মতামত ও বিশ্লেষণ

অপহৃত মংপু’কে বান্দরবানের আওয়ামীলীগ ও প্রশাসন কি সত্যিই উদ্ধার করতে চায়? : লাব্রেচাই মারমা

অপহৃত মংপু মারমাকে বান্দরবানের আওয়ামী লীগ ও প্রশাসন কি সত্যিই উদ্ধার করতে চায়? এমন প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর মধ্যে। গত ১৩ জুন ২০১৬ বান্দরবান সদর উপজেলার রাজভিলা ইউনিয়নের জামছড়ি মুখ গ্রামের অধিবাসী ও আওয়ামী লীগের সদস্য মংপু মারমাকে একদল দুর্বৃত্ত কর্তৃক অপহরণ করা হয়। ঘটনার পর বান্দরবানের আওয়ামী লীগ, পুলিশ ও সামরিক প্রশাসন অপহৃত মংপু মারমাকে উদ্ধারের পরিবর্তে বা উদ্ধারের জন্য দলমত নির্বিশেষে সম্মিলিত উদ্যোগের পরিবর্তে এ ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে বান্দরবান থেকে জনসংহতি সমিতিকে উৎখাত ও নিশ্চিহ্নকরণে কার্যক্রম গ্রহণে বেশি ব্যস্ত থাকতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এই অপহরণের পর পরই হ্লামংচিং মারমা নামে মংপুর এক জামাতাকে দিয়ে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও যুব সমিতির নেতাকর্মী ও নিরীহ গ্রামবাসীর ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১৫/২০ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলায় জেএসএস ও এর সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে এমন সদস্য নেই যাদের নাম গণহারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। প্রকৃত অপহরণকারী ও দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে মামলা না করে জেএসএস ও সহযোগী সংগঠনের সদস্যদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা করার পেছনে কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে তা গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়।
এ ঘটনার পর থেকে অপহৃতকে উদ্ধারের পরিবর্তে সেনা-পুলিশের সদস্যরা আওয়ামী লীগ কর্মীদের নিয়ে জেএসএস সদস্যদের গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে রাজভিলা, কুহালং, নোয়াপতং, বান্দরবান সদরে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে আসছে। এতে করে এলাকায় এক নাজুক পরিসি’তি সৃষ্টি হয়েছে এবং হয়রানির শিকার জনগণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। এতে করে অপহৃত মংপুর জীবনকে আরো বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়া হচ্ছে বলে বলা যায়। এক্ষেত্রে বান্দরবান জেলার পুলিশ সুপারের ভূমিকা নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জানা যায় যে, ঘটনার পরদিন রাতে বান্দরবানের এসপি মিজানুর রহমান জেএসএস নেতা ও আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কে এস মং মারমাকে ফোনে সরাসরি বলেন যে, ‘আমি জানি আপনি অপহরণের সাথে জড়িত নন, কিন’ মংপু উদ্ধার না হলে আপনাকে এক নম্বর আসামী করে মামলা দায়ের করা হবে।’ গত ১০ জুলাই নতুন বার্তা নামে অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানের বক্তব্য থেকে সেই আশঙ্কা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি বলেছেন যে, “আওয়ামী লীগ নেতা মংপু মারমা অপহরণের পর পুলিশ সব চেয়ে বেশি পদক্ষেপ নিয়েছে। জনসংহতি সমিতির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ তাদের গ্রেফতারে বাসা-বাড়িতে তল্লাশী চালানো হয়েছে।” এ থেকে বুঝা যায়, পুলিশের ভূমিকা অপহৃত মংপুর উদ্ধারের চেয়ে তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে জেএসএস নেতাদের গ্রেফতার করা এবং এ ঘটনাকে ব্যবহার করে জেএসএস সদস্যদেরকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা ও নাজেহাল করা।
বান্দরবান জেলা আওয়ামীলীগের নেতৃত্বও মংপু মারমাকে উদ্ধারের পরিবর্তে এ ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে জেএসএস নেতৃত্বকে বান্দরবান থেকে উৎখাত ও নিশ্চিহ্নকরণের তৎপরতায় লিপ্ত থাকতে দেখা গেছে। ঘটনার পরদিন ১৪ জুন ২০১৬ আওয়ামী লীগের বান্দরবান জেলার সভাপতি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমা অপহৃত মংপু মারমার স্ত্রী সামাপ্রু মারমাসহ তাঁর কয়েকজন আত্মীয়কে বান্দরবান সদরে ডেকে নেন এবং আগে থেকে লিখে রাখা এজাহারে স্বাক্ষর করতে মংপু মারমার স্ত্রীকে বলা হয়। মামলার তালিকায় তাঁর এক মেয়ের জামাইয়ের নাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কেএসমং মারমা ও সাধুরাম ত্রিপুরা, রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যবামং মারমা, প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান শম্ভু কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, জনসংহতি সমিতির জেলা সভাপতি উছোমং মারমাসহ অন্যান্য পরিচিতদের নাম শুনে এবং যেহেতু তারা নিরপরাধ বা ঐ ঘটনার সাথে জড়িত নয়, তাই মংপুর স্ত্রী সামাপ্রু মারমা ঐ মামলার বাদী হতে অস্বীকার করেন। মামলার বাদী হতে রাজি না হওয়ায় আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ মংপুর স্ত্রী সামাপ্রু মারমাকে ব্যাপক গালিগালাজ করেন এবং মারধর করতে উদ্ধ্যত হন বলে জানা যায়। এমনকি মামলার বাদী হতে রাজি না হওয়ায় মংপুর স্ত্রী সামাপ্রুকেও অপহরণ মামলায় জড়িত করা হবে বলে হুমকি প্রদান করা হয়। পরে অনেকটা জোর করে অপহৃত মংপুর মেয়ের জামাই হ্লামংচিং মারমাকে বাদী করে মংপু মারমা অপহরণ মামলা দায়েরের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
অপহরণের ঘটনার পর আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি অপহৃতকে উদ্ধারের জন্য নিজেদের উদ্যোগে বা অপহৃতের আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে অপহরণকারীদের সাথে যোগাযোগ করার কোন উদ্যোগ আওয়ামী লীগের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। অপহৃতকে উদ্ধারের জন্য সামাজিক উদ্যোগেরও কোন প্রয়াস চালানো হয়েছে বলে জানা যায়নি। উদ্ধারের জন্য জেএসএস সহ অন্যান্য দল ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে দলমত নির্বিশেষে সম্মিলিত উদ্যোগেরও কোন প্রয়াস চালানো হয়নি। পক্ষান্তরে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অপহৃতকে উদ্ধারের দাবিতে জেএসএসের বিরুদ্ধে বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি সদর ও জামছড়ি এলাকায় রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল করতে সদা তৎপর থাকতে দেখা গেছে যেখানে মংপুর আত্মীয়-স্বজন ও সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীকে উপস্থিত থাকতে অনেকটা বাধ্য করা হয়েছে। এমনকি বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভায় অপহৃতকে উদ্ধারের চেষ্টা-চরিত্রের পরিবর্তে জেএসএসকে শায়েস্তা করার কলাকৌশল ঠিক করতে বেশি তৎপর থাকতে দেখা গেছে।
সিএইচটিটাইম২৪ অনলাইন পত্রিকা থেকে জানা যায় যে, গত ৩ জুলাই ২০১৬ বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের জরুরী এক মিটিঙে “জনসংহতি সমিতি ও পিসিপির নেতা কর্মীদের প্রতিহত করতে গ্রাম থেকে রাজপথে আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষ থাকবে” বলে ঘোষণা দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের বান্দরবান জেলার সহ সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীরের ফেসবুকের স্টাটাসে জনসংহতি সমিতি ও পিসিপির নেতা কর্মীদের শায়েস্তা করা হবে এবং কাউকে আর ছাড় দেয়া হবে না মর্মে সভাপতি ক্যশৈহ্লা ঘোষণা দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দের সামনে ‘কেএস মং মারমাসহ জেএসএস নেতৃবৃন্দকে ছাড় দেয়া হবে না’ বলে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী ও এমপি বীর বাহাদুর উশৈসিংও প্রকাশ্যে হুমকি প্রদান করেন।
জেএসএসের ৭ জুলাইয়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, “বান্দরবান জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ক্যশৈহ্লা মারমা ও অপহৃত মংপু মারমা-এর মধ্যকার ক্ষমতার ভাগাভাগি ও দ্বন্দ্বের কারণে মংপু মারমা অপহরণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে”। জানা গেছে যে, অপহৃত মংপু মারমাকে কোন একটি উচ্চতর দায়িত্বশীল পদে বসানো হবে মর্মে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে ইঙ্গিত ছিল। এমন গুজব রয়েছে যে, সেই থেকে মংপু’কে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভাবতে থাকেন বান্দরবানের আওয়ামীলীগ সভাপতি ক্যশৈহ্লা। তৎপ্রেক্ষিতে ক্ষমতার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে দূরে সরে দিতেই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মংপুকে অপহরণের ঘটনা ঘটানো হয়েছে মর্মে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন। আর তাই মংপুকে উদ্ধারের কোন কার্যকর চেষ্টা-তদ্বির না করে সেই ঘটনাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে জনসংহতি সমিতির সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিসি’তিকে অস্থিতিশীল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা।
তারিখ: ১২ জুলাই ২০১৬। লাব্রেচাই মারমা [email protected]

Back to top button