটলে অবস্থান করেছি। পরদিন অর্থাৎ ৬ মে প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার সফরে আসবেন তাই সাজ সাজ পরিবেশ। সরকারি লোকেরা রাত ভর ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রী আগমনকে কেন্দ্র করে। আমরা কয়েকজন রাত ১১ টার দিকে সী বীচে হাঁটার জন্য হোটেল থেকে বেরিয়েছি। শ্রী পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারেক আলী, প্রথম আলোর বান্দরবান প্রতিনিধি বুদ্ধজ্যোতি দা, নিউ এইজের জুয়েল ভাই সহ আরও কয়েকজন বীচে হাঁটতে যাননি খুব ক্লান্ত ছিলেন বলে।
আমরা ডেইলী স্টার প্রতিনিধি সঞ্জয় দা, ভোরের কাগজের জিডমিন ভাই, আইনজীবী প্রকাশ দা, সমকালের চট্টগ্রাম ব্যুরোর মামুন ভাই, আইইডির নুমান ভাই ও মানবাধিকার কর্মী রওশন মাসুদাসহ সবাই হাঁটতে বেরিয়েছি। রাত ১১:৩০ টার দিকে হোটেলে ফিরেছি। কাল অর্থাৎ ৬ মে খুব সকালে লামার উদ্দেশ্যে কক্সবাজার ত্যাগ করতে হবে তাই।
৬ মে। সকাল ৭ টায় আমরা কক্সবাজার থেকে লামার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি। আমাদের বহন করা দুটো গাড়ি ছিলো। সাথে কক্সবাজারের আদিবাসী নেতা ক্য জ অং দা ও মংনু হেডম্যান দা আমার সাথে সফর সঙ্গী হন।
প্রায় ১০ টার দিকে আমরা লামায় প্রবেশ করতে শুরু করি। আমাদের ওখানে যাবার উদ্দেশ্য হচ্ছে ওখানকার ম্রো, মারমা ও ত্রিপুরা আদিবাসীদের বেদখল হওয়া ভূমি সরেজমিন পরিদর্শন করা। তথাকথিত লাদেন গ্রুপ, অবৈধ রাবার ইন্ড্রাজটিজ, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন সেখানকার চার হাজার অধিক একর জায়গা অবৈধভাবে বেদখল করে রেখেছে। জানা যায় সেখানে আমাদের বিশেষ বাহিনীরও ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে।
যাইহোক আমরা লামা সদরে পৌঁছাবো মাত্র ১২ কিলোমিটারের পর। কক্সবাজার হয়ে লামা প্রবেশ দ্বার ইয়াংসায় পৌঁছালাম। দেখি ২ কিলোমিটারের মতো যানবাহন দাঁড় করানে। আমরা যেতেই দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির চালকেরা বলছেন আপনারা যেতে পারবেন না। কারণ জানতে চাইলে সেনাবাহিনীরা রাস্তা ব্লক করে রেখেছে জানায়। আর কেউ কেউ বলে উঠলো যেতে পারবেন যান।
ইয়াংসায় পৌঁছালাম। ঘটনা সত্যি। আমাকে বহন করা গাড়ি আগে হওয়ায় আমি গাড়ির কাঁচ খুলে এক যুবককে জিজ্ঞেস করলাম। কেনো ব্লক করা হয়েছে। যুবকটি বললো কারা যেন ঢাকা থেকে কক্সবাজার গেছে ওনারা আজ লামায় আসবে তাই সেনাবাহিনীরা পুরো রাস্তা ব্লকেড দিয়ে রেখেছে। যুবকটির চোখে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সত্য বলেছে। তারপর গাড়ির কাঁচ বন্ধ করে দিই। গাড়িতে বসা সাংবাদিক বন্ধুরাও শুনেছেন।
এরপর দেখি পেছনের গাড়ি থেকে নেমে নুমান ভাই সেনাবাহিনী টইল দেয়া ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছেন। বুদ্ধজ্যোতি দা ও নামেন। এরপর সবাই নেমে যান। নুমান ভাই ও সাংবাদিক বন্ধুরা এগিয়ে গিয়ে জানতে চান কেন আটকানো হয়েছে। আমাদের যেতে দিচ্ছে না কেন। সেনাবাহিনীরা বলেন স্থানীয় ম্রো রা নাকি অবরোধ দিয়েছেন। এরপর পুলিশের এসপি ও ওসিকে ফোন করে জানা যায় তাদের কাছে অবরোধের সংবাদ নেই। স্থানীয় ইয়াংসা বাজারে কেউ কেউ বলছেন সমঅধিকার আন্দেলন রা অবরোধ দিয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে সারমর্ম লামায় ঢুকতে দেবে না সেনাবাহিনী। প্রায় দু’ঘন্টা ব্যাপী আমাদের আটকে রেখে ফেরত পাঠানো হয়। ব্লক করার কারণে শত শত সাধারণ মানুষ আটকা পড়ে, ভোগান্তিতে পড়ে। তাদের বক্তব্য হলো কোন কথা বার্তা ছাড়া হঠাৎ করে অবরোধ কেন দেয়া হলো।
আমরা ফেরত যায়। শোনা গেছে নাগরিক প্রতিনিধি দলের কাছে বেদখল হওয়া ভূমি বিষয়ে অভিযোগ দিতে আসা শত শত মানুষকেও ফেরত পাঠিয়েছে বিশেষ বাহিনী। আলীকদম থেকে কিছু ম্রোকে ধরে নিয়ে এসে প্ল্যাকার্ড ধরিয়ে দিয়ে অবরোধ পালন করেছে সেনাবাহিনী।
আমরা লামা থেকে ফেরত এসে বান্দরবানে রওনা দিই। ডিসি, এসপি, জেলা পরিষদ ও সার্কেল চীফের সাথে দেখা করার শিডিউল ছিলো ৭ মে। কিন্তু তা আগায়ে ৬ মে যাচ্ছিলাম যেহেতু লামা যাওয়া হলো না।
দুপুর ১২:৪৫ এ আমরা রেইছা আর্মী ক্যাম্পে পৌঁছালাম। আমাদের বহন করা গাড়ী দুটো আবার আটকানো হলো। কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন তাদের কাছে নাকি ইনফরম্যাশন রয়েছে। কিসের ইনফরম্যাশন জানতে চাইলে তা নাকি গোপনীয়। বলা যাবে না বলে। আমরা আবারও গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। তারা আরও বলে বান্দরবানে নাকি গাড়ি ভাংচুর হচ্ছে তাই আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থে আটকে রেখেছে।
গাড়ী ভাংচুরের তথ্য কে দিয়েছে জানতে চাইলে গোয়েন্দারা নাকি দিয়েছে বলে। আমি তাদের সামনে এক বিশ্বস্ত সূত্রকে ফোন দিয়ে বাংলায় কথা বলি। তখন চট করে বলে উঠে উপরের নির্দেশ আছে যে ক্লীয়ারেন্স ব্যতীত আমাদের বান্দরবানে ঢুকতে দেবে না। বীর বাহাদুরকেকে ফোন দিলে তিনিও ফোন ধরেন নি। সেখান থেকেও আমাদের ঢাকা ফেরত পাঠানো হয়। রেইছা বাজারে গাড়ী বহর থামানো হলে একদল সেটলার হামলা করতে আসে।
নাগরিক প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় ফিরার সময় চট্টগ্রাম কুমিরায় পুলিশের হয়রানির শিকার হয়। আমি একজন পার্বত্যবাসী হিসেবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে ও বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ঘটনাটি পুরোপুরি বিশ্লেষণ করে দেখলাম পার্বত্য চট্টগ্রাম সেনা ছাউনী দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে। সেখানে সংবিধানের আইন কোনভাবে সচল নয়। সাংবিধানিক সব আইন সেখানে রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন সেখানে সেনাবাহিনী মানেই আতঙ্ক। অবিলম্বে চুক্তি মোতাবেক বেসামরিকিকরণ করা না হলে মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে প্রতিকার পাওয়া অসম্ভব হবে। সেনাবাহিনী নাগরিকের নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখুক এই আশা রাখছি।

Back to top button